ভ্রমণের ব্যবহারিক অর্থ নানান রকম। যেমন প্রাতকালীন ভ্রমণ, বৈকালিন ভ্রমণ, নদীর পারে ভ্রমণ, জ্যোৎস্নার আলোয় ভ্রমণ, ট্রেনে-বাসে-উড়োজাহাজে-জলযানে ভ্রমণ ইত্যাদি। আক্ষরিক অর্থে আমরা যেটা বুঝি ভ্রমণ অর্থ বেড়ানো, ঘোরাঘুরি, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া, অর্থাৎ পর্যটন করা। অন্য অর্থে দেশ ভ্রমণ। এছাড়া ভ্রমণ অর্থ যেটা বুঝি, সেটা হচ্ছে চিত্তবিনোদন, পর্যটন ও অবকাশযাপন।

ভ্রমণ মানুষের জীবনে আনে বৃহত্তের আহ্বান। আনে অজানা সৌন্দর্যের সংবাদ। অচেনার সান্নিধ্যে মানুষ পায় বিস্ময়ের শিহরণ। তাই ভ্রমণ শুধুমাত্র দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিদেশ ভ্রমণও সমানভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে এটাও ঘটনা, মানুষের মধ্যে ভ্রমণের আবশ্যিক দিক নিজের দেশকে জানার, বোঝার, দেখার। নিজের জন্মস্থানের গাঁ-গঞ্জ-শহর-নগর থেকে বেরিয়ে দেশের ও বিদেশের অন্যত্র ভ্রমণের মাধ্যমে জানাটা ভ্রমণের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাছাড়া দিনের পর দিন একই পরিবেশের জীবনযাপন থেকে ক্ষণিকের মুক্তি। একটু বৈচিত্র্যের আস্বাদনের উপলব্ধি যে বৈচিত্র্য আমাদের দেয় অপরিসীম আনন্দ।

এই ভূখণ্ডকে জানার জন্য প্রয়োজন দেশ ‘ভ্রমণ’। ইতিহাস ও ভূগোলের বাইরে অবাধ উন্মুক্ত খোলা আকাশের নিচে জীবন্ত দেশটি দেখে, তার অধিবাসীদের 
প্রত্যক্ষ স্পর্শ লাভ করে, তাদের জীবনধারা সম্পর্কে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি, সেই জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান। হৃদয়ের প্রসারতা ও মনের গতি আনে ‘ভ্রমণ’। তারই প্রেক্ষাপটে বেরিয়ে পড়লাম নেপাল ভ্রমণে। 

নেপাল হচ্ছে ভগবান বুদ্ধের জন্মদেশ। এইজন্য এই দেশকে ইংরেজিতে বলে, Nepal ---the Birth place of Lord Buddha. তাছাড়া তুষারশুভ্র পর্বতমালা, ঘন সবুজ বনানীর উপত্যকা, জীব বৈচিত্র্য আর ঐতিহ্যময় সংস্কৃতিতে ঘেরা দেশ নেপাল। মন্দিরময় শহর কাঠমান্ডু। ৭২৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা গুণ কামদেব কাঠমান্ডু শহরটি গড়ে তোলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, সংস্কৃত ‘কাষ্ঠ-মন্ডপ’ শব্দটি থেকেই কাঠমান্ডু শব্দের উৎপত্তি।

কলকাতা থেকে বিমানে সোজা কাঠমান্ডু। কাঠমান্ডু নেপালের রাজধানী ও জনপ্রিয় শহর। কাঠমান্ডুর হোটেলে রাত্রি নিবাস। ভোরবেলায় মাউন্ট এভারেস্ট দর্শনে বেরিয়ে পড়লাম। ৮৮৪৮ মিটার উচ্চতা। এয়ারপোর্ট থেকে গুণা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট। ডান-দিক ও বা-দিক মিলে দশজন-দশজন মোট কুড়িজন যাত্রী। একজন এয়ারহোস্টেস ও একজন পাইলট। ফ্লাইটটি উঠে গেল মাউন্টেন এভারেস্টের চূড়ায়।

ফ্লাইটের জানালা দিয়ে অপূর্ব দৃশ্য। আগে নানানভাবে মাউন্টেন এভারেস্ট দেখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সেগুলো দেখার মধ্যে ছিল অসম্পূর্ণতা। এবার প্রত্যেকটা
পাহাড়ের চূড়ার দৃশ্য হৃদয়ে লেগে থাকার মতো। প্রতিটা ধাপে ধাপে বোঝাচ্ছিলেন এয়ারহোস্টেস ম্যাডাম। খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য এই প্রথম। হিমালয়ের দৃশ্য দেখে অভিভূত। এত সুন্দর হিমালয়ের রূপ, সেটা ভোরের সকালে অনেকটাই উপলব্ধি করতে পারলাম। বরফের জমাট বাঁধে নাকি নভেম্বরের শেষে এবং ডিসেম্বরে। তখন মাউন্ট এভারেস্টের দৃশ্য আরও মনোমুগ্ধকর!

প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম পশুপতি মন্দিরের উদ্দেশে। শোনা যায়, পশুপতি দেবতা নাকি খুব জাগ্রত। মন্দিরটি বলা চলে কাঠমান্ডু শহরের মধ্যেই। তবে মন্দির থেকে এয়ারপোর্ট কাছে। মূলত প্রভু শিবের মন্দির। এটি একটি হিন্দুদের পবিত্র মন্দির। কথিত আছে, একবার শিব ও পার্বতী হিমালয়ের কোলে অবস্থিত বাগমতী নদীর তীরে ভ্রমণ করতে এসেছিলেন যেটা মৃগস্থলি নামে পরিচিত।

নদী তীরবর্তী উপত্যকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দুজনে হরিণের বেশ ধরে এলাকায় ঘুরে বেড়াতে থাকেন। এখানে ভগবান শংকর মৃগরূপ ধারন করেন। নেপাল মাহাত্ম্যে যেটা বলা হয়েছে সেটা বাংলায় তর্জমা করলে দাড়ায়, এই শ্লেষ্মাত্মক বনক্ষেত্রে আমি ঈশ্বর মৃগরূপ ধারন করে বিচরণ করেছি। সেহেতু ভবিষ্যতে এই বিচরণ ক্ষেত্র পশুপতি নামে বিশ্বমাঝারে পরিচিত হবে। আজ সেই পশুপতি মন্দিরে দূরদূরান্ত থেকে অনেক দর্শনার্থীরা ভিড় করছেন এবং পূজা দিচ্ছেন। একটা হৃদয় ছোঁয়া পরিবেশ! সদর দরজা দিয়ে ঢোকার মুখের বাদিকে জ্বলছে ধুপবাতি ও প্রদীপের প্রজ্বলন। ভেতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। তাই দর্শনার্থীরা মূল ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে ফটো তোলার ইচ্ছা পূরণ করছেন।

তারপর গেলাম পাঠান দরবারে। রাজা প্রতাপ মল্লের সময়ে কাঠমান্ডু দরবার ক্ষেত্র ব্যাপকভাবে নির্মিত হয়। রাজা প্রতাপ মল্ল ছিলেন ধার্মিক ও পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি ছিলেন শিল্পের প্রতি অনুরাগী। এছাড়া তিনি পনেরোটি ভাষা জানতেন। ভাষা জানাটা তার গর্বের জায়গা। প্রতাপ মল্ল স্থাপনা নির্মাণের প্রতিও আগ্রহী ছিলেন, এ কারণে রাজা হিসেবে অভিষেকের পরেই তিনি তার প্রাসাদের সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেন। 

রাজা প্রতাপ তার প্রাসাদ নির্মাণের সময় একটি ছোট প্রবেশ পথ নির্মাণ করেন। প্রবেশ পথের দরজাটি বিভিন্ন কারুকার্যমণ্ডিত ছিল। তাতে বিভিন্ন দেবতার 
প্রতিমা স্থান পেয়েছিল। দরজাটি পরবর্তীতে মোহান চকে স্থানান্তরিত হয়। এর সামনে একটি হনুমানের মূর্তি স্থাপিত হয়, কারণ ভাবা হয়েছিল হনুমান রাজার
সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করবে এবং তার আবাসকে রক্ষা করবে। এই প্রবেশ পথ দিয়ে নাসাই চকে যাওয়া যেত, নাসাই চকে সব ধরনের রাজকীয় অনুষ্ঠান, পরিবেশনা ইত্যাদি হত। এই নাসাই চক দীর্ঘদিন পর্যন্ত রাজকীয় উঠোন ছিল। ধারণা করা হয় এই উঠোনের নিচে অনেক সম্পত্তি ছিল। সেসময় রাজা প্রতাপ ‘সুন্দরী চক’ নামেও একটি উঠোন নির্মাণ করেন। এখানে তিনি প্রস্তরখণ্ডে পনেরোটি ভাষায় লিখিত খণ্ড স্থাপন করেন। রাজা প্রতাপ কেবল তার ঐশ্বর্য প্রকাশের জন্যই এত স্থাপনা নির্মাণ করেননি, তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল দেব-দেবীর প্রতি আরাধনা। তিনি নতুন মন্দির নির্মাণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন, এছাড়া পুরনো অনেক মন্দিরকে সম্প্রসারিত ও সংস্কার করেন। প্রাসাদের পাশেই তিনি একটি কৃষ্ণ মন্দির নির্মাণ করেন ১৬৪৯ সালে, যার নাম ভামসাগোপালা। এই মন্দিরটি তিনি তার দুই স্ত্রীকে উৎসর্গ করেন, একজন রূপমতি এবং অন্যজন রাজামতি। এই দুইজনেই একই বছরে মারা যান।

