আমি সারা জীবন গাড়ি চালিয়ে অভ্যস্ত। কিন্তু গত বছর করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ায়, গাড়ি রেখে স্কুটার কিনেছি। তখন স্কুটার চালিয়েই এদিক সেদিক যেতাম। স্কুটারের মত সহজ বাহন হাতে থাকায় টুকটাক ট্যুর দিতেও শুরু করি। অবশ্য ঘুরাঘুরির অভ্যাসটা দীর্ঘদিনের। এরমাঝেই পুরো দেশ ভ্রমণের পোকা মাথায় চাপে। ব্যাস, বন্ধুরা মিলে স্কুটার নিয়ে বেড়িয়ে পরি।’- এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতা ঢাকা পোস্টের কাছে প্রকাশ করেছেন নাদির আহমেদ। সম্প্রতি বন্ধু তানজিলা রিনথীকে সঙ্গে নিয়ে  ১১ দিনে ৬৪ জেলা ঘুরে এসেছেন তিনি। পেশায় এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যবসায়ী হলেও আদতে তিনি একজন ভ্রমণপ্রেমী। আছে রিসোর্ট ব্যবসায়ও।

ঢাকা পোস্ট: সম্প্রতি সারাদেশ ঘুরে এসেছেন। দেশ ঘুরার পরিকল্পনা হুট করেই এলো, নাকি দীর্ঘদিনের?

নাদির আহমেদ: পুরো দেশ ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি ৬৪ জেলা ঘুরার পরিকল্পনা, অনেকটাই হুট হাট করেই নেওয়া। মূলত তানজিলা রিনথী নামের আমার একজন বন্ধু আছে। ও নরোয়েজিয়ান একটি কোম্পানিতে চাকরি করে। তারও স্কুটার আছে। আমরা মাঝে মধ্যেই স্কুটার নিয়ে বেড়িয়ে পরি। একদিন রিনথীই বলল, ‌আমরা তো স্কুটার নিয়ে এদিক সেদিক যাই। তাহলে পুরো দেশ কেন নয়? একথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। এরপর কিভাবে যাবো, কোথায় থাকবো তার একটি রোড ম্যাপ তৈরি করে দু'একদিনের মাথায় বেরিয়ে পরলাম।

ঢাকা পোস্ট: স্কুটারে চড়ে পুরো দেশ! বিষয়টা কঠিন মনে হয়নি?

নাদির আহমেদ: কঠিন তো বটেই। স্কুটার সাধারণত শহুরে এলাকায় চালানোর মতো একটি বাহন। কারণ এর চাকা বেশ ছোট, মাত্র দশ ইঞ্চি। যেখানে একটি বাইকের চাকা ১৭ ইঞ্চি হয়ে থাকে। ফলে এতো ছোট চাকার স্কুটার চালিয়ে সারাদেশ ঘুরার পরিকল্পনা করা নি:সন্দেহে কঠিন একটি সিদ্ধান্ত। অনেকেই আমাদের বলেছেন, স্কুটার চালিয়ে পুরো দেশ ঘুরে বেড়ানো সম্ভব না। তবে আমার বিশ্বাস ও সাহস ছিল। কারণ এর আগেও আমি স্কুটার চালিয়ে ঢাকা থেকে দুই তিনটি জেলায় ভ্রমণ করেছিলাম। তাছাড়া বরাবরই আমি ইতিবাচক চিন্তা করতে পছন্দ করি।

ঢাকা পোস্ট: বলছিলেন, রোড ম্যাপ তৈরি করে ঘুরতে বেড়িয়েছিলেন। এই রোড ম্যাপ সম্পর্কে জানতে চাই

