দ্রুততম মানব ইমরানুর রহমান ইলেকট্রনিক টাইমিংয়ে ২২ বছর আগের রেকর্ড ভেঙেছেন। সেই রেকর্ড ভাঙলেও ইলেকট্রনিক টাইমিংয়ের পদ্ধতিগত বিষয়ে ফেডারেশনের কয়েকজন কর্মকর্তা এবং সাবেক তারকা অ্যাথলেটদের কিছুটা প্রশ্ন ছিল। ভারত থেকে আসা টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞ পঙ্কজ কুমার ভিল্লার সাথে কিছুক্ষণ তর্ক-বিতর্কও হয়েছিল তাদের। শেষ পর্যন্ত পঙ্কজের যুক্তির জয়। 

পঙ্কজ দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘স্টাটারের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে সেন্সরে আসতে হবে। সেই স্টাটারের শব্দ বন্দুক দিয়েই হতে হবে এটা বাধ্যতামূলক নয়। এই পদ্ধতি সম্পূর্ণ সঠিক ও আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন দ্বারা স্বীকৃত ও পরিচালিত ইলেকট্রনিক সিস্টেম।’

এবারের জাতীয় অ্যাথলেটিক্স অন্য আসরগুলোর চেয়ে একটু ভিন্ন। জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে ফটোফিনিশিং পরিচালনার জন্য বিদেশি টেকনিশিয়ান আনা হয়েছে। যা সাম্প্রতিক সময়ে তো নয়-ই, ইতোপূর্বেও হয়নি। নিখুঁত টাইমিংয়ের জন্য ভারতীয় বিশেষজ্ঞ পঙ্কজ কুমার ভাল্লাকে এনেছে অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন।

খেলাধুলা এখন আর শুধু নিছক খেলা ও বিনোদনের মধ্যে নেই। খেলার পেছনে অর্থ,বিনিয়োগ, প্রযুক্তি নানা বিষয়ের সমাহার। খেলার সাথে প্রযুক্তি এমনভাবে মিশেছে প্রযুক্তিহীন খেলার মান ও আকর্ষণ নিয়ে প্রশ্ন অবারিত। বাংলাদেশ ক্রীড়া অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ ও নানা বিষয়ে পিছিয়ে থাকার মতো ক্রীড়া প্রযুক্তিতেও অনেক পিছিয়ে। 

ভারতও তিন যুগ আগে ক্রীড়া প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থানেই ছিল। এখন তারা অনেক উন্নতি করেছে। জাতীয় প্রতিযোগিতায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ভারতের খেলায় প্রযুক্তির এই উৎকর্ষ সাধনে অনেক অবদান পঙ্কজের। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশলে স্নাতক করা এই ব্যক্তির জীবনের ধারণা বদলে দেয় ১৯৮২ সালের দিল্লির এশিয়ান গেমস। তিনি সেই গেমসের টেকনিক্যাল বিভাগে ছিলেন। ঢাকায় এসে সেই গেমসের স্মৃতি মনে করলেন এভাবে, ‘দিল্লি এশিয়ান গেমসে আমি টেকনিক্যাল বিভাগে ছিলাম। দেখলাম সকল ধরনের যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি বিদেশ থেকে আমদানি করা। বিদেশি লোকও অনেক। তখন থেকে আমার ইচ্ছে ছিল ভারতীয়রা ক্রীড়া প্রযুক্তিতে কাজ করবে। এরপর থেকে আমি সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু করি।’

১৯৮২ এশিয়ান গেমস শেষে তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরি করেন কয়েক বছর। এরপর ১৯৯০-৯১ সালের দিকে ক্রীড়া প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি কেনেন যার তৎকালীন বাজারমূল্য ৪০ লাখ রুপি। সেই সময় এত টাকা বিনিয়োগ বেশ ঝুঁকিপূর্ণই ছিল, ‘নব্বই সালে ৪০ লাখ রুপি অনেক অর্থ। আমাকে অনেক শুভাকাঙ্খী সাহায্য করেছে। যার জন্য আমি সেই সময় যন্ত্রপাতি কিনতে পেরেছি।’

