অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর
ক্রীড়াঙ্গনে চেয়ার রদবদল, প্রকৃত সংস্কার কবে?
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। আজ সরকারের এক বছর পূর্তি।
অর্ন্তবর্তী সরকারের এক বছরে ক্রীড়াঙ্গনের নানা ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের।
বিজ্ঞাপন
প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী ৪ ক্রীড়াবিদ
খেলা ছাড়ার পর সাবেক ক্রীড়াবিদরা রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী বা নানা পরিচয়ে সরকার প্রধানের সফরসঙ্গী হয়েছেন নানা সময়। খেলাবস্থায় সরকার প্রধানের কোনো সফরসঙ্গী হওয়ার রীতি সাম্প্রতিক বা অতীতে ছিল না। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাতার সফরে দুইজন ফুটবলার ও ক্রিকেটার ছিলেন। তারা কাতারের বিশ্বমানের ক্রীড়া স্থাপনা ঘুরে দেখেছেন। কাতার ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন।
বিজ্ঞাপন
প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হয়ে কাতার ঘুরে আসার পর সেই অভিজ্ঞতা মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেছিলেন তারা। চারজন ক্রীড়াবিদ প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হওয়া ছাড়াও গত এক বছরের মধ্যে সাফ চ্যাম্পিয়ন নারী দল ও পাকিস্তানের মাটিতে সিরিজ জয়ী বাংলাদেশ ক্রিকেট দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। ক্রীড়াঙ্গনের বিভিন্ন সাফল্য-অর্জনে প্রধান উপদেষ্টা অভিনন্দন জানিয়েছেন।
কোটি টাকার বোনাস
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে বড় সাফল্য বয়ে আনেন নারী ফুটবলাররা। অক্টোবরে কাঠমান্ডুতে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়ন হন সাবিনারা। নারী ফুটবল দল দেশে ফেরার পরপরই যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এক কোটি টাকা বোনাস ঘোষণা করেন। এক সপ্তাহের মধ্যেই সেই অর্থ পেয়ে যান ফুটবলাররা।
নারী ফুটবল দলের এই সাফল্যের পরই অ-১৯ ক্রিকেট দল এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন ও অ-২১ হকি দল প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলার কীর্তি অর্জন করে। দুই দলকেই অর্ধ কোটি টাকা পুরস্কার প্রদান করা হয়। গত মাসে বাংলাদেশ নারী দল এশিয়া কাপ ফুটবলের মূল পর্ব নিশ্চিত করে। সেই দলকেও ৫০ লাখ টাকা বোনাস ঘোষণা করেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা।
বিসিবি সভাপতি দুই দফা বদল
দেশের অন্যতম শীর্ষ ক্রীড়া সংগঠন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে দুই দফা বোর্ড সভাপতি বদল হয়েছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে তৎকালীন সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ছিলেন আত্মগোপনে। তিনি সভাপতি থেকে পদত্যাগ করলে ২১ আগস্ট জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদকে পরিচালক মনোনীত করে। পরবর্তীতে বিসিবির পরিচালকারা তাকে সভাপতি নির্বাচিত করেন।
সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ নয় মাসের বেশি স্থায়ী হতে পারেননি। এই সময়ের মধ্যে ফারুকও নানা ঘটনার জন্ম দেন। পরিচালকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফারুক আহমেদকে পরিচালক থেকে অব্যাহতি দিয়ে আরেক সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে পরিচালক মনোনীত করে। বিসিবির পরিচালকরা ফারুকের মতো একই প্রক্রিয়ায় বুলবুলকে সভাপতি নির্বাচিত করেন।
তিন অ্যাসোসিয়েশন একীভূত, মহিলা ক্রীড়া সংস্থা কমিটির অপেক্ষায়