নাদির আহমেদ: হ্যাঁ, এতো লম্বা ভ্রমণ, রোড ম্যাপ ছাড়া বেড়ানো সম্ভব না। তাই ঢাকা থেকে প্রথমে কোন জেলায় যাবো, সেখান থেকে পরের জেলা কোনটা হবে, একদিনে কতগুলো জেলা ভ্রমণ করবো, কোথায় থাকবো, দিনে কত কিলোমিটার স্কুটার চালাবো-সেসবের একটা খসড়া পরিকল্পনা করি। পরিকল্পনা অনুসারে আমাদের ৬৪ জেলা ঘুরতে ১১ দিন সময় লেগেছে।

ঢাকা পোস্ট: ১১ দিনে ৬৪ জেলা ভ্রমণ! মানে প্রতিদিন ৫-৬টি জেলায় যেতে হয়েছে।

নাদির আহমেদ: একদমই তাই। প্রতিদিন ১৪-১৫ ঘণ্টা স্কুটার চালিয়েছি। খুব ভোরে হোটেল থেকে বের হতাম, সারাদিন চালিয়ে রাতে আবার নতুন জেলার নতুন হোটেলে উঠতাম। পুরো ১১ দিন এভাবেই চলতে হয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে ৬৪ জেলা ঘুরতে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার স্কুটি চালাতে হতো। কিন্তু রাস্তা খুঁড়াখুঁড়ির কারণে সেটা বেড়ে গিয়ে সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার হয়েছে। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে, অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর দেখেছি, এই রাস্তা ধরে চলা সম্ভব নয়। তখন ফিরে এসে অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে হয়েছে। 
 
ঢাকা পোস্ট: দীর্ঘ যাত্রা পথে অভিজ্ঞতা ও কসরত তো কম হয়নি। এ ভ্রমণের সার-সংক্ষেপ শুনতে চাই।

নাদির আহমেদ: ১২ মার্চ, ভোর ৬টায় আমি ও তানজিলা রিনথী যাত্রা শুরু করি। প্রথম দিন আমরা ঢাকা, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও রংপুর পর্যন্ত যাই। এদিন প্রায় ৪৪০ কিলোমিটার স্কুটার রাইড করি। রংপুরে আমরা লিটল রংপুর ইন্টারন্যাশনাল, নামের একটি হোটেলে থাকি। এক রাতের জন্য আমাদের থেকে ১২০০ টাকার মতো ভাড়া নিয়েছিল।

পরদিন সকালে বেড়িয়ে যাই নীলফামারীর উদ্দেশ্যে। নীলফামারী হয়ে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, নওগাঁ, রাজশাহী পর্যন্ত যাই। রাতে রাজশাহীর মুক্তরা ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি হোটেলে থাকি। এদিনও প্রায় ৪৩৪ কিলোমিটার স্কুটার চালিয়েছি।

তৃতীয় দিনে রাজশাহী থেকে মাগুরা পর্যন্ত যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। সে অনুযায়ী সকাল ৬টায় স্কুটার নিয়ে বেড়িয়ে যাই। রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ হয়ে মাগুরা পৌঁছি। মাগুরা পৌঁছে হোটেল মাগুরাতে উঠি। রাতটা সেখানেই কাটাই। 

চতুর্থ দিনের মিশন, মাগুরা থেকে খুলনা পর্যন্ত। রোড ম্যাপ অনুসারে এদিনও আমাদের ৪৩০ কিলোমিটারের মতো স্কুটার চালিয়েছি। তাই সকাল সকাল স্কুটার নিয়ে বেড়িয়ে পরি। মাগুরা থেকে প্রথমে যাই রাজবাড়ীতে। সেখান থেকে ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, যশোর, সাতক্ষীরা হয়ে খুলনা। 

খুলনাতে পুষ্প বিলাস রেস্ট হাউজে রাতটা কোন রকমে কাটিয়ে পঞ্চম দিনের মিশন শুরু করি। খুলনা থেকে বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা হয়ে বরিশাল পৌঁছে পঞ্চম দিনের ভ্রমণ শেষ করি। সেখানে হোটেল রোজ ইন্টারন্যাশনালে রাত্রিযাপন করি।