মূল চককে তিনি সম্পূর্ণরূপে সংস্কার করেন। ১৬৭০ সালে তালেজু মন্দিরের জন্য তিনি বেশ কয়েকটি ধাতুর দরজা নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। ১৬৭৪ সালে রাজা প্রতাপ মল্ল মারা যাওয়ার পরে দরবার ক্ষেত্র উন্নয়নের গুরুত্ব কমে যায়। তার উত্তরাধীকারীগণ ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন এবং সেসময়কার মন্ত্রীগণ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তাদের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর শিল্প ও সংস্কৃতির ওপর গুরুত্ব হ্রাস পায়। রাজার মৃত্যুর পরের এই তিন দশকে সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ধারা ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে। এসময় শহরে অল্প কয়েকটি স্থাপনা নির্মিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থিভেন্দ্র মল্ল নির্মিত দাসাভাতারা মন্দির, যা ভগবান বিষ্ণুকে উৎসর্গ করে নির্মিত। পরবর্তীতে গারুদার একটি বিশালাকার মূর্তি এর সামনে স্থাপিত হয়। এছাড়া পার্থিভেন্দ্র মল্ল তার পরিবারের ছবিসহ একটি স্তম্ভ তালেজু মন্দিরের সামনে নির্মাণ করেন। ১৬৯২ সালে রাজা প্রতাপ মল্লের বিপত্নীক স্ত্রী রাণী রাধিলাসমি ভগবান শিভাকে উৎসর্গ করে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। এটি মাজু দেভাল নামে পরিচিত এবং দরবার ক্ষেত্রের গারুদা মূর্তিটির পাশে অবস্থিত। মন্দিরটি নয়টি প্ল্যাটফর্মের উপর অবস্থিত এবং
এটি দরবারের অন্যতম শীর্ষ স্থাপনা।

এখন শহরের অন্যতম জায়গায় অবস্থিত এই পাঠান দরবার। জনগণের দর্শনের জন্য উন্মুক্ত। তবে দরবারে সংস্কারের কাজ এখনও পুরোদমে চলছে। প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম।

তারপর গেলাম বৌদ্ধনাথ স্তূপে। বৌদ্ধনাথ স্তূপের চোখ দুটি অভিনব। বৌদ্ধনাথ নেপালের কাঠমান্ডুর একটি স্তূপ। কাঠমান্ডুর কেন্দ্র এবং উত্তর-পূর্ব সীমা থেকে প্রায় ১১ কিমি দূরে অবস্থিত। উচ্চতায় ৩৬ মিটার। এই স্তূপের বিশাল মণ্ডালার জন্য এটি নেপালের বৃহত্তম গোলাকার স্তূপগুলির মধ্যে অন্যতম। শোনা যায়, তিব্বত থেকে আসা বড় শরণার্থী জনগোষ্ঠীর আগমনে বৌদ্ধের আশেপাশে ৫০টির বেশি গুম্ফা (তিব্বতীয় বিহার) রয়েছে। স্তূপের আশপাশ দিয়ে বাজারের দ্রব্য সামগ্রী দর্শনার্থীদের নজরকাড়া।

তারপর বুধানীলকণ্ঠ। কাঠমান্ডু থেকে প্রায় দশ কিমি দূরে শিবপুরী পর্বতমালার পাদদেশে ‘বুধানীলকণ্ঠ’। পৃথিবীর বৃহত্তম শায়িত বিষ্ণুমূর্তি। চতুষ্কোণ জলাশয়ের মধ্যে অনন্তশয়নে রয়েছে বিষ্ণুর আঠার ফুট একটি মূর্তি।

একখণ্ড বিশালাকার কালো পাথর কেটে তৈরি। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়, এই ধরনের কালো পাথর কিন্তু নেপালের এই উপত্যকায় পাওয়া যায় না। পুরাতত্ববিদদের মতে, রাজমহল পাহাড় থেকে প্রাপ্ত এই কালো পাথর যেটা ইংরেজিতে ‘Rajmahal schist’ নামে পরিচিত। এখন প্রশ্ন, এই বিরাটাকার পাথর এখানে এল কীভাবে? আর একটিমাত্র পাথরকে খোদাই করে মূর্তি বানালেন কারা? সেখানকার বৃদ্ধ পুজারী মাথা চুলকিয়ে জানালেন, একাদশ শতাব্দীতে এক চাষি চাষ করতে এসে দেখলেন মাটি ফেটে রক্ত বের হচ্ছে! কৌতুহলবশত তিনি ডাকলেন গ্রামবাসীদের। শুরু হলো খোঁড়াখুঁড়ি। আর মাটি
খুঁড়তেই বের হলো আজকের এই বিষ্ণুমূর্তি। ঐতিহাসিকদের মতে, দশম শতাব্দীতে রাজা বিজয়কামদের নেপালে নাগ ও বাসুকি পুজা শুরু করেন। তার আমলে বেশকিছু বিষ্ণুমূর্তি তৈরি হয়েছিল। এটি তার মধ্যে অন্যতম। অনন্তশয্যায় শায়িত বিষ্ণুর নাম ‘বুধানীলকন্ঠ’। আমরা জানি নীলকন্ঠ মানে শিব! সেখানে ভ্রমণ করে আমরা খুব খুশি।

স্বয়ম্ভূনাথ নেপালের প্রাচীনতম ধর্মীয় স্থানগুলির মধ্যে একটি। স্বয়ম্ভূনাথ হলো কাঠমান্ডু শহরের পশ্চিমে কাঠমান্ডু উপত্যকার একটি টিলার চূড়ায় অবস্থিত প্রাচীন ধর্মীয় কমপ্লেক্স। কমপ্লেক্সটিতে একটি স্তূপ, বিভিন্ন মঠ এবং মন্দির রয়েছে, যেগুলো তৈরি হয়েছিল লিচাভি যুগের সময়ে। সাম্প্রতিক সংযোজন
হচ্ছে একটি তিবতি বিহার, জাদুঘর এবং গ্রন্থাগার। কমপ্লেক্সটির দুটি প্রবেশ পথ- একটি দীর্ঘ সিঁড়ি যা সরাসরি মন্দিরের মূল প্লাটফর্মের দিকে গেছে যেটা
পাহাড়ের শীর্ষ থেকে পূর্বদিকে এবং আরেকটা, দক্ষিণ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রবেশ পথে। পাহাড়ের চারিদিকে একটা গাড়ির রাস্তা, সিঁড়ির শীর্ষে পৌঁছানোর দর্শনীয় স্থান ‘বজ্র’। কাঠমান্ডুর শক্তিশালী রাজা প্রতাপ মল্লা, যিনি ১৭তম শতাব্দীতে পূর্ব সিঁড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। স্থানটি বৌদ্ধ ও হিন্দুদের কাছে সম্মানের।

যদিও ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে এই কমপ্লেক্সটির যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এখন স্তূপটিতে দর্শনার্থীদের কাছে খুব জনপ্রিয়।

(২) সকালের প্রাতরাশ সেরে রওনা দিলাম পোখরার উদ্দেশে। অনেকটা রাস্তা। পুরোটাই পাহাড়ি রাস্তা। একেবেকেঁ ঘুরে ঘুরে রাস্তা। রাস্তার ডানদিকে পাহাড় এবং বা-দিকে পাহাড়ের নিচের অংশ। পাহাড়, পর্বত, নদী, গাছ-গাছালি ইত্যাদি নিয়ে পাহাড়ে অপূর্ব প্রাকৃতিক সম্ভার। বা-দিকে কোনো কারণে গাড়ি পড়ে
গেলে উল্টাতে উল্টাতে সোজা পাহাড়ের নিচে। বা-দিকে নিচে তাকালে ভীষণ ভয়!

স্থানীয় এলাকার ড্রাইভার। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাতে খুব দক্ষ। ফলে অনুভব করছিলাম, পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটা খুব কম। তবুও উল্টোদিকের গাড়িকে পাশ দিতে গিয়ে মাঝে মধ্যে ড্রাইভারকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। দুদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চললাম।

পোখরা যাওয়ার পথে মনোকামনা মন্দির। কাঠমান্ডু থেকে ১৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে। প্রথমেই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল, পোখরা ঢোকার আগে মনকামনা মন্দিরে
মনকামনা দেবীর দর্শন। ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে। সেখানে নাকি দুপুরের খাওয়ার আগে ঢুকতে না পারলে বিশাল লাইনের খপ্পরে পড়তে হবে। সেই ক্ষেত্রে রাত্রি অবধারিত। পাহাড়ি রাস্তায়, দিনের বেলায় ভ্রমণ যথেষ্ট নিরাপদ। রাত্রি হলে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানো ঝুঁকিবহুল! আর তাছাড়া পাহাড়ি রাস্তায় রাত্রিতে সফর করাটার ক্ষেত্রে আমাদের তীব্র আপত্তি ছিল। যার জন্য ড্রাইভারের পরামর্শমতো আমরা যতটা সম্ভব সকালের দিকে রওনা দিলাম।

নেপালের গোর্খা জেলায় অবস্থিত মনোকামনা মন্দির। হিন্দু ধর্মের একটি অন্যতম শক্তিপীঠ বলে গণ্য। মনের অভীষ্ট কামনা পূর্ণ করেন, এই অভিমতের
প্রেক্ষিতে অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম। রাম শাহের রাণী স্বয়ং মনোকামনা দেবীর অবতার ছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। দশহরার দিন দেবীর পুজার জন্য প্রচুর
ভক্তসমাগম ঘটে। বড় উৎসব হচ্ছে দুর্গা-অষ্টমীতে। জনশ্রুতি আছে, গোর্খার রাণী মনোকামনার ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। কথিত আছে, একদিন রাম শাহ তার নিজের স্ত্রীকে ভগবতী রূপে এবং তার স্ত্রীর ভক্ত লক্ষণ থাপাকে সিংহ রূপে দর্শন করেন। তারপর হঠাৎ রাম শাহের রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। সেই সময় সমাজ জীবনে সতী-দাহের প্রথা রমরমা। যার জন্য রাম শাহ মারা গেলে তার স্ত্রীকে রাম শাহের সঙ্গে সহমরণে যেতে হয়েছিল। সহমরণে যাওয়ার আগে রাম শাহের স্ত্রী তার ভক্ত লক্ষণ থাপাকে বলে গিয়েছিলেন, তিনি শীঘ্রই ফিরে আসবেন। পরবর্তীতে রাম শাহ ও রাণী মারা যাওয়ার ঠিক ছয় মাস পর একজন কৃষক চাষ করার সময় জমিতে হঠাৎ পাথরখণ্ড পান। সেই পাথরখণ্ড থেকে রক্ত ও দুধের ধারা বইছিল । তাই স্থানীয় মানুষের অনুমান, রাম শাহের স্ত্রী পুনরায় ফিরে এসেছেন। স্পটে ছুটে যান লক্ষণ থাপা।

