ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব
বিকেএসপি : প্রশিক্ষণে জনপ্রতি দৈনিক ব্যয় হাজারেরও কম
১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু। ৩৮ বছর অতিবাহিত হলেও বিকেএসপি কাঙ্ক্ষিত ‘এক্সিলেন্স ইন স্পোর্টস’ হয়ে উঠতে পারেনি। বিকেএসপির ‘ক্রীড়ায় শ্রেষ্ঠত্ব’ অর্জন করতে না পারার বিষয়ে অনুসন্ধান করেছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া প্রতিবেদক আরাফাত জোবায়ের।
ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে তুলে ধরা হয়েছিল কোচদের ও কোচিংয়ের সংকটের চিত্র। দ্বিতীয় পর্বে উঠে এসেছিল দুই যুগ পার করা ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের বেহাল পরিস্থিতি এবং ক্রীড়াঙ্গনে এর প্রভাব। আজ তৃতীয় পর্বে খুঁজে দেখা হয়েছে বিকেএসপি শিক্ষার্থীদের অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা এবং জাতীয় পর্যায়ে সেরা হয়েও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেভাবে সাফল্য না পাওয়ার নেপথ্য কারণ।
বিজ্ঞাপন
বছরে প্রশিক্ষণে ব্যয় ৪৩ কোটি, জনপ্রতি দৈনিক এক হাজারেরও কম
চলতি অর্থ বছরে বিকেএসপি ৪৩ কোটি টাকা প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ করেছে। প্রায় অর্ধেক টাকা (১৯ কোটি ৫০ লাখ) ব্যয় খাবার বাবদই। কাপড় ধৌতকরণে প্রায় এক কোটি, ক্রীড়া সামগ্রী ক্রয়ে ৪ কোটি, তৃণমূল বাছাই ও ক্যাম্প ৩ কোটি, এ রকম নানা খাত মিলিয়ে বছরে ৪৩ কোটি টাকার মতো ব্যয়। প্রধান ও সকল শাখা মিলিয়ে বিকেএসপিতে প্রায় ১৫০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এতে জনপ্রতি দৈনিক প্রশিক্ষণ ব্যয় এক হাজার টাকার কম করে পড়ছে।
বিকেএসপির সাবেক পরিচালক (প্রশিক্ষণ) ফারুকুল ইসলামের মতে বরাদ্দ অপ্রতুল, ‘বিকেএসপির সামগ্রিক বাজেট বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কারণ এখান থেকে খেলোয়াড়রা উঠে এসে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে। যারা আগামীতে দেশকে অনেক কিছু দেবে তাদের পেছনে ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বেশি হওয়া উচিত।’
বিজ্ঞাপন
চলতি অর্থ বছরে ৪৩ কোটি টাকা প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ হয়। এর প্রায় অর্ধেক টাকা (১৯ কোটি ৫০ লাখ) ব্যয় খাবার বাবদই। কাপড় ধৌতকরণে প্রায় এক কোটি, ক্রীড়া সামগ্রী ক্রয়ে ৪ কোটি এবং এ রকম নানা খাত মিলিয়ে বছরে ৪৩ কোটি টাকার মতো ব্যয়। বিকেএসপিতে প্রায় ১৫০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এতে জনপ্রতি দৈনিক প্রশিক্ষণ ব্যয় এক হাজার টাকার কম করে পড়ছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণে ব্যয় সেই ৩ কোটি
বিকেএসপির খেলোয়াড়রা বছরজুড়ে প্রশিক্ষণ নেয়। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি টুর্নামেন্ট বা প্রতিযোগিতামূলক খেলা প্রয়োজন। দীর্ঘদিন থেকেই দুই কোটি ৮০ লাখ থেকে ৩ কোটিতে ঘুরপাক খাচ্ছে এই বাজেট। ২১ টি খেলার জন্য এই বাজেট খুবই কম। বিশেষ করে ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির মতো দলীয় খেলাগুলোতে। দেশের বাইরে কোনো সফরে গেলে অর্ধ কোটির কাছাকাছি ব্যয় হয়। অন্যদিকে দেশের বাইরে খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ বা টুর্নামেন্টে না পাঠালে প্রকৃত মান বা অবস্থান যাচাই করা সম্ভব হয় না।
