বাংলাদেশের অন্যতম কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ দাবার গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। মাত্র ৫০ বছর বয়সে জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুনিয়া ত্যাগ করেন তিনি। জিয়াউর রহমানের হৃদয়বিদারক বিদায়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের খোঁজ নিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন ক্রীড়াঙ্গনের চিকিৎসা ব্যবস্থা আসলে কোন অবস্থায় আছে....

প্রাথমিক চিকিৎসা পাননি জিয়া

৫ জুলাই (শুক্রবার) জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা চলছিল। পড়ন্ত বিকেলে আন্তর্জাতিক মাস্টার শাকিল হলরুম (যেখানে দাবা টুর্নামেন্ট হয়) থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে ফেডারেশনের প্রশাসনিক কক্ষে এসে বলছিলেন, ‘জিয়া ভাই মাটিতে পড়ে আছে, সবাই দ্রুত আসেন।’ জিয়ার স্ত্রী তাসমিন সুলতানা লাবণ্য হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ান। পাশের বোর্ডে খেলা জিয়ার একমাত্র সন্তান তাহসিন বাবাকে উঠানোর চেষ্টা করছিলেন অন্য দাবাড়ুদের সঙ্গে। কয়েক মিনিট নানা চেষ্টার পর জিয়ার জ্ঞান না ফেরায় দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দাবাড়ুরা জিয়াকে কোলে করে ধরে সিড়ি দিয়ে নামিয়ে আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবের গাড়িতে তোলেন। শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় মিনিট দশেকের মধ্যেই শাহবাগে এক শীর্ষস্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল জিয়াকে। এই প্রতিবেদক সেদিন ঘটনার শুরু থেকেই উপস্থিত ছিলেন।

হাসপাতালে পৌঁছানোর পরই শোনা যায় গগণবিদারী কান্না। চিকিৎসক জিয়ার পালস পাচ্ছিলেন না একাধিক চেষ্টা করেও তাই মৃত্যু ঘোষণা করেছেন। আধঘণ্টা আগেও যিনি দাবার বোর্ডে লড়ছিলেন সেই গ্র্যান্ডমাস্টার পরপারে, পুরো দাবা অঙ্গন স্তব্ধ। চারদিন পেরিয়ে গেলেও এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি জিয়ার পরিবার। জিয়ার স্ত্রী তাসমিন সুলতানা লাবণ্য কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘সব কিছুই কপালের লিখন। এরপরও একজন চিকিৎসক থাকলে অন্য কিছু হলেও হতে পারত। দাবাড়ুরা যে যার জ্ঞানমতো চেষ্টা করেছে জিয়ার জন্য, কিন্তু তারা তো আর চিকিৎসক নন। ওই সময় প্রতিটি মুহূর্ত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবের সঙ্গে খেলছিলেন জিয়া। সেই রাজীবও প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়টি অনুধাবন করেছেন, ‘একজন চিকিৎসক থাকলে তিনি পরিস্থিতি আমাদের চেয়ে ভালো বুঝতেন। হাসপাতালে নেওয়ার আগে হয়তো তিনি কোনো পদক্ষেপ নিতে পারতেন।’

রাণী হামিদ-নিয়াজ মোরশেদরাও ঝুঁকিতে

ফুটবল, ক্রিকেট ও অন্য খেলার মতো দাবায় শারীরিক ঝুঁকি নেই। এরপরও ঝুঁকির তালিকায় দাবা ওপরের দিকেই রয়েছে। দাবায় অনেক বয়সী খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের চাপ নেওয়ার ক্ষমতা ও হৃদপিন্ডের ক্ষমতা কমে। যাদের হৃদযন্ত্রের সমস্যা থাকে, তাদের উত্তেজনা ও চাপ এড়ানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।

সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দাবাকে একটু ঝুঁকিপূর্ণই বললেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডক্যিাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পোর্টস মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক আলী ইমরান—‘কোনো দাবাড়ুর যদি হৃদরোগের সমস্যা থাকে। সেই সমস্যা নিয়ে তিনি দাবা খেললে সেটা অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ দাবায় মানসিক চাপের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি।’

দাবায় দেশের পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টার, সবার আগে বিদায় জিয়ার (সর্বডানে)