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধিভুক্ত ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সংখ্যা ছিল ৫৫। ফুটবল ও ক্রিকেট বাদে অন্য সকল ক্রীড়া সংগঠনের কমিটি পুনর্গঠন করেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। প্যারা আরচ্যারি, খিউকুশিন কারাতে ও ঘুড়ি তিন এসোসিয়েশনকে আরচ্যারি ফেডারেশন, কারাতে ও কান্ট্রি গেমসের মধ্যে একীভূত করেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। পাঁচ-ছয় দফায় প্রায় সকল ফেডারেশন/এসোসিয়েশনের কমিটি পুর্নগঠন হলেও শুধু বাকি রয়েছে মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। এই সংস্থা এমনিতেই দীর্ঘদিন অ্যাডহক কমিটি দিয়ে চলছিল। এগারো মাস হয়ে গেলেও এই সংস্থার কমিটি প্রকাশ করতে পারেনি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ।
কমিটি নিয়ে ‘বিতর্ক’,‘উষ্মা’
জাতীয় খেলা কাবাডি। সেই কাবাডি ফেডারেশনের কমিটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। বিশেষ করে কাবাডি ফেডারেশনের বিগত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নেওয়াজ সোহাগকে অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক করায় কাবাডি অঙ্গনের কয়েকজন বেশ সমালোচনা করেছেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বিষয়টি তদন্তের উদ্যোগও নিয়েছিল। কাবাডির মতো এত সমালোচনা-আন্দোলন অন্য ফেডারেশনে হয়নি। তবে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে বেশ কয়েকটি কমিটি নিয়ে।
রাষ্ট্রীয় অনেক পদের মতো ক্রীড়াঙ্গনের সংস্থাগুলোতেও রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের দখল ছিল। রাজনৈতিক বৃত্ত ভাঙতে ২১ আগস্ট যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সকল স্থানীয় ক্রীড়া সংস্থার বিদম্যান কমিটি বিলুপ্ত করে। জেলা, বিভাগ ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটি গঠনের একটি নির্দেশনা দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। জেলা-বিভাগীয় পর্যায় থেকে কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও কমিটির কোনো প্রস্তাবনা আসেনি।
আরচ্যারি ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটি নিয়েও জলঘোলা হয়েছে অনেক। আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজিব উদ্দিন আহমেদ চপলকে অ্যাডহক কমিটিরও সম্পাদক করে প্রজ্ঞাপন হয়। সার্চ কমিটির আহ্বায়ক জোবায়েদুর রহমান রানা এ নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেন। তার এই প্রতিবাদে চপলকে সাধারণ সম্পাদক থেকে সদস্য করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। সদস্য থাকা তানভীর আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
একযোগে স্থানীয় কমিটি বিলুপ্ত, ৫ বিভাগ ও ৪ জেলা ক্রীড়া সংস্থায় কমিটি হয়নি
রাষ্ট্রীয় অনেক পদের মতো ক্রীড়াঙ্গনের সংস্থাগুলোতেও রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের দখল ছিল। রাজনৈতিক বৃত্ত ভাঙতে ২১ আগস্ট যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সকল স্থানীয় ক্রীড়া সংস্থার বিদম্যান কমিটি বিলুপ্ত করে। জেলা, বিভাগ ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটি গঠনের একটি নির্দেশনা দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। জেলা-বিভাগীয় পর্যায় থেকে কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও কমিটির কোনো প্রস্তাবনা আসেনি। গণমাধ্যমের রিপোর্ট ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কয়েক দফা তাগিদের প্রেক্ষিতে স্থানীয় পর্যায় থেকে কমিটির নাম আসা শুরু হয়। কমিটির নাম আসার দেখা যায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সেই কমিটির আনুষ্ঠানিক অনুমোদনে বেশ সময়সাপেক্ষ। গতকাল পর্যন্ত ৪ জেলা ও পাঁচ বিভাগে আনুষ্ঠানিক কমিটি হয়নি।
প্রকৃত সংস্কার কবে?