নেই পুষ্টিবিদ, সব বয়স ও খেলায় একই খাবার
খাবার ও পুষ্টি খেলোয়াড়দের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাঠের পরিশ্রমের সঙ্গে খাবার ক্যালরির ভারসাম্য থাকতে হয়। বিকেএসপি খেলার বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে খেলোয়াড়দের ভালো মানের খাবার প্রদানের সর্বোচ্চ চেষ্টাই করে। তবে ঘাটতির জায়গায় চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া টেবিল টেনিসের শিক্ষার্থী যা খাচ্ছেন দ্বাদশ শ্রেণীর ক্রিকেটারেরও একই মেন্যু। কিন্তু বয়স ও খেলা ভেদে দু’টি আলাদা হওয়া প্রয়োজন ছিল।
বিকেএসপির সাবেক মহাপরিচালক মোতাহের হোসেন বিকেএসপির শিক্ষার্থীদের পুষ্টিহীনতার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে সিংহভাগের পরিবার নিম্নবিত্ত। ফলে ছোটবেলা থেকেই তাদের অনেকেই পুষ্টিহীনতায় বেড়ে উঠে। বিকেএসপিতে আসার পর আমাদের প্রাধান্য থাকে তাদের পুষ্টিহীনতার পরিমাণ কমিয়ে আনা।’
বিকেএসপিতে হাজারের ওপর শিক্ষার্থী। এদের জন্য বিকেএসপিতে নেই স্থায়ী বা নির্দিষ্ট কোনো পুষ্টিবিদ। তবে বিকেএসপির পরিচালক প্রশিক্ষণ গোলাম মাবুদ জানান, এক বছরের বেশি সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের সহায়তায় খাবারের বিষয়টি তত্ত্বাবধায়ন হচ্ছে।
আবাসন ও বিদ্যুৎ সংকট
বিকেএসপির প্রধান কেন্দ্র সাভার জিরানীতে। শিল্প এলাকা অবস্থিত হওয়ায় বিশেষত গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে প্রচুর। গরমের সময় অনেক রাত নির্ঘুম কাটাতে হয় শিক্ষার্থীদের। এজন্য অনেক দিন সকালে অনুশীলন বাতিলের ঘটনাও ঘটেছে।
বিকেএসপি শুরুর সময় এক রুমে দুই জন করে থাকতেন। পরবর্তীতে খেলোয়াড় সংখ্যা বাড়ার পর এক রুমে চার জন করে থাকেন। আয়তন, খাট ও সাজসজ্জা ঠিক থাকলেও এসির অভাব রয়েছে। গরমের সময় অনুশীলনের পর খেলোয়াড়দের শীতল পরিবেশ দরকার হয়। অনেক সময় এমনও হয়েছে গরমে অনুশীলন করে এসে বিদ্যুৎহীন পরিস্থিতিতে থাকতে হয়েছে।
বিকেএসপির সাবেক খেলোয়াড়দের অনেকের মতে, ‘বর্তমান সময়ে এসি কোনো বিলাসী দ্রব্য না, প্রয়োজনীয়। দিনকে দিন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে খেলোয়াড়দের জন্য এই সুবিধা প্রদান করা উচিত। সবার জন্য না হলেও অন্তত যারা ভালো পারফরম্যান্স করছে বা সম্ভাবনাময় তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।’
কোচদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন
কোচরা অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা যেমন প্রয়োজন তেমনি তাদের মান ও যোগ্যতা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। অনেক কোচই আধুনিক অনুশীলনের সঙ্গে পরিচিত নন। পুরনো কিংবা মান্ধাতার আমলের অনুশীলনে খেলোয়াড়দের তৈরি করেন। এতে সেই খেলায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শীর্ষ পর্যায়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। বিকেএসপির সাবেক শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান এমিলি এই প্রসঙ্গে বলেন,‘খেলোয়াড়দের তৈরি করেন কোচরা। কোচরা নিজেরা যত প্রস্তুত বা তৈরি থাকবেন তত ভালো খেলোয়াড় তৈরি হবে। বিকেএসপির কিছু খেলায় এতে বেশ ঘাটতি রয়েছে।’