বাংলাদেশের অন্যতম কিংবদন্তিতুল্য দাবাড়ু রাণী হামিদের বয়স ৮০ বছরের বেশি। উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদের বয়স প্রায় ৬০। এই বয়সে খেলোয়াড়রা দাবার বোর্ডেও চাপে থাকেন। জিয়ার মৃত্যুর পর বিষয়টি নিয়ে ভাবছে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন—

‘আসলে বাংলাদেশের দাবায় অসুস্থতাজনিত এরকম ঘটনা কখনো হয়নি। সবার প্রিয় গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়ার অকাল মৃত্যু আমাদের সকলকে ভাবিয়ে তুলেছে। আমরা জাতীয় দাবাড়ুদের টুর্নামেন্টের আগে অথবা নির্দিষ্ট সময়ের পর মেডিক্যাল চেকআপে রাখব’, বলেন দাবা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন শামীম।

ক্রীড়াবিদদের নেই নিয়মিত চেকআপ

সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলতে খেলতে ফুটবলারদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। আকস্মিক মৃত্যুর অন্যতম কারণ হৃদযন্ত্রের জটিলতা। গতি নির্ভর খেলা ফুটবল, অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার ও হকিতে হৃদপিন্ডে চাপ পড়ে যথেষ্ট। এই খেলাগুলোতেও নিয়মিত চেকআপ প্রয়োজন বলে মনে করেন বাফুফের মেডিক্যাল কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী ইমরান— ‘পিসিএমএ টার্মটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অত্যন্ত পরিচিত। এটার অর্থ হচ্ছে মৌসুম শুরুর আগে ফুটবলাররা মেডিকেল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা। মেসি-নেইমারসহ সকলকেই এই ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়। বাংলাদেশে এই চর্চা নেই। সামনে অবশ্যই হওয়া উচিৎ।’

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী। দুই দশকের বেশি সময় ক্রীড়াঙ্গনে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। তার দৃষ্টিতে, ‘ফেডারেশনগুলোর অবশ্যই উচিৎ বছরে অন্তত একবার খেলোয়াড়দের চেকআপ করানো। দাবা ও বিশেষ কয়েকটি খেলা ছাড়া অধিকাংশ খেলায় খেলোয়াড়দের সর্বোচ্চ বয়স ৩০-৩৫ এর মধ্যেই। ফলে বারবার পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। বছরে একবার চেক করলেই যথেষ্ট।’

দেশের দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার নিয়মিত চেকআপ নিয়ে বলেন, ‘এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি একটি বিষয়। আমাদের অজান্তেই হয়তো এমন কোনো রোগ বা সমস্যা থাকে যেজন্য পারফরম্যান্সে প্রভাব হয়। নিয়মিত চেকআপ হলে সেই সমস্যাগুলো বেরিয়ে আসতে পারে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে আমরা ফিট হয়ে নিজেদের সেরাটা দিতে পারব।’

ফেডারেশনগুলোর অবশ্যই উচিৎ বছরে অন্তত একবার খেলোয়াড়দের চেকআপ করানো। দাবা ও বিশেষ কয়েকটি খেলা ছাড়া অধিকাংশ খেলায় খেলোয়াড়দের সর্বোচ্চ বয়স ৩০-৩৫ এর মধ্যেই। ফলে বারবার পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। বছরে একবার চেক করলেই যথেষ্ট।

-বিসিবির প্রধান চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী

নেই মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন

খেলাধুলায় শারীরিক কসরত যেমন প্রয়োজন, তেমনি মানসিকও। মানসিক দৃঢ়তা না থাকলে খেলার মাঠে লড়া যায় না। আবার কোচ যতই কৌশল শেখান, মানসিক পরিবর্তন না হলে সেই কৌশল বাস্তবায়ন করতে পারেন না খেলোয়াড়রা। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটিও বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে অবহেলিত।

শারীরিক চেকআপের পাশাপাশি ক্রীড়াবিদদের মানসিক স্বাস্থ্যকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বিসিবি’র চিকিৎসক দেবাশীষ। তার মতে, ‘খেলোয়াড়দের মানসিকভাবেও সুস্থ থাকতে হবে। বিশেষ করে আরচ্যারি, শ্যুটিং, দাবা পুরোটাই মনোযোগের ওপর। একবার মনোযোগ হারালে পুরো ফলাফল ভিন্ন হয়ে যায়। দলীয় খেলাগুলোতেও মানসিকতা পার্থক্য গড়ে দেয়।’