ষষ্ঠ দিনের রোডম্যাপে ছিল বরিশাল থেকে ফেনী পর্যন্ত। সে অনুসারে সকাল সকাল বেড়িয়ে যাই মাদারীপুরের উদ্দেশ্যে। মাদারীপুর থেকে শরীয়তপুর, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী পৌঁছাই। সেখানে হোটেল বেস্ট ইন্টারন্যাশনাল রাত কাটাই।

সপ্তম থেকে ১১তম দিনের রোড ম্যাপ ছিল আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে ফেনী থেকে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে স্কুটার চালানো। পাহাড়ি পথে স্কুটার চালানো ভয়ানক রকমের কঠিন কাজ। তাছাড়া স্কুটারে গিয়ার থাকে না। ফলে চাইলেও আমি ফার্স্ট গিয়ারে চালাতে পারতাম না। সেখানকার রাস্তাগুলো বেশ আঁকাবাঁকা। এরপরও ঠিকঠাক ভাবে ফেনী থেকে বান্দরবান পৌঁছাই। যদিও স্থানীয়রা আমাদের সহযোগিতা করেছেন। সেখানে হোটেল দার্জিলিংয়ে থাকি। 

বান্দরবান থেকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম হয়ে কুমিল্লা পর্যন্ত ছিল অষ্টম দিনের রোড ম্যাপ। এদিনও প্রায় সাড়ে চার’শ কিলোমিটার স্কুটার রাইড করেছি। সেখানে হোটেল ভিক্টোরিয়া আবাসিকে রাতে থাকি। নবম দিনে কুমিল্লা থেকে নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, বি-বাড়িয়া, হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার হয়ে সিলেট যাই। 

দশম ও এগারতম দিনে আমরা বেশ উৎকণ্ঠা ও উদ্দীপনার মধ্যে ছিলাম। ভেতর ভেতর কেমন জানি আনন্দ লাগছিল। এদিন সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যাই। সুনামগঞ্জ থেকে নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর ও ময়মনসিংহ পর্যন্ত যাই। সেখানে ব্র্যাক সেন্টারে রাত্রিযাপন শেষে এগারতম দিনে গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। গাজীপুর থেকে ঢাকা পৌঁছি ২২ মার্চ। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ৬৪ জেলা ভ্রমণ সম্পন্ন হয়।

ঢাকা পোস্ট: ছোট একটি দল। পুরো ৬৪ জেলা ঘুরেছেন। কোন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন কি?

নাদির আহমেদ: দু'একটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তবে পুরো ভ্রমণটাই আমরা উপভোগ করেছি। বিশেষ করে বিভিন্ন জেলার হোটেলগুলো আমাদের ৩০-৪০ শতাংশ ছাড় দিয়েছে। বিভিন্ন জন রাস্তা চেনাতে সহযোগিতা করেছে। আর অসুবিধার কথা বললে, ভাঙা রাস্তার কথা বলতে হবে। প্রায় প্রতিটি জেলাতে ভাঙা রাস্তা আমাদের বেশ ভুগিয়েছে। তাছাড়া ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে একজন মেয়ে থাকায় দু'একটি হোটেলে রুম ভাড়া পেতে কষ্ট হয়েছে।

ঢাকা পোস্ট: নতুন করে যারা পুরো দেশ ভ্রমণ করতে চাইবে, তাদের উদ্দেশ্যে কোন নির্দেশনা রয়েছে?

নাদির আহমেদ: যারাই রাইডিং করে দেশ ভ্রমণ করতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই- ঠিকঠাক পরিকল্পনা করে বেরিয়ে পড়ুন। শুকনো খাবার ও খাবার স্যালাইন সঙ্গে রাখতে হবে। সময় মতো ইঞ্জিনের তেল পাল্টাতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, নিজের বাহন সম্পর্কে ঠিকমত জানাশোনা থাকা।

আরআর/ এএ