পদকজয়ীদের মাসিক আয় মাত্র ১৬ হাজার, ক্রীড়াঙ্গনের এ বৈষম্য কমবে কবে?
ফুটবল ও ক্রিকেট ছাড়া দেশের অন্য সব খেলার খেলোয়াড়দের আর্থিক অবস্থা খুবই দুর্বল। দেশের হয়ে অ্যাথলেটরা আন্তর্জাতিক পদক আনেন। পদকটিই কেবল প্রাপ্তি হয়, আর্থিক অঙ্কে তারা তেমন কিছুই পান না। ক্রীড়াঙ্গনের এ বৈষম্য দিন দিন প্রকট হচ্ছে।
অলিম্পিয়ান আরচ্যার রোমান সানা সম্প্রতি জাতীয় দল থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর পেছনে মূল কারণ দেশের হয়ে খেলার জন্য সারা দিন-রাত অনুশীলন ও বিদেশের মাটিতে প্রাণ বাজি রেখে লড়লেও নেই আর্থিক কোনো প্রাপ্তি। আরচ্যারি খেলে বাংলাদেশ আনসারে চাকরি পেয়েছেন রোমান। সেখানে মাসিক বেতন মাত্র ২৫ হাজার টাকা। তারপরও সেটাকেই গুরুত্ব দিতে হচ্ছে এই কৃতি আরচ্যারকে। কারণ জাতীয় দলে খেলে ওইটুকুও পান না তিনি! তাই আনসারের হয়ে শুধু জাতীয় আরচ্যারি খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রোমান। খেলবেন না জাতীয় দলে।
বিজ্ঞাপন
রোমান সানার মতো কিংবা আরো করুণ অবস্থা অন্য অ্যাথলেটদের। আনসারে চাকরি করেন ভারত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। সাফ গেমসে টানা দুই স্বর্ণ জেতা এই ভারত্তোলক সেখানে বেতন পান ১৬ হাজার টাকা। কিছুদিন আগে ইরানে এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিক্সে রৌপ্য পদক জেতা জহির রায়হান বাংলাদেশ নৌবাহিনী থেকে পান মাসে ২৪ হাজার টাকা।
বিজ্ঞাপন
আরচ্যাররা ফেডারেশন থেকে আর্থিক সাহায্য সেভাবে না পেলেও বিদেশি কোচের অধীনে অনুশীলন ও বিদেশে খেলার সুযোগ পান বছরে কয়েক বার। যা মাবিয়া ও জহিরসহ অন্য অনেক খেলার ক্রীড়াবিদরা পান না। এরপরও তারা লড়ছেন এবং দেশের হয়ে পদক আনছেন।
কেন খেলছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বর্ণজয়ী ভারত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্তর সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘আসলে আমরা যা পাই এটা বলার মতো না। এরপরও আমরা খেলছি, কারণ দীর্ঘদিন পরিশ্রমের পর একটা অবস্থান তৈরি করেছি। সেই অবস্থান ছাড়তে চাই না। তাই খেলি। এর সঙ্গে খেলার প্রতি ভালোবাসা তো রয়েছেই।’
আরও পড়ুন
দেশের অন্যতম তারকা শুটার শাকিল আহমেদ। দক্ষিণ এশিয়ায় স্বর্ণ ও কমনওয়েলথ গেমসে রৌপ্য জয়ী এই শুটারের মাসিক আয় ত্রিশ হাজারের মতো। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘দুই-একটি খেলা বাদে অন্য সকল খেলায় জাতীয় দলের খেলোয়াড় শুধু বলার জন্যই বলা। অনেকে মাত্র ২০-৩৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। এত স্বল্প আয়ে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে এক বেলা রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়াও যায় না।’
অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, ভারত্তোলন, শ্যুটিং, কাবাডিসহ বাকি সকল ফেডারেশনের খেলোয়াড়দের মাসে মাসে আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার সামর্থ্যও নেই। কারণ, ফেডারেশনের নিজস্ব আয় নেই এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে প্রদত্ত অনুদানও খুব সামান্য। তাই অ্যাথলেট, সাঁতারু, ভারত্তোলক, শুটাররা আনসার, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীতে চাকরি নেন।
শুটার শাকিল, ভারত্তোলক মাবিয়া ও সাঁতারু শিলা খানিকটা ভাগ্যবান। ২০১৬ সালে এসএ গেমসে স্বর্ণপদক জেতায় প্রধানমন্ত্রী তাদের ফ্ল্যাট দিয়েছেন। শাকিল ও শিলা নিজস্ব ফ্ল্যাটে ওঠায় বাড়ি ভাড়া গুনতে হয় না। মাবিয়া সরকারি ফ্ল্যাটের ভাড়া দিয়ে অন্য এলাকায় ভাড়া থাকেন। গত দশ বছরের মধ্যে ফুটবল, ক্রিকেট বাদে অন্য খেলার বর্তমান ক্রীড়াবিদদের সরকারি পর্যায় থেকে এটাই সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পদক জিতলে টুকটাক আর্থিক প্রণোদনা মেলে। তাই ক্রীড়াবিদদের অধিকাংশের লক্ষ্য থাকে এসএ গেমসে একটি স্বর্ণ জয়ের। তবে এটা অনেক দূরের আশা মনে করেন স্বর্ণজয়ী শুটার শাকিল, ‘পদক জিতলে কিছু পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক খেলা হবে, পদক জিতবে এরপর পাবে- এ রকম আশা নিয়ে থাকাটা কষ্টকর। জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের নির্দিষ্ট একটা সম্মানী থাকা দরকার।’
সীমান্তর এক্ষেত্রে একটি প্রস্তাব, ‘শুটিং, আরচ্যারি, অ্যাথলেটিক্স, সাঁতারসহ প্রতিটি খেলায় দুই-তিনজন করে ভালো মানের খেলোয়াড় রয়েছে। এদেরকে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে মাসিক ভিত্তিতে সাহায্য করা উচিত। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় তো ক্রীড়ার জন্যই। তারা যদি ক্রীড়াবিদদের না দেয় তাহলে আর কারা দেবে?’