তারপর লক্ষণ থাপার উদ্যোগে সেই স্থানে শুরু হয় ভগবতী দেবীর পুজা পাঠ। ঐ পবিত্র ভূমি পরবর্তীতে পরিণত হল মন্দির প্রাঙ্গন। শোনা যায়, দুর্গা ও কালির মিশ্ররূপে এখানে তিনি ভগবতী দেবী। ভগবতী দেবীকে শুদ্ধ চিত্তে ও নিষ্ঠার সঙ্গে ভক্তি করলে তার কৃপা মেলে। মনস্কামনা পূর্ণ হয়। আবার অনেকে বলে, ভগবতীদেবী নাকি দুর্গার অবতার। যাই হোক মন্দিরের দেবীকে ভগবতী, বৈষ্ণদেবী, মহেশ্বরী ইত্যাদি নামে অনেকেই ডেকে থাকেন। পুজার সময় আবীর, কেশর বাদাম, ফুল, বেল-তুলসী পাতা, বস্ত্র, নারিকেল, মিষ্টি, পান সুপারী ইত্যাদি দিয়ে ভগবতী দেবীকে তুষ্ঠ করার প্রয়াস আজও অব্যাহত। মন্দিরটি ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তখন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ অনেক নেপালী রুপি খরচ করে সারিয়ে মন্দিরটির বাস্তব রূপ দেন। কাজটি শেষ হতে ২০১৮ সেপ্টেম্বর লেগে গিয়েছিল। মন্দিরটি আবার প্যাগোডা স্টাইলে। ‘মনোকামনা’ অর্থ নিয়ে যেটা জানা যায় – মনো অর্থ অন্তর (heart) আর কামনা অর্থ ইচ্ছা (wish)। মনস্কামনা পূরণের তাগিদে ভগবতী দেবীকে দর্শন করতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে। আমরা গাড়ি থেকে কুরিন্তার স্টেশনে নামলাম। সেখান থেকে কেবল কারে (Cable Car) মনোকামনা মন্দিরে পৌঁছালাম। কুরিন্তার থেকে মনোকামনা মন্দিরের দূরত্ব ২.৮ কিমি। নীচের জায়গা কুরিন্তার থেকে একেবারে উঁচুতে অর্থাৎ মনোকামনা মন্দিরের কাছে পর্যন্ত ১৩০২ মিটার উচ্চতা। কেবল কারে অনধিক ৬জন মানুষ উঠতে পারে। প্রায় ২.৮ কিমি রাস্তা কেবল কারের মাধ্যমে উঠতে সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ মিনিট। ঝুলন্ত কার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পরিষেবা দেয়। কুরিন্তার স্টেশনের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে কেবল কারে ওঠার জন্য লাইন দিলাম।

সেদিন অনেক পর্যটক এক একটা গ্রুপে মনোকামনা মন্দিরে ভগবতী দেবীকে দর্শনে এসেছিলেন। যার জন্য আমাদের সামনে প্রায় ৪০জনের একটি গ্রুপ কেবল কারে ওঠবার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিল। তারা মনোকামনা মন্দিরে উঠে যাওয়ার পর আমরা কেবল কারে বসার সুযোগ পেলাম ।  একটা নতুন অভিজ্ঞতা । কেবল কারের মাধ্যমে পাহাড়ের উপর

দিয়ে মনোকামনা মন্দিরে পৌঁছানো সত্যিই আনন্দের। কেবল কার থেকে মনোকামনা মন্দিরের প্রবেশ দ্বারে নামার পর অনেকটা খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে উঁচু পাহাড়ে উঠতে হয়। বেশ কিছুক্ষণ সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর মন্দির। তারপর মনোকামনা মন্দিরে ঢোকার লাইন দেখে আমরা চমকে উঠলাম। প্রচুর মানুষের সমাগম। বিশাল লম্বা লাইন। লাইনটা উঁচু পাহাড়ের দিকে ক্রমশ বেড়েই চলেছে। লাইনে মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলাপরায়ণতা যথেষ্ট ঠিক আছে। কেননা নিরাপত্তা বেষ্টনী যথেষ্ট টাইট। কিন্তু ভীষণ লম্বা লাইন। সেখানেও গ্রুপের একজন দাঁড়ানো, বাকীদের মন্দিরের আশেপাশে ঘোরাফেরা। পুজো দেওয়া হলে মন্দিরের
পাশে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও ধুপবাতি জ্বালানোর জায়গা। সেখানেও প্রচণ্ড ভিড়।

অনেক সময় লাগল। দেবীকে প্রণাম করার পর আমাদের শান্তি। তারপর মনোকামনা মন্দির থেকে বেরিয়ে দোকানের দ্রব্য সামগ্রী দেখতে দেখতে আবার কেবল কারে কুরিন্তার স্টেশনে নেমে আসা। কাঠমান্ডু থাকা অবস্থায় নাগরকোট ঘুরে বেড়ানোর বিষয়ে দুই-একটি কথা। উল্লেখ থাকে যে, কাঠমান্ডু শহর থেকে ২৮ কিমি দূরত্বে নাগরকোট। শোনা যায় হিমালয়ের মোট ১৩টি পর্বত রেঞ্জের মধ্যে ৮টিই নাগরকোট থেকে দেখা যায়। যদিও সেদিন ছিল মেঘলা আকাশ। যাই হোক নেপালের এই নাগরকোট গ্রামটি ভূমি থেকে ৭২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এখানকার লোকজন ঘুম থেকে উঠলেই আকাশের খণ্ড খণ্ড ভাসমান মেঘগুলো দেখতে পান। এই গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। আদিবাসী মানুষ বেশী। চারিদিকে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভাণ্ডার। পাহাড়ের সরু, উঁচু-নীচু রাস্তা নজরকাড়া। নাগরকোট টাউয়ার থেকে হিমালয় পর্বত দর্শন ভীষণ আনন্দের। চোখ জুড়িয়ে গেল। এখানে ঠাণ্ডাটা বেশী। বিদেশী পর্যটক চোখে পড়ার মতো। নাগরকোট সফরে অপূর্ব প্রাকৃতিক ভাণ্ডার দর্শনে আমরা আপ্লুত।

মনোকামনা মন্দির থেকে ছুটলাম পোখরার দিকে। পোখরা হল নেপালের পশ্চিমাংশে গণ্ডকী অঞ্চলের অন্তর্গত কাস্কী জেলার একটি শহর। পোখরা শহরটি পার্বত্য উপত্যকায় গড়ে উঠেছে। আবার অনেকে বলে, শহরটি পোখরা উপত্যকায় গড়ে উঠেছে। পোখরা উপত্যকার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে শহরটি অবস্থিত। এই উপত্যকা দিয়ে স্বেত গন্ধকি নদী বা সাদা নদী প্রবাহিত হয়েছে। শহরটি সর্বোচ্চ ১৪৭০ মিটার ও সর্বনিম্ন ৮২৭ মিটার উঁচু। শহরটি অন্নপূর্ণা পর্বত শ্রণীর একটা অংশে এবং হিমালয়ের মধ্য এলাকায় অবস্থিত। পোখরা নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর যেটা কিনা কাঠমান্ডু থেকে ২০০ কিমি পশ্চিমে অবস্থিত।  প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর পোখরা শহরকে “নেপালের ভূস্বর্গ” ও “নেপালের রাণী” বলা হয়। মানুষের মধ্যে একটি প্রবাদ প্রচলিত, “তোমার নেপাল দেখা পূর্ণ হবে না, যদি না তুমি পোখরা দেখ”। বাস্তবে এটাই ঘটনা। এত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব কমক্ষেত্রে দেখা যায়। পোখরা থেকে বিশ্বের দীর্ঘতম (১৪০ কিমি) সারিবদ্ধ হিমালয় ও পাহাড়ের সারি দেখা যায়। এইজন্য পোখরাকে “মাউন্টেন ভিউ”এর  শহর বলা হয়। এখান থেকে “অন্নপূর্ণা” ও “মাছের লেজের” মতো দেখতে মচ্ছ পুছরে (৬৯৭৭ মিটার) পর্বতশৃঙ্গ দেখা যায়, যা কিনা বিশ্ববিখ্যাত চারটি পর্বতশৃঙ্গের একটি। পোখরা থেকে মুক্তিনাথ মন্দির ও জ্বালামুখী মন্দির দর্শন করা খুব সহজ। এই মন্দির দর্শনের ক্ষেত্রে আকাশ পরিষ্কার থাকাটা খুব জরুরি। তা ছাড়া এই পোখরাতে রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান।

ফেউয়া লেক (Phewa Lake), অনেকে “ফেওয়া” লেক বলে থাকে। পোখরার সবচেয়ে মূল আকর্ষণ ফেউয়া লেক। ফেউয়া লেক নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক লেকের একটি। দৈর্ঘে ৪ কিমি এবং প্রস্থে ১.৫ কিমি। প্রথমটির নাম “রারা লেক” যা নেপালের পশ্চিম মুগু জেলার দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত। বলা চলে, ফেউয়া লেক পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এবং আদর্শ বিনোদন কেন্দ্র। রঙ বেরঙের নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। দুই ধরনের নৌকা। ফ্যামিলি নৌকা ও ছোট নৌকা। পাহাড়ের গা ঘেঁষে লেক। লেকের মাঝখানে একটি মন্দির, নাম “বারাহি হিন্দু মন্দির”। হিন্দু সম্প্রদায়ের সকলেই নৌকায় পার হয়ে মন্দিরে ঢোকেন। ফেউয়া লেকে নৌকা ভ্রমণ, পর্যটকদের কাছে বিনোদনের অন্যতম অঙ্গ।

