পুরান ঢাকার ঈদ মানেই আনন্দের ষোল আনা। ঐতিহ্যে, আভিজাত্যে গল্পটা চারশ বছরেরও পুরনো। তবে সময়ের সঙ্গে পথ চলতে চলতে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেই আনন্দ মাখা সময়। দিন পাল্টেছে, তারপরও ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’-এমন হাহাকার ছড়িয়ে দিতে রাজি নন জাভেদ ওমর বেলিম। হোসনী দালানের মানুষ অবশ্য এই তারকা ক্রিকেটারকে গোল্লা নামেই চেনে। 

রোজার ঈদে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসলেন জাভেদ। ঢাকা পোস্টকে শোনালেন পুরান ঢাকার ঈদের গল্প। জানালেন, এখনো চাঁদ রাত স্মৃতি কাতর করে তাকে। বিটিভিতে আনন্দ মেলা, চিড়িয়াখানা, চকবাজারের মেলা কিছুই ভুলতে পারেন না। ধরে রেখেছেন মজার মজার খাবার, ঈদের সালামি, আড্ডাবাজির ঐতিহ্যটাও। পুরান ঢাকার ঈদ কেন স্পেশাল- সেই গল্পটাই জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার জাভেদ ওমর বেলিম শোনালেন ক্রীড়া সম্পাদক আপন তারিক'কে-

চাঁদরাতের আনন্দ...

পুরান ঢাকায় চাঁদরাতে তো মজা করতামই। আরও আগে ছোটবেলায় কীভাবে জুতা কিনবো, কাপড় ডিজাইন করে বানাবো এসব নিয়ে ভাবতাম। এখনো মনে পড়লে রোমাঞ্চিত হয়ে যাই। এরপর ম্যাচিউরড হওয়ার পর পাঞ্জাবি ও পায়জামার শখ হতো ঈদে। হয়তো উপহার পেতাম অনেক সময়, নিজে শখ করে কিনতাম। আরেকটা জিনিস, চাঁদ রাতে গান হতো। মহল্লায় স্পিকার লাগিয়ে। দেখা যেতো পুরান ঢাকার তিন বন্ধু একই রকম পোশাকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। গান আর নাচ চলছে। হিন্দি গান, হাওয়া হাওয়া ও হাওয়া খুশবু লুটাদে... আহা সেইসব দিন। পাশে ফুচকার দোকান, ছোট ছোট বাচ্চারা লাল লিপস্টিক লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতো। 

ঈদের দিনে ঘুম কিসের!

আমাদের বয়সী অনেকেই প্রশ্ন করি ঈদের দিন 'কী' করবেন? -বলে সারাদিন 'ঘুমিয়ে' শেষ করে দেবো। আমি খুব বিরক্ত হই এসব কথায়। এটা কোন কথা হলো? অবশ্য এটা অনেক দিন ধরেই দেখছি। তখন আমি সুপারস্টার। ঈদের দিন কারও বাসায় গেলাম, দেখতাম- ওর বাবা-মা আছে, বাচ্চারা কেউ ঘর থেকে বেরই হচ্ছে না। আমি খুব অবাক হতাম। ঈদের দিন এটাই তো মজা।

আমি খুব অবাক হতাম যখন আর্টিস্টরা বলে ঈদের দিন ঘুমাবো। আমি এভাবে ভাবি না। মানুষজন আসবে আর আমি ঘুমায় শেষ করে দেবো! আমি দুপুরে ঘুমাতাম না, সন্ধ্যায়ও বাসায় ফিরতাম না। কারণ বাসায় ফিরলে তো ঈদ শেষ হয়ে যাবে এই জন্য। ওইটা খুবই মিস করি। এখন মহামারিতেও আমি আমার স্টাইলটা রেখেছি...

আনন্দমেলা, চিড়িয়াখানা, চকবাজারের মেলা

আনন্দমেলা শুরু হতো ঈদের সন্ধ্যায় আটটার খবরের পর। এটা দেখা চাইই চাই। আরও ছোটবেলায় করতাম কী, মিরপুর যেতাম, চিড়িয়াখানায়। আমাদের কাজের ছেলে-মেয়ে সঙ্গী হতো। আর আমাদের চকবাজারে মেলা তো বিখ্যাত। মেলা থেকে সব বাঘ ভাল্লুক এসব কিনতাম। কেনার পর গাছের নিচে রাখতাম। এরপর চিড়িয়াখানায় থেকে এসে দেখতাম কে যেন সব ভেঙেচুরে শেষ করে দিছে। তখন খুব মন খারাপ হতো, এখন অবশ্য মনে পড়লে হাসি। ওগুলো খুব মিস করি, একদম ছোটবেলাটা। 