এমন প্রস্তাব দিলেও পরক্ষণেই আবার হতাশ কণ্ঠে বলেন, ‘আসলে আমাদের যে সিস্টেম, এটা পরিবর্তন হওয়ার নয়। আমরা যেমন কিছু পাচ্ছি না, আমাদের পূর্ববর্তীরাও এভাবেই খেলে গেছেন। তাদের পূর্বসুরীরাও একইভাবে খেলে গেছেন। আমরাও যাব, আমাদের পরবর্তীরাও হয়তো এভাবেই যাবে।’
এমন হতাশা থেকেই রোমানের মতো অ্যাথলেট জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়েছেন। রোমানের আকস্মিক অবসরে যাওয়ার পেছনে যৌক্তিকতা খুঁজে পেলেও মাবিয়া একটু ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করলেন, ‘দীর্ঘদিন পরিশ্রমের পর রোমান তার জায়গাটা তৈরি করেছেন। এখন তিনি ট্র্যাকের বাইরে চলে গেলেন। খেলোয়াড়দের ট্র্যাকে থেকেই প্রতিবাদ করা উচিত। ট্র্যাকের বাইরে গেলে কেউ মনে রাখবে না।’
দেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। জাতীয় দলের ফুটবলাররা ক্যাম্প ও টুর্নামেন্টের জন্য শুধু একটি পকেটভাতা পান, নেই কোনো ম্যাচ ফি। তবে ক্লাব ফুটবল থেকে মোটামুটি অর্থ পাওয়ায় এ নিয়ে ফুটবলারদের তেমন আক্ষেপ নেই। শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটাররা প্রিমিয়ার, জাতীয় লিগ খেলে লাখ লাখ টাকা পারিশ্রমিক পান। জাতীয় ক্রিকেটাররা কেন্দ্রীয় চুক্তির আওতায় প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ম্যাচের ফিও পান বোর্ড থেকে।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের কাঠামো ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ক্রিকেট বোর্ড ছাড়া অন্য কোনো ফেডারেশন খেলোয়াড়দের আর্থিকভাবে সাপোর্ট দিতে পারে না। ফুটবল ফেডারেশন ফিফা, এএফসি ও দেশীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ফুটবল পরিচালনার পাশাপাশি নারী-যুব ক্যাম্প পরিচালনা করে। নারী ফুটবলারা দীর্ঘ আন্দোলনের পর এখন মাসিক বেতন পাচ্ছেন। সেটাও মাঝে মধ্যে অনিয়মিত।
অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, ভারত্তোলন, শ্যুটিং, কাবাডিসহ বাকি সকল ফেডারেশনের খেলোয়াড়দের মাসে মাসে আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার সামর্থ্যও নেই। কারণ, ফেডারেশনের নিজস্ব আয় নেই এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে প্রদত্ত অনুদানও খুব সামান্য। তাই অ্যাথলেট, সাঁতারু, ভারত্তোলক, শুটাররা আনসার, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীতে চাকরি নেন।
ফুটবল, ক্রিকেটের পর দেশের তৃতীয় বড় খেলা হকি। বাংলাদেশের হকির অন্যতম তারকা খেলোয়াড় রাসেল মাহমুদ জিমি। নিয়মিত হকি না হওয়ায় তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছেন। তার অনেক অনুজ ফুটবল, ক্রিকেট খেলে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করলেও জিমির সম্বল নৌবাহিনী থেকে প্রাপ্ত বেতনই। তাই তিনি সার্ভিসেস সংস্থাগুলোকে ধন্যবাদ দিলেন, ‘হকি একটা বড় খেলা। সেই হকি লিগ হয় তিন-চার বছর পরপর। তাই হকি লিগকে নাম দিয়েছি ঢাকা অলিম্পিক। নৌবাহিনী, সেনাবাহিনীসহ অন্য সংস্থাগুলো খেলোয়াড়দের চাকরি দেয়ায় আমরা বেঁচে রয়েছি। না হলে জীবন-জীবিকা চালানোই কঠিন হতো।’