আমরা যখন ফেউয়া লেকে পৌঁছালাম তখন বিকেল ৪টে বেজে গেছে। তারপর হঠাৎ বৃষ্টি! সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টিটা চলল। যার জন্য আমরা সন্ধ্যার সময় ঝুঁকি  নিলাম না। লেকে বোটিং করার আগে টিকিট সংগ্রহ করা জরুরি। টিকিট কাউন্টারে টিকিট কাটতে গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তবুও বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। তাই পরেরদিন নৌকা ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই অনুযায়ী পরেরদিন ভোরবেলায় শরণকোটের টাউয়ার থেকে পর্বতের ভিউ ও সূর্য ওঠা দেখে লেকে বোটিংয়ের জন্য ছুটলাম। দুইজনের জন্য ছোট নৌকা। নৌকার মাঝি স্থানীয়। তার মুখে গল্প শুনছিলাম। লেকে অনেক ধরনের মাছ। মাছ ধরার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু মানুষ রয়েছেন। তারা ছাড়া কেউ মাছ ধরতে গেলে পারমিশন লাগে। তা ছাড়া পাহাড় থেকে অনেক ধরনের হিংস্র জন্তু জানোয়ার জল খেতে লেকের ধারে চলে আসে। এমনকি চিতা বাঘও দেখা যায়। অন্য প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মাঝি তাদের কর্ম জীবনের কাহিনী শোনালো। তারা শুধুমাত্র নৌকার বাহক। নৌকার লাইন থাকে। কপাল ভাল থাকলে সারাদিনে তিনটি ট্রিপ পায়। নতুবা দুটিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ন্যুনতম মজুরী যেটা খুব কম। সেই মজুরীতে তাদের সংসার চালানো খুব কঠিন। উপরন্তু গত দুবছর অতি মহামারির কারণে তাদের কাজ বন্ধ ছিল। এবছর নাকি কেবলমাত্র কিছুদিন আগে থেকে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়েছে।  এই এপ্রিল মাসেই নাকি ভ্রমণপিপাসু মানুষ বেশী আসেন। কিন্তু এবছর এখনও পর্যন্ত সেভাবে পর্যটকদের ভিড় বাড়েনি। ফেউয়া লেকের আশপাশ দিয়ে প্রচুর রেস্টুরেন্ট ও হোটেল। বলতে গেলে সবসময় ফেউয়া লেকের পাশ দিয়ে ভ্রমণপিপাসু মানুষদের আনাগোনা বেশী। মোদ্দা কথা, পোখরা ভ্রমণের মূল আকর্ষণ হচ্ছে ফেউয়া লেক।

সামান্য মৃদুমন্দ বাতাসে, খোলা আকাশের নীচে নৌকা ভ্রমণ আমাদের চিত্ত ভরিয়ে দিলো। ঘড়ি ধরে এক ঘন্টা  নৌকা ভ্রমণ। তবে লেকের মাঝখানের মন্দিরে  অবশ্যই নিয়ে যাবে। অনেকে মন্দিরে নেমে পুজা দেন। সব ব্যবস্থা সেখানে রয়েছে। পরিষ্কার আকাশ থাকার জন্য আমাদের নৌকা ভ্রমণ ভীষণ আনন্দময় হয়ে উঠেছিল। নৌকা ভ্রমণ শেষে হোটেলে ছুটলাম।

ভোর পাঁচটায় ড্রাইভারের ডাক। সময় কম। শিগ্‌গির চলুন। শরণকোট (Sarangkot)। শরণকোট নেপালের কাস্কি জেলায় পোখরার নিকট অবস্থিত।  পোখরার পশ্চিমদিকে ৫ কিমি দূরে ও  ১৫৯২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। পোখরার শরণকোট পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে পর্বতমালার অপূর্ব দৃশ্য দর্শন করা যায়। এমনকি শরণকোটের উপর থেকে ফেউয়া লেক পরিষ্কার দেখা যায়। পর্যটকেরা এখানে আসে সূর্য ওঠা দেখতে। টাউয়ার থেকে সূর্য ওঠা দেখা পর্যটকদের কাছে খুব আকর্ষণীয়। পর্বতশৃঙ্গের সূর্যের অন্যদিকে অন্নপূর্ণা ও ফিসটেল। অভূতপূর্ব দৃশ্য। টাউয়ার থেকে পর্বতগুলি ছবির মতো দেখতে। গুরুত্বপূর্ণ দুটি পর্বতের মধ্যে ফিসটেলের উচ্চতা ৬৯৯৭ মিটার এবং অন্নপূর্ণা ৭৫৫৫ মিটার উচ্চতা। অথচ শরণকোট ভিউ পয়েন্টের উচ্চতা অনেক বেশী, ১৫৯২ মিটার। একটা জায়গার পর গাড়ি আর উপরে উঠতে পারে না। তারপর হেঁটে ওঠা। খাড়াই সিঁড়ি। হেঁটে ওঠা পরিশ্রম সাপেক্ষ। জিরিয়ে জিরিয়ে আমাদের উঠতে হয়েছিল। সিঁড়ি গুলি প্রচণ্ড খাড়াই। কয়েকটি সিঁড়ি উঠলে ছেলে-বুড়ো সকলকেই হাঁপিয়ে যেতে হয়। নামার সময় আমরা গণনা করে দেখলাম, মোট ৩৫০টি সিঁড়ির ধাপ। কিন্তু ভিউ পয়েন্টে ওঠার পর অফুরন্ত আনন্দ। আনন্দের ঘনঘটা বোঝানো দুঃসাধ্য। চারিদিকে পাহাড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্য। পূর্বদিকে তখন সূর্যের রক্তিম আভা। পরিষ্কার আকশে ধীরে ধীরে সূর্যের আগমন। মনোরম দৃশ্য আমাদের মন ভরিয়ে দিলো। শরণকোট ভিউ পয়েন্টের টাউয়ারে একজন মাসি লিকার চা বিক্রিতে ব্যস্ত। ঐ সকাল বেলায় অতটা উচ্চতায় বসে ঠাণ্ডার মধ্যে এক কাপ লিকার চা ও দুটি বিস্কুট পাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। একদিকে সূর্য ওঠা এবং অন্যদিকে অন্নপূর্ণা ও ফিসটেলের অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাওয়ায় নেপাল ভ্রমণের সার্থকতা সঠিক অর্থে খুঁজে পাওয়া গেল। তারপর ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নামা। তারপর সোজা ফেউয়া লেক। উদ্দেশ্য বোটিং।

শরণকোট ভিউ পয়েন্ট ও ফেউয়া লেকের বোটিং শেষে  হোটেলে ফিরে স্নান সেরে আবার বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য শান্তি স্তুপা। আনন্দু (Anandu Hill)  পর্বতের উপর তৈরী করা খুব সুন্দর একটি প্যাগোডা। বুদ্ধ ধর্মালম্বীদের জন্য। শান্তি স্তুপা তৈরী হয়েছিল শান্তির প্রতীক হিসাবে। সারা বিশ্বে যে কটা শান্তি স্তুপা, তার মধ্যে দুটি নেপালে। একটি পোখরায় এবং অন্যটি লুম্বিনীতে। পোখরার শান্তি স্তুপা নেপালে বিশ্বের প্রথম শান্তি স্তুপা। এখানে মেডিটেশনের জন্য বহু মানুষ আসেন। পাহাড়ের উপর এই প্যাগোডা থেকে ফেউয়া লেক বা পোখরা শহর সুন্দর দেখা যায়। শান্তি স্তুপার পাশ দিয়ে নানান ধরনের দ্রব্যের বাজার। বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মালম্বী মানুষদের প্রার্থনার সমস্ত রকম উপকরন পাওয়া যায়। আমরা যখন পুরো এলাকাটা ঘুরলাম, সেই সময় মূল গেটটা তখনও খোলেনি। তবে উল্টোদিকের বিল্ডিংয়ের বারান্দা থেকে সমস্তটাই আমরা উপভোগ করতে পারলাম।

শান্তিস্তুপা থেকে বের হয়ে আমরা ঢুকলাম ডেভিস ফলসে (Devi’s Falls) । টিকিট সিস্টেম রয়েছে।  কাস্কি জেলায় পোখরার মধ্যে এই ডেভিস ফলস। মূলত ফেউয়া লেকের জল এই ঝর্ণার উৎস।  টানেল দিয়ে ঝর্ণার জল নেমে আসছে। টানেলটি মোটামুটি ৫০০ ফুট লম্বা। ডেভিস ফলসে  একটি ঘটনা ঘটার পর ফলসটির নাম রাখা হয় ডেভিস ফলস। ১৯৬১ সালের ৩১শে জুলাই এক স্যুইস দম্পতি ফলস দেখতে আসে। তখন ফলসের জলের প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস। ফলসের জলে অতর্কিতে “ডাভি” নামে ঐ স্যুইস মহিলা পড়ে যান এবং জলে ডুবে মারা যান। তাঁর নামে ফলসটির নাম রাখা হয় ডেভিস ফলস। যাই হোক আমরা এপ্রিল মাসের শেষদিকে যাওয়ার দরুন নাকি ফলসে তেমন জলের উচ্ছ্বাস নেই। তারপর ফলস থেকে উপরে উঠে এলাম।   লাগোয়া বাগান। বাগানের মধ্যে একটি বুদ্ধের মুর্তি। সামনে লেখা রয়েছে “Lord Buddha”। একটা জায়গায় বাউন্ডারি ওয়ালে লেখা আছে “Visit Nepal”।  বাগান পার হলে অনেক দোকান। রকমারী জিনিসপত্র সাজিয়ে বসে রয়েছেন। বাঙালি টুরিস্টদের সাথে কথা বলার জন্য দোকানদারেরা অল্প বিস্তর বাংলাও জানেন। সব মিলিয়ে জায়গাটা ভীষণ উপভোগ করলাম।