অলিম্পিয়ান শ্যুটার আব্দুল্লাহ হেল বাকী মনোবিদের প্রয়োজন নিয়ে বলেন, ‘আমরা অনেক খেলায় শেষদিকে গিয়ে হাল ছেড়ে দিই। ওই সময় যে মানসিক শক্তি দরকার তা আমাদের থাকে না। ক্রিকেট বোর্ড মাঝে মধ্যে মনোবিদ ব্যবহার করে। অন্য ফেডারেশনগুলোর সামর্থ্য যেমন নেই, এর চেয়েও বড় কথা তারা সেভাবে ভাবেও না। ফলে খেলোয়াড়দের বাজে সময় কাটিয়ে স্বাভাবিক খেলায় ফিরতে নিজের সঙ্গে নিজেকেই যুদ্ধ করতে হয়।’

থাকে না চিকিৎসক, অ্যাম্বুলেন্সও ‘ভাঙাচোরা’

ঘরোয়া প্রায় অনেক প্রতিযোগিতায় চিকিৎসক থাকে না। ফেডারেশনগুলো অন্য খাতে অনেক ব্যয় করলেও চিকিৎসা নিয়ে যেন উদাসীন। চার-পাঁচ দিনের টুর্নামেন্ট পরিচালনায় চিকিৎসকের পেছনে খুব বেশি ব্যয় হওয়ার নয়। এরপরও এদিকে কোনো খেয়ালই থাকে না অনেক ফেডারেশনের। এসএ গেমসের স্বর্ণজয়ী ভারত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত বলেন, ‘ভারত্তোলন অত্যন্ত ইনজুরিপ্রবণ খেলা। ভার উঠাতে গিয়ে অনেক ভারত্তোলক আহত হন। আমরাই ধরাধরি করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিই, কখনও চিকিৎসক থাকতে দেখিনি।’

ভারত্তোলনের মতো দাবা–কাবাডির মতো খেলাগুলোতেও প্রায় একই অবস্থা। দুই জনপ্রিয় খেলা ফুটবল ও ক্রিকেটে শীর্ষ পর্যায়ের খেলাগুলোতে চিকিৎসক মোটামুটি নিশ্চিত করা হয়। তবে অ্যাম্বুলেন্সের মান একেবারে নামকাওয়াস্তে। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি চিকিৎসক দেবাশীষের, ‘ক্রীড়াঙ্গনে আমরা যেসব অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করি, সেগুলো আসলে অনেকটা নামেই অ্যাম্বুলেন্স। বাস্তবিক অর্থে অ্যাম্বুলেন্সরই চিকিৎসা প্রয়োজন।’ ফুটবল, ক্রিকেটে বড় খেলাগুলোতে অ্যাম্বুলেন্স প্রায় সময় থাকে। তবে হকি বেশ ঝুঁকিনির্ভর খেলা হলেও অ্যাম্বুলেন্স থাকে কদাচিৎ।

বিসিবিতে ২ জন, বিকেএসপিতে একজন বাফুফেতে নেই স্থায়ী চিকিৎসক

সকল খেলা মিলিয়ে দেশে সক্রিয় ক্রীড়াবিদের সংখ্যা কয়েক হাজার। এর বিপরীতে ক্রীড়াঙ্গনে স্থায়ী চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ৩ জন (বিসিবিতে দেবাশীষ, মানজুর আর বিকেএসপিতে ডা.সামির)। খেলোয়াড়-চিকিৎসক অনুপাতে যা শূন্যের কাছাকাছি। ডাক্তার ইমরান, শফিক, জাকির ক্রীড়াঙ্গনে দীর্ঘদিন কাজ করলেও তারা ক্রীড়াঙ্গনে বেতনভুক্ত নন। বিভিন্ন ফেডারেশন কিংবা টুর্নামেন্টের সময় মেডিক্যাল কমিটি থেকে ভলান্টারি সার্ভিস দেন।

ক্রীড়ায় টেকসই উন্নয়নের জন্য ক্রীড়াঙ্গনে আরো অনেক চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করেন চিকিৎসক ইমরান, 'খেলাধূলার সাথে ব্যথা ও ইনজুরি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভালো চিকিৎসা না পেলে খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার আগেই শেষ হয়ে যেতে পারে। ভালো ও দক্ষ ক্রীড়া চিকিৎসক বেশি হলে ক্রীড়াঙ্গন আরো বেশি সুরক্ষিত হবে।'