তারপর যখন একটু বড় হলাম, টাকা পকেটে থাকে। তখন সন্ধ্যা হলে বাজি লাগিয়ে লাচ্চি খাওয়া, ছুটে যেতাম জনসন রোডে, বিউটি বিউটি লাচ্ছি, আহা ওটা মিস করি। তারপরের স্টেপ- পাঞ্জাবি কেনা দুইদিন ধরে। ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা দিয়ে কিনতাম, তখন কিন্তু এটা অনেক টাকা। আমার তো অন্য কোনো বদ অভ্যাস ছিল না, তাই বেশি টাকা দিয়ে কিনতাম। একদম ছোটবেলায় ছিলাম বাবার ওপর নির্ভর। এরপর চিড়িয়াখানায় যাওয়া, চকবাজারে মেলা। শেষের স্টেপ নিজে যখন বড় হয়ে গেলাম। তখনো আমি উপভোগ করতাম, এখনো করি। ঈদের দিন আমার বাসায় সকালে সবাই নাস্তা করে। ভাই-বোন সবাই চলে আসে ঈদের দিন সকালে। 

ঈদের দিনটা বড় হয়...

বলতে আপত্তি নেই আমি এখনো ঈদ উপভোগ করি। নিজের মতো করে দিনটা রঙিন করে তুলতে চাই। সন্তান তো আছেই, আমিও করি। সবাইকে বলি, ঈদের দিন তাড়াতাড়ি  বাসায় এসো। সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলে দিনটা বড় হয়ে যাবে। বারোটায় এসে নাস্তা করলে তো দিন ছোট হয়ে যায়। 

সালামি দিতেই ভালো লাগে...

শেষ পাঁচ-সাত বছর আমি খুব উপভোগ করি ঈদি দেওয়া। মন খারাপ হয় একটু। বোন মারা গেল, ভাই নাই। অজান্তে কেমন একটা শূন্যতা তৈরি হয়। ওটা আবার কাভার করি সালামি দিয়ে। এখন অবশ্য কম পাই। হয়তো শাশুড়ি বা দুয়েকজন দেয়। আগে খালা ছিল, উনি দিতো। উনি মরে গেছেন। 

ভাতিজা, ভাগ্নি সব সিরিয়ালে বসে। তাদের সবার হাতে সালমি দেই। দুপুরে নানি শাশুড়ির সঙ্গে দেখা হয়। সত্যি বলতে কী সালামি দেওয়াটা বেশি উপভোগ করি। ঈদে সব সময় নতুন টাকা রাখি। অনেক মজা এটা। নতুন টাকা ইচ্ছে করে ছোট নোট দেই। 

নান্না মিয়ার বিরিয়ানি এবং ভিসিআর ভাড়া

আমাদের সেই শৈশবে তখন ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না। মোবাইল-কম্পিউটার আবিষ্কারও সম্ভবত হয়নি। আমি বলছি সেই ১৯৮৪-৮৫ সালের কথা। আমরা তখন ভিসিআর ভাড়া করে নিয়ে আসতাম। সবাই চাঁদা দিত। নান্না মিয়ার বিরিয়ানি দিয়ে আয়েশে খেয়ে দেয়ে রাত ভর চলতো সিনেমা দেখার আনন্দ! আবার অনেক মহল্লায় টিকিট কেটে ভিসিআরে সিনেমা দেখার সুযোগ ছিল। সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। টিকিট কেটে বসে পড়তাম। আর ছোট্ট ঘরটায়-সবাই এমন করে সিগারেট খেতো যে শার্টের গায়েও গন্ধ লেগে থাকতো। তারপর বাসায় ফেরা মানে নির্ঘাত মার খাওয়া! তারওপর টিকিট কেটে কী সিনেমা দেখা হতো সেটা তো অভিভাবকরা জানতেন। এজন্য মারটা আরো বেশি পড়তো গায়ে।

পুরান ঢাকা কেন স্পেশাল

স্পেশাল মনে হয় কেন, কারণ সবাই সবাইকে চেনে। ধানমন্ডিতে আমার শ্বাশুড়ি থাকতো। অথচ পাশের ফ্ল্যাট কেউ কাউকে চেনে না। আর এখানে মহল্লায় বের হলে সবাই চেনে। জাভেদ ওমর হিসেবে চেনে না। গুল্লু ভাই হিসেবে চেনে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে না চেনার কিছু নাই। পাশের বাসা। 

আগে তো এমন হতো ধনিয়া পাতা নাই, পাশের বাসা থেকে নিয়ে আসো। মরিচ নেই, যাও ওই বাসা থেকে নিয়ে আসো। এখন তো ইগো প্রবলেম, এটা সেটা কতো কী। কিন্তু এখনো আমি যাই। খাওয়া পাঠাই। এখন কম গেছে এটা, গেট বন্ধ থাকে। পুরান ঢাকার স্পেশালিটি হচ্ছে এখানে সবাই সবাইকে চেনে।

এটি