ডেভিস ফলসের অদূরে এবং উল্টোদিকে গুপ্তেশ্বর মহাদেব গুহা (Gupteshwor Mahadev Cave, Pokhara, Nepal) । তবে এটা একটা গুহা মন্দির। গুহা মন্দিরটি  মহাপ্রভু মহাদেবের প্রতি উৎসর্গীকৃত। গুহায় ঢুকতে গেলে প্রবেশ ফি রয়েছে। টিকিট কেটে গুহার প্রবেশ পথে পৌঁছে দেখলাম,  হিন্দুদের অনেক ধরনের ঠাকুর দেবতাদের নিপুন হাতে ছবি আঁকা রয়েছে। বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে নামার রাস্তা। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই গুহাকে “শিবা লিঙ্গামের” পুরানো ঘর মনে করা হয়।  গুহাটি দুটো ভাগে বিভাজিত। প্রথমটি নীচের দিকে ৪০ মিটার সিঁড়ি বেয়ে হাঁটলেই দেখা যাবে শিব লিঙ্গ। সেখানে মহাদেবের পুজা হচ্ছে। শিব লিঙ্গের ফটো তোলা নিষেধ।  তারপর আনুমানিক ১০০ মিটার বা তারও বেশী নীচের দিকে সিঁড়ি বেয়ে হেঁটে নামলে দেখা যাবে ডেভিস ফলসের কিছু অংশ। নীচে ফলসের জল গড়িয়ে পড়ছে । পুরো সিঁড়িটা পাহাড় কেটে তৈরী । অন্ধকারের মধ্যে কিছু বিজলী বাতি থাকার জন্যে রক্ষে। পাহাড় থেকে চুইয়ে পড়া জলে ভেজা সিঁড়ি বেয়ে হাঁটাটা ঝুঁকিবহুল। তবুও দেখলাম বিদেশীরা ঝটাপট হেঁটে গুহার অন্দরমহলে ঢুকে  যাচ্ছে। একটা জায়গায় পাহাড় কেটে সিঁড়ি তৈরী সম্ভব না হওয়ায় সেখানে লোহার সিঁড়ি লাগানো। অন্ধকারাচ্ছন্ন ভিজে স্যাঁৎস্যাঁতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে আমাদের একটু ভয় ভয় লাগছিল। তবে শারীরিক স্থিতি ও মনের জোর সাংঘাতিক। তার জন্য বুকে অদম্য সাহস রেখে নেমে গেলাম। পাহাড় চুইয়ে জল গড়াচ্ছে। সেই জল মাথায় পড়তে বাধ্য। টুপি থাকায় বাঁচোয়া। মাথা ভেজেনি। গুহার ভিতরের জলপ্রপাত দেখে পুনরায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেও খুব ঝকমারী। একটু অসাবধানতায় বিপদ অনিবার্য। তাই  শঙ্কা মেশানো ভয়ার্ত এক নতুন অভিজ্ঞতা!

এবার ঢুকলাম ইন্টারন্যাশনাল মাউন্টেন মিউজিয়ামে (International Mountain Museum)। এটা নেপালের বিখ্যাত জাদুঘর। জানতে পারলাম এই মাউন্টেন মিউজিয়াম নাকি এডমণ্ড হিলারী ও তেঞ্জিং নোরগের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত। মিউজিয়ামের প্রধান বৈশিষ্ট্য এতে পর্বতারোহনের কলাকৌশল, বিশ্বব্যাপি প্রধান পর্বতমালার তথ্যসমূহ, পর্বতমালার ভৌগলিক অবস্থান, বিশ্বব্যাপি পর্বতারোহীদের ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি, পোশাক-পরিচ্ছদ ও আরোহনের ইতিহাস প্রদর্শন। বিশ্বজুড়ে পর্বত ও পর্বতারোহণ সম্পর্কিত অতীত ও বর্তমান ঘটনাবলীর রেকর্ড। জাদুঘরে তিনটি প্রদর্শনী হল রয়েছে – মহা হিমালয়ের হল, খ্যাতি হল ও বিশ্ব পর্বতমালার হল। তা ছাড়া জাদুঘরের ভিতরে নেপালী জনগণের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ উপস্থাপনের প্রয়াস, বিখ্যাত শিখর, বিখ্যাত পর্বতারোহীদের বর্ণনা, পাহাড়ী মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনধারা, ভূতত্ত্বসহ উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগত ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছে। জাদুঘর ঘুরে আমরা নেপালের মানুষের কিছুটা পোশাক-পরিচ্ছদ, সংস্কৃতি,  উপলব্ধি করতে পারলাম। যেমন মগর জাতি, গুরুং জাতি, শেরপা জাতি, তমাং জাতি, নেবার জাতি, রাই জাতি, রাজবংসী জাতি, তেলি জাতি, ইত্যাদি। তবে শোনা গেলো নেপালে নাকি অনেক জাতির (সম্প্রদায়ের) মানুষের বসবাস এবং তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, সংস্কৃতি, সব আলাদা। যেমন আমাদের দেশে নাগাল্যাণ্ড রাজ্যে, শোনা যায়, ১৮টি জাতির বসবাস এবং তাদের সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। ১৮টি জাতির মানুষ ডিসেম্বরের শেষদিকে একটি জায়গায় মিলিত হয়ে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির উৎসব পালন করেন। নেপালের জাদুঘরে ঘুরে সেই দেশের মানুষের বিভিন্ন জাতির পোশাক-পরিচ্ছদ, সংস্কৃতি সম্বন্ধে একটা ধারণা জন্মালো।

গুরখা মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সাথে সাথে শান্তি রক্ষা মিশনে সাহসী গুরখাদের (নেপালের জাতীয় সৈনিক) বিভিন্ন ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। তা ছাড়া বিশ্ববিখ্যাত গুরখা সৈন্যদের যুদ্ধ জয়ের কাহিনী, পোশাক, ব্যাচ, অস্ত্র, ইত্যাদি মিউজিয়ামের দর্শনীয় সামগ্রী।

(৩) এরপর লুম্বিনী। খুব সকালে হোটেল থেকে বের হলাম। ড্রাইভার যদিও জানিয়েছিল রাস্তা-ঘাটের অবস্থা তেমন ভাল না। আমরা ততটা গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু বাস্তবে  ড্রাইভারের কথাই ঠিক। পোখরান থেকে অনেকটা দূরের পথ লুম্বিনী। পাহাড়ি  রাস্তা। রাস্তা-ঘাটের অবস্থা তথৈবচ। পৌঁছাতে অনেক সময় নিলো। রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানোটাও ভীষণ ঝুঁকির। ভাঙাচোরা রাস্তার জন্য গাড়ির ঝাঁকুনীতে আমরা ক্লান্ত। তবুও লুম্বিনীতে ভগবান বুদ্ধের জন্মস্থান দেখার আনন্দে আমরা বিহ্বল। যার জন্য কষ্টকর জার্ণির শারীরিক ধকলকে গুরুত্ব না দিয়ে হোটেলে ব্যাগ-পত্র রেখে বেরিয়ে পড়লাম ভগবান বুদ্ধের জন্মস্থান দর্শন করতে। আমরা  জানি, সিদ্ধার্থের বুদ্ধ লাভের মধ্যে দিয়েই জগতে বৌদ্ধ ধর্ম  প্রবর্তিত হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষদের কাছে বুদ্ধই ভগবান। বৌদ্ধমতে, সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তি অর্জন, মূল উদ্দেশ্য।

লুম্বিনীর মায়াদেবী মন্দিরের কাছে হোটেল। হোটেল থেকে হাঁটা পথে ভগবান বুদ্ধের জন্মস্থান। জায়গাটা ভারী সুন্দর। দ্রুত গতিতে এলাকার উন্নয়ন হচ্ছে, সেটা কাজ কর্মের গতিধারা দেখলে সহজেই অনুমেয়। আগামীদিনে এলাকাটা পর্যটকদের মনোরঞ্জন করতে যে সমর্থ হবে, সরকারি কাজ কর্ম দেখে সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত।
এখানে উল্লেখ থাকে যে, লুম্বিনী একটা বৌদ্ধ ধর্মীয় তীর্থস্থান যা কিনা নেপালের রূপাদি জেলায় অবস্থিত। এই স্থানেই রাণি মায়াদেবী “সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ”কে জন্ম দান করেন। সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ থেকে ৫৪৩ পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। তিনি গৌতম বুদ্ধ নামে ধর্ম প্রচার করেন। তার জীবনের সাথে জড়িত চারটি স্থান – লুম্বিনী, কুশীনগর, বুদ্ধ গয়া এবং সারনাথ। স্থানগুলি এখন মহাতীর্থ নামে খ্যাত।

লুম্বিনীতে গৌতম বুদ্ধ ২৯ বছর বয়স পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন। এখানে মায়াদেবী মন্দির সহ আরও অনেক মন্দির রয়েছে। লুম্বিনী ইন্টারন্যাশনাল  রিসার্চ ইনস্টিটিউট নামে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশ-বিদেশের মনাস্টারি রয়েছে। এখানেই পবিত্র পুষ্করিণী যেখানে  মাতা মায়াদেবী গৌতম বুদ্ধের জন্মের আগে প্রথাগত স্থান করেছিলেন। আমরা জানি, ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো লুম্বিনীকে ওয়ার্ল্ড হেরিটাজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত করে। শোনা যায়, সম্রাট অশোক তাঁর রাজ্য অভিষেকের বিশ বছরে দ্বিতীয়বার লুম্বিনী আগমন করেন।  সম্রাট অশোক খ্রিষ্টপূর্ব ২৪৯’এ ভগবান বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনীতে সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্মস্থান চিরস্মরণীয় করে রাখতে স্তম্ভ নির্মাণ করেন, যেটা “অশোক-স্তম্ভ” নামে বিশ্বখ্যাত। উল্লেখ থাকে যে, সম্প্রতি আমাদের দেশের (ভারতের) প্রধানমন্ত্রী ১৬ই মে, ২০২২ ঐ অশোক স্তম্ভে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে শ্রদ্ধা জানান। নেপালের প্রধানমন্ত্রী তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন। আজও সন্ধ্যাবেলায় সেখানে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের রেওয়াজ অবিরত। (ছবি দেখলেই বুঝতে পারবেন প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে !)