কোচদের পরিবর্তন ও বিরাগভাজনে ক্যারিয়ারে প্রভাব
কোচরাই খেলোয়াড় তৈরির কারিগর। আবার অনেক সময় কোচদের হাতেই খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে। বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা প্রায় সবাই শিশু। এদের একেক জনের আচরণ একেক রকম। অনেক সময় কোচরা খেলোয়াড়দের আচরণ কিংবা পারফরম্যান্সে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন সময় জানা গেছে, কোচদের বিরাগভাজনে পরিণত হয়ে অনেক খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার আর সেভাবে এগোতে পারেনি। অনেক সময় কোচরা খেলোয়াড়দের সাথে দুর্ব্যবহারও করে।
বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পর একেক বয়সে একেক কোচের অধীনে শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণ নেন। একেক কোচের একেক রকম সক্ষমতা, যোগ্যতা। কোচদের ভিন্ন রকম মানসিকতা, যোগ্যতার সঙ্গে অল্প বয়সে অনেক শিক্ষার্থী মানিয়ে নিতে পারেন না। ফলে অনেক শিক্ষার্থীর পারফরম্যান্সেও সেটির প্রভাব পড়ে।
রিকভারি টাইম কম
বিকেএসপি খেলা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হলেও এখানে একাডেমিক পড়াশোনাও চলে সমানতালে। বিকেএসপি শিক্ষার্থীদের সকালে ভোরে উঠেই মাঠে ছুটতে হয় সপ্তাহে তিন দিন। সকালে অনুশীলন করে এসে গোসল ও নাস্তা সেরেই ক্লাসে দৌড়াতে হয়। তিন-চার ঘণ্টা ক্লাস করে মধ্যাহ্নভোজ সেরেই আবার মাঠে দৌড়াতে হয়। শনি-বৃহস্পতিবার বিকেলে দুই ঘণ্টা অনুশীলন সবার খেলার জন্য বাধ্যতামূলক। সেই অনুশীলন করে এসে আবার অনেক দিন রাতে শিক্ষকরা অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা করান। ফলে প্রায় সারা দিনই খেলোয়াড়দের দৌড়ের ওপর থাকতে হয়।
বিকেএসপিতে খেলার কোচ ও একাডেমিক শিক্ষকদের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রয়োজন খেলা ও পড়ার ভারসাম্যের জন্যই। অনেক সময় কোচ-শিক্ষকদের ইগো সমস্যার কারণে দুই পক্ষই দুই দিকে এক সঙ্গে চাপ দেন। উভয় দিকের চাপে পিষ্ট হন খেলোয়াড়রা।
আধুনিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির অভাব
আধুনিক যুগে এখন খেলা শুধুই টেকনিক নির্ভর নয়। সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির ওপর অনেক সময় পারফরম্যান্স নির্ভর করে। বিকেএসপির অনেক শিক্ষার্থীরা আধুনিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির অভাব নিয়ে বেড়ে উঠেন। বিকেএসপির সাবেক অ্যাথলেট কোচ বলেন, 'খেলোয়াড়দের সুযোগ-সুবিধার অভাবের মধ্যে সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির অভাব অন্যতম। আমাদের অ্যথেলেটিক্সে যেমন ছিল অন্য খেলাতেও তেমন।'
খেলায় সরঞ্জামের প্রভাব খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) বর্তমান পরিচালক ও বিকেএসপির সাবেক কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিম। তার মতে, 'একটি ভালো বল কিংবা ভালো ব্যাটের মাধ্যমে পারফরম্যান্সে তারতম্য হতে পারে। উঠতি বয়স থেকে ভালো সরঞ্জাম পেলে খেলোয়াড়রা সঠিক আবহে বেড়ে উঠবে।'
পত্রিকা পড়ার সুযোগ সীমিত