দেবাশীষ আরেকটি বিষয় গুরুত্বারোপ করে বলেন, 'আমি বিসিবিতে চাকুরি করি। ফলে আমার নিজস্ব দায়বদ্ধতা আছে ক্রিকেটার নিয়ে কাজ করার। ইমরান ভাই ভলান্টারি করেন ফলে বাফুফে চাইলেও তাকে সব সময় পায় না। ক্রীড়াঙ্গনে বিভিন্ন খেলায় স্থায়ীভাবে চিকিৎসক প্রয়োজন। অনেক ফেডারেশনের সামর্থ্য নেই সেটা সত্য কিন্ত বিওএ কিংবা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ চিকিৎসক রাখতে পারে। ফেডারেশনগুলো চাহিদা মতো সেখান থেকে নিয়ে কাজ করতে পারে। ৩ জন স্থায়ী চিকিৎসক দিয়ে ক্রীড়াঙ্গনের প্রকৃত চিকিৎসা প্রদান করা দুরহ।' জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক জাহিদ হাসান এমিলি খানিকটা আক্ষেপ করে বলেন, 'বাফুফের স্থায়ী চিকিৎসক নেই। ফুটবলাররাও কিছু হলে ছুটে যান ক্রিকেটের দেবাশীষ দা’র কাছে। ফুটবলে একজন দেবাশীষ না গড়ে তুলতে পারা ফেডারেশনের বড় ব্যর্থতাই।'

এনএসসি স্টাফের মৃত্যু, চিকিৎসক-কম্পাউন্ডার নেই পাঁচ বছর

ক্রিকেট, সাঁতার ও শ্যুটিং বাদে দেশের বাকি সকল খেলার ভেন্যু সংশ্লিষ্ট ফেডারেশন কার্যালয়, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) বা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরাতন ভবনের জিমনেশিয়ামে জিমন্যাস্টিক্স ও তায়কোয়ান্দোর অনুশীলন হয়। তৃতীয় তলায় চলে দাবা টুর্নামেন্ট। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ভবন লাগোয়া বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম কমপ্লেক্সে ফুটবল, হকি, হ্যান্ডবল, ভলিবল, টিটি, ব্যাডমিন্টন, বক্সিং, ভারোত্তলন, কুস্তি ও উশুসহ অনেক খেলার ক্রীড়াবিদদের পদচারণা চলে দিনভর।

ক্রিকেট ও ফুটবল বাদে দেশের অন্য কোনো ফেডারেশনের আর্থিক সচ্ছলতা একেবারেই নেই। যেখানে খেলা চালাতেই তারা হিমশিম খায়, সেখানে স্থায়ী চিকিৎসক রাখা তাদের জন্য বড় বিলাসিতা! অনেক ফেডারেশন বড় টুর্নামেন্ট/লিগ চলাকালেও চিকিৎসক রাখতে পারে না।

দেশের সকল ফেডারেশন, ক্রীড়া সংস্থা ও স্থাপনার দেখভাল করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বা এনএসসি। এনএসসিতে চিকিৎসক ও কম্পাউন্ডার পদ রয়েছে। বরাদ্দও আছে রাজস্ব খাতে। কিন্তু ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে এখানে কোনো চিকিৎসক নেই। ২০২১ সালে কম্পাউন্ডার আজাদ অবসরে গেছেন। রুম-আর্থিক বরাদ্দ সব থাকলেও এনএসসির মেডিকেল বিভাগ শূন্য।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে আশি ও নব্বইয়ের দশকে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছিলেন দেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক কনক কান্তি বড়ুয়া। এরপর দুই-একজন এসেছেন। কেউ দীর্ঘসময় থাকেননি। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে চিকিৎসক পদটি ব্লক হওয়ায় (পদোন্নতির সুযোগ নেই) অনেকেই চলে যান। তানভির জোহা সর্বশেষ ২০১৪ সালের মার্চ থেকে ১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ছিলেন। তিনি অন্যত্র চাকরি নেওয়ার পর থেকে ওই পদ শূন্য আছে।  

চিকিৎসক আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকলেও কম্পাউন্ডার আজাদ ১৯৮৯ সালের মে থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত কাজ করেছেন। এনএসসি অফিসিয়াল, ক্রীড়াবিদ-সংগঠকদের রক্তচাপ ও পালস পরিমাপ করেছেন বহু বছর ধরে। সেই কম্পাউন্ডার আজাদও না থাকায় এখন সেই রক্তচাপ, পালস মাপারও লোক নেই স্টেডিয়াম ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এলাকায়।