মায়াদেবী মন্দিরের ঠিক লাগোয়া যে পুষ্করিণী, সেটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভগবান বুদ্ধের  জন্ম কাহিনী। পুষ্করিণীর পাশেই লুম্বিনী গার্ডেন। গৌতম বুদ্ধের জন্ম বৈশাখী পূর্ণিমার দিন লুম্বিনী গার্ডেনে গাছের নীচে। শোনা যায়, গৌতম বুদ্ধের মা গর্ভাবস্থায় সাদা হাতি ও পদ্ম ফুলের স্বপ্ন দেখেন। আরও শোনা যায়, গৌতম বুদ্ধের মা গর্ভাবস্থায় বাবার বাড়ি যাওয়ার পথে লুম্বিনী বাগানে থামেন। জলাশয়ের পাশেই সেই বোধিবৃক্ষগুলি। আগেকার বাড়ি ঘরের নির্মাণের অনেক ধ্বংসাবশেষ এখনও বর্তমান।

হোটেল থেকে বেরিয়ে প্রথমেই পড়ল ওয়ার্লড পিস্‌ প্যাগোডা (World Peace Pagoda)। সামনেটায় অনেক দূর পর্যন্ত জলাশয়। প্যাগোডা থেকে লুম্বিনীর মায়াদেবীর মন্দির সুন্দর দেখা যায়। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম। সুবর্ণভূমি সিরিচোক বুদ্ধ (Suvarnabhumi Sirichoke  Buddha)। এটা থাই মন্দিরে  অবস্থিত। থাইল্যাণ্ডের শিল্প কলা এই বুদ্ধ মূর্তিতে বর্তমান।  অনেকে বলে রয়েল থাই মনাস্টারি। আরও কয়েকটি দেশের মনাস্টারি রয়েছে।
   
বর্তমানে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থানের জন্য বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে ‘লুম্বিনী’ পবিত্র তীর্থক্ষেত্র হিসাবে অন্যতম। যদিও পূর্বে উল্লেখ করেছি তবুও জানাই যে,  বৌদ্ধদের কাছে চারটি মহাতীর্থ- যেমন লুম্বিনী, বুদ্ধগয়া, সারনাথ ও কুশীনগর। মহাতীর্থ হিসাবে লুম্বিনী অন্যতম। বৈশাখী পূর্ণিমার দিন দেশ-বিদেশ থেকে আগত প্রচুর ভক্তের সমাগম ঘটে। মায়াদেবী মন্দিরের  চারিদিকে অনেক বোধিবৃক্ষ। আমরা জানি, যে অশ্বত্থ গাছের নীচে তপস্যা করতে করতে গৌতম বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন সেই গাছের নাম বোধিবৃক্ষ। সূর্যাস্তের সময় সূর্যের রক্তিম আভায় জায়গাটার মাধুর্য অন্যমাত্রা পেলো। মনটাকে শান্ত-স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দিলো। তারপর সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বলে ওঠে। আমরাও প্রদীপ জ্বালালাম। প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের মধ্যেও একটা সুন্দর অনুভূতি। যেগুলো লিখে বোঝানো কঠিন। দূর থেকে ভেসে আসছে, “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি”। বৌদ্ধস্তুতি শুনে মনটা বুদ্ধ ভক্তিতে ভরে উঠল।

দূরে বৌদ্ধস্তুপাকে কেন্দ্র করে রয়েছে চির শান্তির শিখা। শান্তির শিখা থেকে বৌদ্ধস্তুপা বা মঠ পর্যন্ত সোজা জলাশয়। বৌদ্ধ স্তুপাকে অনেকে বৌদ্ধ মঠও বলে। জলাশয়ের দুপাশে ইট দিয়ে বাঁধানো এবং তার পাশ দিয়ে প্রচুর গাছ। শান্তি শিখা থেকে তাকালে অনেক দূরে দেখা যায় বৌদ্ধ-মন্দির বা বৌদ্ধ-মঠ। শান্তির শিখার প্রজ্জ্বলনের কাছে যেসব সিকিউরিটি তাঁদের কাছে জানতে পারলাম, ঐ শান্তির শিখার প্রজ্জ্বলন নাকি কখনই নেভে না। এমনকি ভারী বর্ষায়ও নেভে না। যদিও তাঁর সত্যতা যাচাই হয়নি। শান্তির শিখার প্রজ্জ্বলনের উল্টোদিকে অর্থাৎ বৌদ্ধমন্দিরের সোজা বরাবর লুম্বিনীর মায়া মন্দির। লুম্বিনীর গার্ডেন। ঠাকুর বৌদ্ধের জন্মস্থান। সুতরাং লুম্বিনীর গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান মায়াদেবীর মন্দির থেকে তাকালে বৌদ্ধ-মঠ দেখা যায়। ভারী সুন্দর একটা অনুভূতির পবিত্র স্থান  ! ইদানীং পুরো লুম্বিনী এলাকাটায় সংস্কারের কাজ চলছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে লুম্বিনী এলাকার উন্নয়ন সারা বিশ্বের নজরে পড়বে, আমাদের ধারণা। 

বৌদ্ধ-মঠ ঘুরে দেখলাম। অনেক বড় এলাকা। বেশ কয়েকজন বুদ্ধ-ভক্ত পর্যটক আবার ধ্যানে মগ্ন। খোলামেলা জায়গা। বুদ্ধদেবের মূর্তি যেটা রয়েছে সেটা পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। বৌদ্ধ মঠের সামনে ছোট একটি জলাশয়। জলাশয়টি পদ্ম গাছে ভর্তি। সুন্দর মনোরম দৃশ্য। সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা হোটেল। কেননা পরেরদিন চিতোয়ানের উদ্দেশে যাত্রা শুরু।

লুম্বিনী ছেড়ে রওনা দিলাম চিতোয়ানের  উদ্দেশে। রাস্তার মাঝে সারস্বত ধাম মন্দির। জায়গাটার নাম নাওয়ালপরশী। বড় রাস্তার পাশে। এটা হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের দেব-দেবতা নিয়ে সারস্বত ধাম। ঢুকতে প্রবেশ ফি সিস্টেম। টিকিট কেটে সারস্বত ধামে ঢোকার পর অনেকগুলি মন্দির। তা ছাড়া ভিতরে রয়েছে মহাদেব মন্দির, হিন্দু মিউজিয়াম, বুদ্ধ অষ্ট ধাতু চৈতি (Buddha Astu  Dhatu Chaitya), নির্বানা – বৌদ্ধ মিউজিয়াম (Nirvana – Buddhist Museum), ১০৮টি শিব লিঙ্গ, নবগ্রহ, শ্রীবুধানীলকন্ঠ (Shree Budhanilkantha), যজ্ঞশালা (Yagyashala & Amphitheatre), গুরুকূল। এই ধামের উদ্বোধন হয় ৭ই মার্চ, ২০১৭। উদ্বোধন করেন তদানীন্তনকালের মাননীয় রাষ্ট্রপতি বিদ্যাদেবী ভাণ্ডারী  (Right Honorable President of Nepal, Bidya Devi Bhandari)। এই সারস্বত ধামের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন গুরুদেব, রবি শঙ্কর-জি  (Founder of Art of Living Foundation  Gurudev  Sri Sri Ravi Shankar-Ji)।  প্রতিষ্ঠা করেছেন তদানীন্তনকালের “চৌধুরী গ্রুপ”এর সভাপতি বিনোদ চৌধুরী। তাই সারস্বত ধাম মন্দির  বিনোদ চৌধুরীর ভাষায়, “আধ্যাত্মিক শিক্ষার জন্য শ্রেষ্ঠত্বের জীবন্ত কেন্দ্র” (Living Centre of Excellence for Spiritual Learnings )।

পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখলাম। অপূর্ব নিদর্শন। সারস্বত ধামে মহাদেবের মন্দির বিশেষ আকর্ষণ। ১০৮টি শিব লিঙ্গ। খোলা আকাশের নীচে প্রতিষ্ঠিত। বুদ্ধের মূর্তি দেখলে মনটা ভক্তিতে ভরে যায়। ভারী সুন্দর মনোমুগ্ধকর পবিত্র জায়গা। জিরিয়ে এক কাপ কফির তেষ্টা পেলে তার খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গনে সুন্দর একটি রেস্টুরেন্ট। সেখানে চা-স্নাক্স পাওয়া যায়। আমরা যখন পৌছাঁলাম তখন প্রখর রৌদ্র। সেটা নাকি নেপাল দেশে সবচেয়ে বড় প্রখর রৌদ্রের তাপ। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়,  এত রৌদ্র অথচ কপালে ঘাম নেই। সুতরাং সূর্যের তাপের তাপমাত্রা সহজেই অনুমেয়। কয়েক একর জমি নিয়ে মন্দির। ভক্তদের  থাকার  সুন্দর ব্যবস্থাপনা। ভিতরে সিনেমা দেখার ছোট একটা হল (Cinema Hall)। সেখানে  ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখানো হয়। সম্পূর্ণ বিনা খরচে।  ঐ ফিল্মের মাধ্যমে অনেক কিছু জানা যায়। এছাড়া রয়েছে মিউজিয়াম। অনেক সংগৃহীত ছবি। গোটা এলাকাটা ঘুরে আধ্যাত্মিক একটা উপলব্ধি অনুভব করলাম।