খেলার সঙ্গে মিডিয়ার সম্পর্ক ওতপ্রোত। বিকেএসপির শিক্ষার্থীদের মিডিয়ার সঙ্গে সংযোগ কমই থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে দেশের প্রায় সকল দৈনিক পড়ার সুযোগ থাকে। সেখানে বিকেএসপি হোস্টেলগুলোতে মাত্র দুই-তিনটি পত্রিকা থাকে। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ বা প্রতিযোগিতায় বিকেএসপির খেলোয়াড়রা নিয়মিতই অংশগ্রহণ করেন। প্রায় সকল শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় বিকেএসপির খেলোয়াড়দের ছবি ও মন্তব্য প্রকাশিত হয়। এগুলো সব সময় দেখার ও পড়ার সুযোগ হয় না তাদের। সব পত্রিকা না রাখায় অনেক ক্ষেত্রে সিনিয়র খেলোয়াড়দের সাক্ষাৎকার বা ফিচার পড়ে অনুপ্রাণিত বা শিক্ষা নেওয়ার সুযোগও থাকে না বিকেএসপির শিক্ষার্থীদের।
৩৮ বছরে আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়াবিদ কতজন
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যই আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় তৈরি করা। ৩৮ বছরে বিকেএসপি থেকে আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় সংখ্যা অর্ধশতকেরও কম। জাতীয় পর্যায়ে বিকেএসপির অসংখ্য ক্রীড়াবিদ চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে, জাতীয় দলে অংশগ্রহণ করছে কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সফলতা সেই অর্থে নেই। কয়েক বারের দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার বিকেএসপির সাবেক শিক্ষার্থী। সারা বছর প্রশিক্ষণ, ভালো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া খেলোয়াড়রা জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেভাবে সাফল্য পান না।
বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান বিকেএসপির সাবেক শিক্ষার্থী ছিলেন। সাকিবের মতো ক্রিকেটার বা ক্রীড়াবিদ কয়েক প্রজন্মে একজন আসতে পারেন। গত তিন যুগে বিকেএসপির সাবেক শিক্ষার্থীর মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃঢ়ভাবে পথ চলেছেন যারা, তাদের মধ্যে মুশফিকুর রহিম, আব্দুর রাজ্জাক, জাহিদ হাসান এমিলি, মামুনুল ইসলাম, হাসান আল মামুন, মামুনুর রশীদ, রাসেল মাহমুদ জিমি, মামুনুর রহমান চয়ন, ঋতুপর্ণা চাকমা, আঁখি খাতুন, আসিফ হোসেন খান, মাহফুজা খাতুন শিলা, দিয়া সিদ্দিকী, মাহফিজুর রহমান সাগর, সাগর ইসলাম, মারুফা আক্তার ও শারমিন আক্তার সুপ্তাদের বাইরে আর খুব একটা নাম পাওয়া যায় না।
৩৮ বছরে বিকেএসপি থেকে আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় সংখ্যা অর্ধশতকেরও কম। জাতীয় পর্যায়ে বিকেএসপির অসংখ্য ক্রীড়াবিদ চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে, জাতীয় দলে অংশগ্রহণ করছে কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সফলতা সেই অর্থে নেই।
বিকেএসপির সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ মোতাহের হোসেন এই বিষয়ে বলেন, ‘জাতীয় পর্যায়ে সেরা কিংবা প্রথম হয়ে আত্মতুষ্টির কিছু নেই। আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়াবিদ তৈরিই বিকেএসপির লক্ষ্য। এই লক্ষ্য প্রকৃতভাবে বাস্তবায়নে ফেডারেশন ও সরকার সব পক্ষেরই সমান সহযোগিতা প্রয়োজন। বিকেএসপিকে অন্য সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো বিবেচনা করলে হবে না। কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বা বাড়তি কিছু করতে হবে যেমন কোচদের বেতন-নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়গুলো।’
কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ান্টেটি বেশি
১৯৮৬ সালে ফুটবল ও হকি দিয়ে বিকেএসপি যাত্রা শুরু করেছিল। তিন যুগের ব্যবধানে সেই সংখ্যাটা বৃদ্ধি পেয়ে এখন ২১ ডিসিপ্লিন। দিনকে দিন খেলা ও খেলোয়াড়ের সংখ্যা বাড়ছে। সংখ্যাগত বাড়লেও প্রকৃত গুণগত মান সেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বিকেএসপির সাবেক কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলেন, ‘বিকেএসপি থেকে কোয়ালিটি খেলোয়াড়ের প্রত্যাশা ক্রীড়াঙ্গনের। বিকেএসপি প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে কাজ করে। এই সংখ্যাটা অর্ধেক হলে কোয়ালিটি খেলোয়াড় আসত। বেশি সংখ্যক খেলোয়াড় নিয়ে কাজ করলে কোয়ালিটি কমার সম্ভাবনা থাকে। ’ ফারুকুল ইসলামও একমত পোষণ করে বলেন, ‘বিকেএসপির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ান্টেটির প্রাধান্য বেশি পরিলক্ষিত।’
ভর্তিতে ‘অনিয়ম’ ও ‘স্বজনপ্রীতির’ অভিযোগ
অনেকেরই স্বপ্ন থাকে খেলোয়াড় হওয়ার। অভিভাবকও চান সন্তানের আশা পূরণের। বিকেএসপি ভর্তি হওয়া বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। বিশেষ করে ফুটবল, ক্রিকেট ও সাঁতারসহ কয়েকটি ডিসিপ্লিনে আসনের বিপরীতে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি থাকে। ওই খেলাগুলোতে ভর্তির অনুরোধও থাকে সর্বাধিক। বিকেএসপির সাবেক মহাপরিচালক মুনীরুল ইসলাম ভর্তিতে অতীতে স্বজনপ্রীতির বিষয়টি গণমাধ্যমে নিজেই বলেছিলেন। এর মাধ্যমে অনেক কোচিং-প্রশিক্ষণের পরও প্রকৃত মানোন্নয়ন সম্ভব নয় সেটাও জানিয়েছিলেন।
বিকেএসপিতে প্রায়ই নানা মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার অভিযোগ শোনা যায়। বিকেএসপি সংশ্লিষ্টদের তথ্য, সেই সংখ্যাটা খুব সীমিতই এবং যারা এভাবে ভর্তি হন তারা এক পর্যায়ে বাদ পড়ে যান। বিকেএসপির নিয়ম অনুযায়ী দুই বার ‘সি’ গ্রেড পেলে আর থাকতে পারেন না। তদবির ও সুপারিশে ভর্তি হলেও অনেকে আবার এভাবে ঝরে পড়েন।
কর্তা বদলের সঙ্গে কৌশলও বদল
বিকেএসপির প্রধান হিসেবে থাকেন মহাপরিচালক। এই পদে সরকার থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিকেএসপির মহাপরিচালকের মেয়াদ সুনির্দিষ্ট নয়। কেউ তিন বছরের বেশি সময় থেকেছেন, আবার কেউ এক বছরের কম সময়ও। অনেক মহাপরিচালক বিকেএসপি সম্পর্কে বুঝে উঠার আগেই বদলি হয়ে যান, আবার অনেকে যখন বুঝে উঠে কোনো কর্মপরিকল্পনা হাতে নেন ঠিক তখন আসে বদলের নির্দেশ। ৩৮ বছর ধরেই চলছে বিকেএসপির এই রীতি। শুধু বিকেএসপির মহাপরিচালক নয়, গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক প্রশিক্ষণ পদও একই।
বিকেএসপিতে কোনো খেলায় নেই ট্রেইনার। বিষয়টি গুরুত্ব বিবেচনা করে এক মহাপরিচালক ফুটবল, ক্রিকেটে ফিটনেসের জন্য অ্যাথলেটিক্সের কোচদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এতে ইতিবাচক প্রভাব মাত্র শুরু হয়েছিল। মহাপরিচালক বদলের পরই সেই কোচদের ফিরিয়ে আনা হয়। এ রকম নানা ক্ষেত্রে নানা উদাহরণ রয়েছে। মহাপরিচালক, পরিচালক প্রশিক্ষণের বদলিতে বিকেএসপির ওপর প্রভাব পড়ে। বিকেএসপির সাবেক মহাপরিচালক মোতাহের হোসেন এ সম্পর্কে বলেন, ‘এটা অবশ্যই লং টার্ম প্ল্যানিং হওয়া উচিত। এটা লং টার্ম হলেই ভালো, পরিচালক-মহাপরিচালকরা ক্রীড়ানুরাগী হলে আরও ভালো।’
এজেড/এফআই