দাবায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। দেশের শীর্ষ দাবাড়ু– এখনো প্রতিনিয়ত দেশে-বিদেশে খেলেন। এত খেলার পরও খেলোয়াড় হিসেবে তার আয় মাসে লাখ টাকারও কম, ‘প্রিমিয়ার লিগে একটু অর্থ পাই। এছাড়া অন্য খেলায় তেমন অর্থ নেই। সত্যিকার অর্থে গড় হিসাব করলে শুধু খেলে লাখ টাকা হয় না বললেই চলে।’
জিয়াউর রহমান পরিবার চালাতে খেলার পাশাপাশি কোচিং করান। এতে খেলায় ব্যঘাত ঘটে স্বীকার করে বলেন, ‘কোচিং আয়ের অন্যতম উৎস। সব সময় আবার কোচিং করানোও যায় না। আবার বেশি কোচিং করালে খেলায় ব্যঘাত ঘটে। খেলা, কোচিং এবং আনসারের ভাতা এই তিন মিলিয়ে চলছি।’
গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়া ও তার ছেলে তাহসিন দুইজনই দাবাড়ু। আনসারের হয়ে জাতীয় দাবা খেলায় তারা প্রতি মাসে একটা আর্থিক সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। সার্ভিসেস সংস্থার চাকুরি আবার দুই ধরনের। কেউ চুক্তিভিত্তিক আবার কেউ স্থায়ী। যারা স্থায়ী তারা মাসিক বেতন একটু কম পেলেও খেলা ছাড়ার পরও এই চাকরি চালিয়ে যেতে পারবেন এবং চাকরি থেকে অবসরের পর অবসরকালীন ভাতা পাবেন। তাই জাতীয় দলে তেমন সুযোগ-সুবিধা না পেলেও চাকরির মায়ায় খেলে যান অনেকে।
২০১৬ সালে এসএ গেমসে স্বর্ণপদক জেতায় প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে ফ্ল্যাট দিয়েছেন। শাকিল ও শিলা নিজস্ব ফ্ল্যাটে ওঠায় বাড়ি ভাড়া গুনতে হয় না। মাবিয়া সরকারি ফ্ল্যাটের ভাড়া দিয়ে অন্য এলাকায় ভাড়া থাকেন। গত দশ বছরের মধ্যে ফুটবল, ক্রিকেট বাদে অন্য খেলার বর্তমান ক্রীড়াবিদদের সরকারি পর্যায় থেকে এটাই সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।
চুক্তিভিত্তিক অনেকে স্থায়ীদের তুলনায় দুই-তিন গুণ মাসিক বেতন পান। তবে তারা খেলা ছাড়ার পর বা চুক্তি শেষ হলে আর কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না।
ক্রিকেট-ফুটবলের সঙ্গে অন্য খেলোয়াড়দের আর্থিক একটা বৈষম্য যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে জনপ্রিয়তারও। গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়া তাই রসিকতার ছলে আক্ষেপ নিয়ে বললেন, ‘আমরা দেশের শীর্ষ পর্যায়ের খেলোয়াড় হলেও আমাদের মানুষ সেভাবে চেনে না। তাই পাবলিক বাসে খুব সহজেই যাতায়াত করা যায়।’
ভারত্তোলক মাবিয়া এক্ষেত্রে কাঠগড়ায় তুললেন কর্মকর্তাদের, ‘আন্তর্জাতিক পদক ও অর্জনের সংখ্যা হিসাব করলে আমরা ক্রিকেটের চেয়ে পিছিয়ে নেই বরং এগিয়েই থাকব। এরপরও কেন আমাদের মানুষ চেনে না? কারণ আমাদের ফেডারেশনের কর্মকর্তারা আমাদের সেভাবে উপস্থাপন করতে পারেনি।’
প্রায় তিন দশকের বেশি সময়ের ক্রীড়া সংগঠক সিরাজউদ্দিন মো. আলমগীর। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের এই সংগঠক ছিলেন ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক। এখন বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের সদস্য। ক্রীড়াঙ্গনের প্রতিটি স্তরে কাজ করা এই সংগঠকের পর্যবেক্ষণ-- ‘খেলাধূলার মূল কারেক্টার হলেন খেলোয়াড়রা। খেলোয়াড়দের আর্থিক নিশ্চয়তা না দিতে পারলে ক্রীড়াঙ্গনে উন্নয়ন সম্ভব নয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে সমন্বিত পরিকল্পনা খুবই জরুরি।’
এজেড/জেএ/জেএস