রাস্তার পাশের হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার আমাদের গাড়ি ছুটল চিতোয়ানের (Chitwan) উদ্দেশে। হোটেল বললে ভুল হবে। চিতোয়ানে বিশাল একটি রিসোর্টে উঠলাম। কটেজ টাইপের ঘর। রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুম। খাওয়া-দাওয়ার জায়গা। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। সম্ভবত নারায়ণী নদী। নদীর পারে রিসোর্ট থাকায় আলাদা মাত্রা। থাকা-খাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থাপনা। যেহেতু আমাদের চিতোয়ান পৌঁছাতে বেলা গড়িয়ে গেছে, তাই সেদিন চিতোয়ানের জাতীয় উদ্যান (Chitwan National Park)  ঘোরার পরিকল্পনা বন্ধ রইল। পরিবর্তে পরেরদিন সকালে জঙ্গলে জিপ-সাফারির সিদ্ধান্ত নিলাম। বিকালটা সময় নষ্ট না করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম লোকাল সাইট দর্শনে।

চিতোয়ান পৌঁছে জানা গেলো, চিতোয়ান শব্দের অর্থ “জঙ্গলের হৃদয়” (Heart of the Jungles)। চিতোয়ানে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্যস্থানের মধ্যে অন্যতম চিতোয়ান ন্যাশনাল পার্ক (Chitwan National Park)। চিতোয়ান জাতীয় উদ্যান  ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। নেপালের প্রথম জাতীয় উদ্যান। তা ছাড়া ১৯৮৪ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে ঘোষিত হয়েছে।  নেপালের ৭৭টি জেলার মধ্যে চিতোয়ান জেলাটি বড় ও অন্যতম। চিতোয়ানে নাকি প্রচুর সর্ষের চাষ হয়। ড্রাইভারের মুখে শোনা, এখানকার মাটিতে নাকি সর্ষের ফলন উৎকৃষ্ট। বিশেষ করে নারায়ণী নদীতে বন্যা হলে, আশপাশের এলাকায় প্রচুর পরিমানে  সর্ষের চাষ হয় এবং ফলনও নজরকাড়া।

সন্ধ্যায় থারু কালচারালাল প্রোগ্রাম (Tharu Cultural Programme)। ঐতিহ্যবাহী প্রোগ্রাম। চিতোয়ানের জনসংখ্যার একটি বড় জাতিগোষ্ঠী হচ্ছে থারু সম্প্রদায়ের। তাদের দৈনন্দিন  জীবনযাত্রা, তাদের সংস্কৃতি একটু অন্যরকম। তাই স্থানীয় থারু জাতিগোষ্ঠীর শিল্প, সংস্কৃতি, জীবনযাপনের ধরন, ইত্যাদি তুলে ধরা হয় থারু কালচারাল প্রোগ্রামের মাধ্যমে।  এটাই থারু ড্যান্স নামে পরিচিত। যারা ড্যান্স পরিবেশন করে, তারা তাদের স্থানীয় ড্রেস পরে নৃত্য পরিবেশন করতে আসে। সঙ্গে থাকে ঢোল ও থারু কাঠি বা লাঠি। পুরো নৃত্য অনুষ্ঠানে ঢোল বাজে ও কাঠির সাহায্যে নৃত্যের তাল, লয়ের সমন্বয় ঘটে। অপূর্ব তাদের তাল ভঙ্গিমা। অনেকের মুখে শোনা গেলো, থারু কালচারাল প্রোগ্রামের মাধ্যমে মানুষের ও হিংস্র জন্তু জানোয়ারদের মধ্যে একটা ভারসাম্যের মেলবন্ধন তৈরী হয় (Dance performing has a meaning which shows the harmony between people and the wildlife)।

রত্ননগর, বদ্রেনী, চিতোয়ানের শেষ সীমানা।  চিতোয়ানের শেষ মাথায় পৌঁছে দেখলাম নদী পার হওয়ার ঝুলন্ত ব্রীজ। নদী না বলে বলা ভাল জলাশয়। জলাশয় পার হলেই গভীর বন। বন থেকে হরদম হিংস্র জন্তু জানোয়ার জলাশয়ের কিনারে আসে জল খেতে। তবে চারিদিকে কড়া পাহাড়াদার। ঝুলন্ত ব্রীজ পার হলে পোষা হাতির দল দেখা যায়। কৌতুহলবশত আমরাও ব্রীজ পার হওয়ার উদ্দেশে ব্রীজের উপর দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ চিৎকার! “কেউ ব্রীজ পার হবেন না।“ সিকিউরিটি  সবাইকে ব্রীজের উপর থাকতে নির্দেশ দিলো। ব্রীজ থেকে তাকিয়ে দেখলাম, একদল বুনো  হাতি জল খেতে জলাশয়ে নামলো।  জল খাওয়ার পর তারা চলে যেতেই প্রকাণ্ড একটা গণ্ডারের আবির্ভাব। সে বেচারা জলে নেমে খানিকক্ষণ জলকেলি করে হেলতে-দুলতে জঙ্গলের মধ্যে  ঢুকে গেলো। ব্রীজের উপরের সমস্ত পর্যটক তখন হাতি ও গণ্ডার দেখতে পেয়ে বিষ্ময়ে হতবাক!

তারপর নীচে নেমে ছোট ছোট কটেজে চা খেতে ঢুকলাম। বদ্রেনীর রত্ননগরের চায়ের দোকানগুলি অদ্ভূৎ ধরনের। চা ছাড়াও কোল্ড ড্রিঙ্ক, ডিমের ওমলেট বা অন্যান্য স্নাক্স চাইলেই পাওয়া যায়।  চায়ের সঙ্গে আমরা টা অর্থাৎ বিস্কুট চাইলাম। কিন্তু সেখানে প্যাকেট খোলা সিঙ্গল বিস্কুট পাওয়া কঠিন। বিস্কুটের প্যাকেট কেনার সিস্টেম। কফি কাওয়ার পর আমরা ছুটলাম, থারু ড্যান্স দেখতে। টিকিট কেটে থিয়েটার হলের সামনে অপেক্ষা। তারপর ঠিক সন্ধ্যা আট’টায় অনুষ্ঠান শুরু। তাদের নিজস্ব ড্রেস। জানা গেল পার্ফমেন্সে যোগদানকারী  সকলেই অল্প বয়সের। তা ছাড়া  থারু ড্যান্সে তারা অনেক বেশী পরিপক্ক।

দর্শকে হল ঘর ভর্তি। বেশীর ভাগ দর্শক বিদেশী পর্যটক। হাতে গোনা কয়েকজন ভারতীয় পর্যটক। থারু ড্যান্স চলাকালীন সকল দর্শক চুপচাপ। তবে উৎসাহী পর্যটকেরা মোবাইলে ভিডিও করতে ব্যস্ত। ঢুলির সঙ্গে অন্য বাজনার পরিবেশনও মনোমুগ্ধকর। ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে যখন নাচতে শুরু করলো, তখন দর্শকদের কাছ থেকে প্রচুর হাততালি। সুন্দর তাদের নৃত্য পরিবেশন। তবে নৃত্যের তাল থারু সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভঙ্গিতে। সব শেষে শিল্পীরা দর্শকদের অনুরোধ করলো, তাদের নাচের সঙ্গে সঙ্গ দিতে। কিছু  উৎসাহী পর্যটক তাদের নাচের সাথে তাল মেলালেন। অপূর্ব দৃশ্য। পুরো অনুষ্ঠানটি ভাল লাগল। রিসোর্টে এসে ডিনার সেরে রুমে ঢুকে পড়লাম। থারু সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন দেখে আমরা ভীষণ খুশী।

পরেরদিন সকালে ভোর ছ’টায় ব্রেকফার্স্ট রেডি। তারপর ছুটলাম চিতোয়ান ন্যাশনাল  পার্কে জঙ্গল সাফারির  উদ্দেশে। জিপ সাফারি মোট চার ঘন্টার বেশী সময়ের। নদী এপার-ওপার হওয়া, উদ্যানের মধ্যখানে ক্রোকোডাইল ফ্রিডিং সেন্টারে কিছুক্ষণ ঘোরা, ইত্যাদি নিয়ে মোট পাঁচ ঘন্টার হ্যাপা।  ইতিমধ্যে ন্যাশনাল পার্কে প্রবেশের জন্য সরকারি টিকিট হাতে এসে পৌঁছালো। টিকিট নিয়ে নদী পার  হওয়ার জন্য ঘাটে এসে পৌঁছালাম। উল্লেখ থাকে যে, চিতোয়ান জঙ্গল সাফারিতে পৌঁছানোর শুরুতে একটা দীর্ঘদিনের নদী। সেটা পার হতে হয়। যখন ঘাটে পৌঁছালাম, পূর্বদিকে তখন সূর্য  প্রজ্জ্বলিত। ঘড়িতে অনেকক্ষণ সকাল ৭টা বেজে গেছে। চারিদিকে প্রচুর সিকিউরিটি।

শোনা যায়, চিতোয়ান জাতীয় উদ্যানে প্রায় ৭০০ প্রজাতির অধিক  বন্যপ্রাণ ও গাছপালা দিয়ে বিস্তৃত। যদিও প্রজাপতি মথ, মথ এবং পোকা প্রজাতির সংখ্যা জানা যায়নি। এছাড়া শঙ্খচূড় এবং শিলা পাইথন সহ সাপের অন্যান্য ১৭টি প্রজাতি, তারকা কচ্ছপ এবং গুই সাপ রয়েছে। ১৯৫০’এর  দশকের প্রথম দিকে, নারায়ণী নদীতে ২৩৫টি ঘড়িয়াল ছিল। সংখ্যাটা এখন অনেক কমে গেছে। প্রতি বছর ঐ  নদী থেকে ঘড়িয়ালের ডিম সংগ্রহ করে, ঘড়িয়াল সংরক্ষণ প্রকল্পে ছানাগুলি বড় করা হয়। তবে আরও জানা যায়, ঐজাতীয় ছানা শেষ পর্যন্ত বাঁচে কম। এছাড়া রয়েছে হিংস্র জন্তু জানোয়ার। যেমন বাঘ এমনকি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, গণ্ডার (একটা শিং-যুক্ত গণ্ডারের সংখ্যা বেশী), হাতী, ইত্যাদি। রয়েছে হরিণ, ময়ূর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখী, অন্যান্য জন্তু-জানোয়ার।