ফুটবল, ক্রিকেট ও অন্য খেলার মতো দাবায় শারীরিক ঝুঁকি নেই। এরপরও ঝুঁকির তালিকায় দাবা ওপরের দিকেই রয়েছে। দাবায় অনেক বয়সী খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের চাপ নেওয়ার ক্ষমতা ও হৃদপিন্ডের ক্ষমতা কমে। যাদের হৃদযন্ত্রের সমস্যা থাকে, তাদের উত্তেজনা ও চাপ এড়ানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।

গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়ার হৃদয়বিদারক মৃত্যুর দেড় মাস আগে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের স্টাফ (পিবিএক্স সহকারী) সালেহা সুলতানা নাজমা ইন্তেকাল করেন। তিনি এনএসসিতে ডিউটিরত অবস্থায় অত্যন্ত অসুস্থবোধ করেন। হাসপাতালে নিয়েও তাকে বাঁচানো যায়নি (খানিকটা বিলম্বও হয়েছিল)। গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানসহ দুটি ঘটনায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চিকিৎসকশূন্যতা আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নতুন সচিব আমিনুল ইসলাম এই সংকট দূর করতে উদ্যোগ নিয়েছেন, ‘আমরা প্রেষণে চিকিৎসক পদ পূরণের জন্য চিঠি চালাচালি করছি। আমাদের অফিসের শতাধিক লোকবল আছে, এই অঞ্চলে ক্রীড়াবিদদেরও পদচারণা অনেক। তাই একজন চিকিৎসক যেন সব সময় থাকেন এজন্য কাজ করছি।’

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ স্থায়ী নিয়োগ দিলেও পদোন্নতি না থাকায় কিছুদিন পর অন্য চাকরিতে চলে যান চিকিৎসকরা। স্বাস্থ্য ক্যাডার থেকে নিয়মিত ভিত্তিতে এখানে পদায়ন করলে পদের শূন্যতা সেই অর্থে থাকবে না। তাই এ পথে হাঁটতে চায় ক্রীড়া পরিষদ।

দেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক কনক কান্তি বড়ুয়া। আশি ও নব্বইয়ের দশকে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সম্পৃক্তও ছিলেন তিনি। জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ইমতিয়াজ সুলতান জনি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের এই চিকিৎসক সম্পর্কে বলেন, ‘কনক দা দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তার ক্যারিয়ারের শুরুটা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের এখান থেকেই। আমাদের অনেক ফুটবল টুর্নামেন্টে তিনি চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেছেন। গত কয়েক যুগ ক্রীড়াঙ্গনে সেভাবে সম্পৃক্ত না থাকলেও, এখনও আমাদের সঙ্গে নানা অনুষ্ঠানে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা-সৌহার্দ্য প্রকাশ করেন।’

স্পোর্টস মেডিসিন এসোসিয়েশনের উদ্যোগ নেই

খেলাধুলার সঙ্গে চিকিৎসা ও ওষুধের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ক্রীড়াবিদদের চিকিৎসা সেবার লক্ষ্যে বাংলাদেশ স্পোর্টস মেডিসিন এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা। তিন যুগেরও বেশি সময় এই এসোসিয়েশন থাকলেও ক্রীড়াঙ্গনে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকাই রাখতে পারেনি এটি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে এই এসোসিয়েশনের কার্যালয় থাকলেও বছরের বেশিরভাগ সময়ই কক্ষটি বন্ধ থাকে।

ক্রীড়াবিদদের ইনজুরি ও চিকিৎসা নিয়ে সচেতনতামূলক সেমিনার বা সভাও সেভাবে করে না সংগঠনটি। ফলে দেশের অনেক ক্রীড়াবিদ-সংগঠকই এই এসোসিয়েশন সম্পর্কে জ্ঞাত নন। ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম সুপরিচিত চিকিৎসক অধ্যাপক আলী ইমরান সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন সম্প্রতি।

বাংলাদেশের অন্যতম কিংবদন্তিতুল্য দাবাড়ু রাণী হামিদের বয়স ৮০ বছরের বেশি। উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদের বয়স প্রায় ৬০। এই বয়সে খেলোয়াড়রা দাবার বোর্ডেও চাপে থাকেন। জিয়ার মৃত্যুর পর বিষয়টি নিয়ে ভাবছে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন।