এক বছর পেরিয়ে গেলেও ক্রীড়াঙ্গনে প্রকৃত সংস্কার এখনো হয়নি। শুধু কমিটি বদলের মাধ্যমে মুখ পরিবর্তন হয়েছে। কাঠামোগত কিংবা নীতিমালার সংস্কার হয়নি। ২৯ আগস্ট যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সার্চ কমিটি গঠন করেছিল। সেই কমিটির কার্য পরিধি ছিল বিদ্যমান ফেডারেশনগুলোর গঠনতন্ত্র, ক্রীড়াবিদদের বিদেশে টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের নীতিমালা; নির্বাচনের পদ্ধতি পর্যালোচনা করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ করা। সার্চ কমিটির আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব এটা থাকলেও পরবর্তীতে তাদেরকে অ্যাডহক কমিটি গঠনেই বেশি সময় দিতে হয়েছে। ফলে কাঠামোগত সংস্কার বা নীতিমালা প্রণয়েন পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তাদের পক্ষে প্রদান করা সম্ভব হয়নি।
সংস্কারের জন্য আবারও কমিটি
সরকার বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের জন্য নানা কমিশন গঠন করেছিল। সরকারের কমিশনগুলোর আগেই ক্রীড়াঙ্গনে সার্চ কমিটি করেছিল যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। সার্চ কমিটির কয়েক দফা মেয়াদ বাড়ালেও কাঠামোগত সংস্কার-নীতিমালা যুগপযোগী করার জন্য শেষ পর্যন্ত আরেকটি কমিটি করেছে মন্ত্রণালয়। সেই কমিটির ৩০ কার্যদিবস মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ। তারা আরও ৩০ দিন সময় বৃদ্ধির আবেদন করেছে।
এই কমিটি ইতোমধ্যে কয়েকটি সভা করেছে। সেখানে অপ্রচলিত খেলা, অলিম্পিক ও এশিয়ান গেমসে নেই এমন অনেক খেলার ফেডারেশনের স্বীকৃতি রয়েছে। সেগুলো কিছু একীভূত ও কিছু বাতিল করার পরিকল্পনা চলছে। পাশাপাশি একই পদে এক ব্যক্তির মেয়াদ সংখ্যা, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ক্রীড়াসহ আরও কয়েকটি বিষয় নিয়ে চলছে পর্যালোচনা।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে রদবদল, চাকরিচ্যুতি
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। এই সংস্থাই মূলত ক্রীড়াঙ্গনের সামগ্রিক দেখভালের দায়িত্বে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কয়েক জন কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন। বেশ কয়েকজনের দপ্তর বদল ও বদলির ঘটনা ঘটেছে। আবার দীর্ঘদিন আটকে থাকা পদোন্নতি, শূন্য পদে নিয়োগ না হওয়ার অবসানও হয়েছে।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বিগত অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ফেডারেশনগুলোতে তদারকি করছে। এরপরও দেশের দুই শীর্ষ খেলা ফুটবল,ক্রিকেট জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্দেশনা সেভাবে অনুসরণ করছে না। বিসিবিকে টিকিটের গেট মানির অর্থ প্রদানে একাধিক চিঠি দিলেও সেই অর্থ পায়নি এনএসসি। বাফুফেকে গঠনতন্ত্র সংস্কারের জন্য ফিফার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মতামত দিতে চাইলেও এখনো সেই সুযোগ পায়নি এনএসসি।
ক্রীড়াঙ্গনে কোনো ‘শ্বেতপত্র’ হয়নি
দেশের নানা ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ক্রিকেট বোর্ডের নানা ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অবকাঠামো নির্মাণ-সংস্কার কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রেও ছিল নানা তদবির-অসঙ্গতি। ক্রীড়াঙ্গনে আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে শ্বেতপত্রের দাবি উঠেছিল। সেটা এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। বিসিবির সাবেক সভাপতি ফারুক আহমেদ আর্থিক অনিয়ম খতিয়ে দেখার কথা বলেছিলেন। পরবর্তীতে সেটার ফলাফল আর জানা যায়নি। কাজী সালাউদ্দিনের আমলে আর্থিক অনেক অভিযোগ ছিল। বাফুফের বর্তমান সভাপতি তাবিথ আউয়াল পুরনো বিষয় অনুসন্ধান তো দূরের কথা মন্তব্য করতেও চান না।
এজেড/এফআই