নদী পার হওয়ার আগেই সরকারি-স্বীকৃত গাইড এসে হাজির। তিনি ঘনশ্যাম  লামা। তবে লামা নামেই বেশী পরিচিত। দাঁত বের করে হেসে বললো, “জঙ্গল সাফারির গাইড।“  হিংস্র জন্তু জানোয়ারদের থেকে লামা হচ্ছে আমাদের রক্ষাকর্তা। আমাদের কাছ থেকে টিকিট নিয়ে নদীর পারে অপেক্ষা করতে বললো। নদী পার হওয়ার ক্ষেত্রে নাকি নেপালি মিলিটারিদের অনুমতি লাগে। লামা পারমিশন আনতে যাওয়ার ফাঁকে নদীটা ভাল করে এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখছিলাম। অনেক কুমীর নদীর কিনারে শুয়ে রয়েছে। নদীর জলেও বড় বড় মাছ। ঔৎসুক্যদৃষ্টিতে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। লামাই বুঝিয়ে দিলো, ঐ কুমীরগুলি নাকি কোনো ক্ষতি করে না। নদীর জলে তাদের আনাগোনা। মাছগুলি রয়েছে কুমীরের খাদ্য হিসাবে। তাই নদীতে মাছ ধরা নিষেধ।

পার হওয়াটাতেও অভিনবত্ব। নামে ডিঙি নৌকা। কিন্তু তার আকৃতি বা গঠন অন্যরকম। কিছুটা তালের ডোঙার মতো। জানা যায়, একটা গাছের গুঁড়ি মাঝখান থেকে কেটে নৌকা তৈরী। নৌকায় উঠলে শরীরের ভারসাম্য রাখাটা খুব ঝুঁকির। তবে নৌকার মাঝি  ভীষণ সতর্ক। ডিঙির মধ্যখানে ছোট ছোট জল-চৌকি রাখা আছে।  জল-চৌকিতে লাইন দিয়ে বসলে একটা ডিঙি নৌকায় মোটামুটি ৭-৮জন পার হতে পারে। ডিঙি নৌকায় উঠে বসলাম। জলে স্রোত আছে। তবে নদীর জলের গভীরতা খুব কম। একেবারেই ঢেউ ছিল না। নদীর প্রশস্ততা খুব স্বল্প। যার জন্য পার হতে কয়েক মিনিটের ব্যাপার।

নদী পার হওয়ার পর বালি মাটিতে কিছুটা হাঁটা পথ ! তারপর জঙ্গল সাফারি করার জিপ দাঁড়িয়ে। গাইডম্যান লামা সবসময় পিছনে পিছনে। তার হাতে একটা দূরবীন। সে আমাদেরকে নিয়ে জিপে বসালো। ছইবিহীন খোলা জিপ। তবে বসার সুন্দর চেয়ার। শক্তপোক্ত গাড়ি। ছইওয়ালা জিপের চেয়েও মজবুত। জঙ্গল সাফারি  শুরু হল ঠিক সকাল আট’টায়। সকালে  সুন্দর মিষ্টি-মধুর আবহাওয়া। প্রথমেই রাস্তার উপরে ময়ূর দর্শন। পেখম তুলে দণ্ডায়মান। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, জঙ্গলের রাস্তা খুব  ছোট। তবে অতটা জল কাঁদা নেই। রাস্তার দুপাশে নানান প্রজাতির গাছ-গাছালিতে ভর্তি। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা। পুরোটাই অসমতল। জিপ চালাচ্ছে, তবে ভীষণ ধীর গতিতে। ধীর গতি রাখার আরও একটি কারণ, জোরে চালালে গাড়ির শব্দে জন্তু জানোয়ারেরা  ভয়ে পালাবে। তাহলে জিপ সাফারির মজাটাই পাওয়া যাবে না।  জিপ এগোচ্ছে। হঠাৎ জিপ দাঁড়িয়ে গেলো। অদূরে একটি-শিংওয়ালা গণ্ডার দাঁড়িয়ে।  একেবারে কাছে না থাকায় ফটো তুলে আরাম পাওয়া গেলো না। তারপর গণ্ডারটি জলাশয়ের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

হঠাৎ জিপ গাড়িটিতে ব্রেক। যার জন্য ঝাঁকুনির টাল সামলানোর ব্যাপার ছিল। কিন্তু ড্রাইভারের চিৎকারে ব্রেকের ঝাঁকুনির টাল সামলানোর কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। “বাঘ  ! বাদিকে তাকান। বিশাল সাইজের বাঘ !”  লামা ভয়ে ড্রাইভারের চেম্বারে ঢুকে তার আবার চিৎকার, “বাঘ !” আমরা বা-দিকে তাকিয়ে দেখি সত্যিই বাঘ। কিন্তু চিৎকারের কারণেই হোক বা অন্য কারণে হোক, বাঘটি ততক্ষণে ঘনকালো জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করার জন্য  মুখ ঢুকিয়ে দিয়েছে। যার জন্য আমরা বাঘের পুরো শরীরটা দেখতে পেলাম, অথচ বাঘের মুখ দেখতে পেলাম না। আবার জিপ গাড়িটি ধীরগতিতে এগোচ্ছে । তারপর দেখা গেলো, এক দল হরিণ রাস্তা পার হয়ে গেলো। এরপরে আমরা ক্রোকাডাইল ব্রিডিং  সেন্টারে ঢুকলাম । তারপর আবার জিপ সাফারি শুরু । পুরো এলাকাটা ঘুরে দেখলাম। ড্রাইভারের মুখে শুনলাম, বাঘ কাউন্টিং মাঝে মধ্যে সংঘটিত হয়। তবে  প্রকৃত সংখ্যাটা তার জানা নেই। হিংস্র হাতি মাঝে মাঝে খুব উৎপাত করে। জিপ সাফারির ক্ষেত্রে সেই সময় তাদের যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। একটা জিনিস সবচেয়ে ভাল লাগল, জঙ্গলে নেপালি মিলিটারিদের ভীষণ টাইট নিরাপত্তা। রয়েছে মাঝে মাঝে চেকিং সিস্টেম। ফলে  প্রয়োজনে পর্যটকদের জিপ থেকে নামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে  এবং পর্যটকদের ভাল-মন্দের খোঁজ খবর নেয়। আর একটা কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, সেটা হচ্ছে পুরো জঙ্গল সাফারির সময় সুন্দর প্রজাতির ময়ূর পাখনা-মেলা অবস্থায় দেখলাম যেটা অবর্ণনীয়। আর রয়েছে হরিণ। তাদের আচরণ অভিনব। পাশে দাঁড়িয়ে থেকে মনে হচ্ছে পর্যটকদের স্বাগত জানাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছালী। যেমনি ফলের গাছ, তেমনি আগাছা। শোনা গেলো, জঙ্গলের ভিতরের দিকে যেখানে জিপ যেতে পারে না সেইসব দিকে বিশাল বিশাল জলাশয়। ঐসব জলাশয়ে নাকি অনেক হিংস্র প্রজাতির জন্তু জানোয়ারের বসবাস।

তারপর চিতোয়ানে ফিরছি।  জিপ থেকে আমরা নদীর কিনারে নামলাম। আবার নদী পার হওয়ার পালা। নদীর পারে গাড়ি দাঁড়িয়ে। কাঠমান্ডু ফেরার পালা। তাই রিসোর্টে ফিরে দুপুরের লাঞ্চ সারলাম। তারপর আমরা কাঠমান্ডুর উদ্দেশে রওনা দিলাম।

কাঠমান্ডু ফিরতে অনেক রাত্রি। রাস্তার অবস্থা এখানেও তথৈ-ব-চ। যারজন্য পৌঁছাতে রাত্রি! পরেরদিন সকালে কাঠমান্ডুতে কেনাকাটা। মার্কেটিংয়ে বেরিয়ে আমরা যেটা উপলব্ধি করলাম, বেশীর ভাগ দ্রব্যসামগ্রী আমাদের দেশ থেকে নেপালে যায় এমনকি খাবারের দ্রব্যসামগ্রীও। তবুও নেপালীদের নিজস্ব কাপড়  খরিদ করলাম। তামার জিনিসগুলি ভারী সুন্দর। আমার অর্ধাঙ্গিনী কিছু তামার বাসনপত্র কিনে ব্যাগ বোঝাই করে ফেললো। নেপালীদের নিজস্ব ঘরানার অনেককিছু ভীষণ আকর্ষণীয়। কিন্তু কেনাকাটায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যার জন্য ইচ্ছা থাকলেও কেনা থেকে বিরত থাকতে হয়েছে।  কেননা বিমান বন্দরে সেগুলি নিয়ে ভ্রমণ করার অনুমতি না মেলার সম্ভাবনা। কাঠমান্ডু শহরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের নিজস্ব খাবার জেনে নিয়ে সেই খাবার খেয়ে তৃপ্তি পেলাম। সারাদিন এলোপাথারি ঘুরেফিরে সময় কাটালাম। বলা চলে উদ্দেশ্যহীনভাবে। নেপালী ভাষা সম্বন্ধে অনেক কিছু জানলাম। ভাষার প্রয়োগের ক্ষেত্রে হিন্দি-বাংলার মিশ্রণ উপলব্ধি করলাম। তবে নেপালীদের অমায়িক ব্যবহার আমাকে মন ভরিয়ে দিয়েছে। তাঁদের মিষ্টি-মধুর ব্যবহারে আমরা বিহ্বল।  নেপালীদের জন্য আমাদের অনেক অনেক শুভকামনা।

এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী-৭৪১২৩৫ (ভারত)