এখন তিনি কিছুটা উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন— ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্পোর্টস ক্লিনিক করা হয়েছে। সেখানে সপ্তাহের শনিবার ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সেবা নিতে পারবেন। আমরা ফেডারেশনগুলোকে অবহিত করব এবং সামনে ক্রীড়া চিকিৎসা ও ইনজুরি নিয়ে একটি সেমিনার করব।’

ফিজিওথেরাপি সেন্টারও বন্ধের পথে

জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক পরিষদ ২০২১ সালে হকি স্টেডিয়ামে ফিজিওথেরাপি সেন্টার স্থাপন করেছিল। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ হকি স্টেডিয়ামে একটি কক্ষও বরাদ্দ দেয়। সংগঠক পরিষদ প্রাথমিক পর্যায়ে দুই-তিনটি মেশিন দিলেও পরবর্তীতে ফিজিওথেরাপিস্টরা নিজেদের উদ্যোগে আরও মেশিন ও জনবল এনে এটির মান উন্নয়ন করেন।

ক্রীড়াবিদদের চিকিৎসা সেবার লক্ষ্যে বাংলাদেশ স্পোর্টস মেডিসিন এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা। তিন যুগেরও বেশি সময় এই এসোসিয়েশন থাকলেও ক্রীড়াঙ্গনে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকাই রাখতে পারেনি এটি।

দুই বছরের বেশি সময় এখানে ফিজিও থেরাপি নিয়ে অনেক ক্রীড়াবিদ-সংগঠক উপকৃত হয়েছেন। বিশেষ করে জেলা ও বিভাগীয় সংগঠক পরিষদের মহাসচিব আশিকুর রহমান মিকুই এখানে নিয়মিত চিকিৎসা নিতেন। মিকু নিজে সুস্থ হলেও প্রতিষ্ঠানটি যখন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে তখন বাগড়া দিয়ে বসেছেন। ফিজিওথেরাপিস্টদের সঙ্গে সংগঠকদের মনোমালিন্যে এখন সেখানে অচলাবস্থা। গত কয়েক মাস ফিজিওথেরাপি সেন্টারে অনেকের যাতায়াত কমেছে। গতকাল থেকে ঝুলছে তালা। এর নেপথ্যে রয়েছেন মিকু-কোহিনূররা। ক্রীড়াঙ্গনের স্বার্থের চেয়ে তাদের ব্যক্তিস্বার্থই বড় হয়ে উঠেছে।

রমন লাম্বার মৃত্যুর পর কতটুকু এগিয়েছে ক্রীড়া চিকিৎসা ব্যবস্থা

জিয়ার মৃত্যুর পর যেমন ক্রীড়াঙ্গনের চিকিৎসা ব্যবস্থা আলোচিত, ঠিক তেমনি দুই যুগ আগে ভারতীয় ক্রিকেটার রমন লাম্বার পর এমন আলোচনা উঠেছিল। ঢাকা স্টেডিয়ামে বলের আঘাতে আহত হন রমন লাম্বা। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি দুনিয়া ত্যাগ করেন। 

বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরিয়ান মেহরাব হোসেন অপির শট রমন লাম্বার মাথায় লেগেছিল। সেই অনুশোচনা এখনো বয়ে বেড়ান অপি। দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও ক্রীড়াঙ্গনের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনো সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই বলে মনে করেন এই ওপেনার, ‘রমন লাম্বার মৃত্যুর পর ম্যাচে ডাক্তার রাখার বিষয় কড়াকড়ি হয়। এখন ক্রিকেটের প্রায় সব টুর্নামেন্টেই ডাক্তার থাকে। ডাক্তার রাখাই তো আর শেষ কথা নয়, এখন ক্রীড়া চিকিৎসা অনেক এগিয়েছে, সেই অনুপাতে বাংলাদেশে আগাতে পারেনি। এখনও ক্রীড়াঙ্গনে চিকিৎসা খাতে বাজেট ও জনবল সবচেয়ে কম। অনেক খেলোয়াড়ের সামান্য ইনজুরিতে ক্যারিয়ার শেষ হয়। ফেডারেশনগুলো খেলোয়াড়দের পাশে দাঁড়াতে পারছে না। খেলোয়াড়দের সুরক্ষা না দিতে পারলে ক্রীড়াবিদরা ক্রীড়াঙ্গনে আসতে চাইবে না।’

এজেড/এএইচএস