মানুষ সনাতনকে আকড়ে ধরতে পছন্দ করে। শুরুর দিকে অ্যাথলেটিক্স, শুটিংয়ে ইলেকট্রনিক টাইমিং, ডিসপ্লে ব্যবহারে অনীহা ছিল। সেই দিনগুলো ভুলে যাননি পঙ্কজ, ‘অ্যাথলেটিক্সে সঠিক টাইমিংয়ের জন্য বিভিন্ন লেনে বিভিন্ন টাইমারকে দাঁড়াতে হয়। এরপরও সঠিক সময় ধরা যায় না। সেই টাইমারদের পেছনে খরচও আছে। আর ইলেকট্রনিক টাইমিংয়ে একজনই যথেষ্ট। এই বিষয়গুলো বোঝাতে অনেক সময় লাগছে। এর সুফল পাওয়ার পর থেকে সবাই আধুনিকায়ন বেছে নিয়েছে।’

১৯৯৪-৯৫ সালে নিজের ক্রীড়া প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেন, ‘১৯৯৪ সালে পুনে জাতীয় গেমসে আমি টেকনিক্যাল সাপোর্ট শুরু করি। এরপর থেকে অ্যাথলেটিক্স, শুটিং, ব্যাডমিন্টন, কাবাডি, রোলার স্কেটিং বিভিন্ন খেলায় আমরা সাপোর্ট দেয়া শুরু করি। ১৯৯৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের টেকনিক্যাল প্রভাইডার হিসেবে কাজ করছি।’

বাংলাদেশে আসার মাধ্যম হিসেবে সেই অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন, ‘লালিত ভাট ভারতের অ্যাথলেটিক্সে বড় কর্মকর্তা। তাকে নানা দেশ থেকে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেয়ার অনুরোধ করে। তাকে যে দেশ থেকে অনুরোধ করে তিনি আমার কথাই বলেন। অনেক দেশে আমি যাই আবার আমার কোম্পানির লোকজনদের পাঠিয়ে দেই। এখন আমার লোকেরা অন্য রাজ্যে ব্যস্ত। তাই বাংলাদেশে আমি নিজেই এসেছি।’ টেকনিক্যাল কাজে পঙ্কজ দুবাই, পাকিস্তান, তাইওয়ান, থাইল্যান্ডসহ নানা দেশে গিয়েছেন।   

১৯৯৫ সালের পর থেকে ভারতের বড় আন্তর্জাতিক গেমস ও প্রতিযোগিতায় পঙ্কজ ও তার কোম্পানি ইনোভেশন্স ইনক জড়িত ছিল। ২০১০ দিল্লি কমনওয়েলথ, ২০১৬ শিলং-গৌহাটি এসএ গেমসের সকল ডিসিপ্লিনের হেড অফ টেকনিক্যাল হিসেবে কাজ করেছেন। দেশ-বিদেশে ক্রীড়া প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা পঙ্কজ এখন অনেকটাই তৃপ্ত, ‘আমার যে স্বপ্ন ছিল ভারত ক্রীড়া প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, সেটা হয়েছে। আমি ক্রিকেট ছাড়া দেশের সকল খেলার সঙ্গেই জড়িত। ক্রিকেটে রাজনীতি ও দুর্নীতি জড়িত। এজন্য আমি সম্পৃক্ত হই না। জীবন বাঁচতে অর্থের প্রয়োজন, তবে এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন সুখ ও শান্তি।’

ক্রীড়া প্রযুক্তির ব্যবসা ও পেশা হিসেবে এখনো চ্যালেঞ্জিং মনে করেন তিনি, ‘এই শিল্প উপমহাদেশে এখনো গড়ে উঠেনি। ধীরে ধীরে উঠছে। তরুণ এই দিকে ঝুঁকতে কিছুটা সময় লাগবে।’ 

বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের প্রতি তার পরামর্শ, ‘প্রযুক্তিহীন খেলা বর্তমান বিশ্বে গ্রহণযোগ্য নয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলতে হলে অবশ্যই প্রযুক্তির সঙ্গে থাকতে হবে।’

এজেড/এটি