আমাদের বাংলাদেশে দুইশ বছর ইউরোপিয়দের উপনিবেশ ছিল। তারও পূর্বে বাণিজ্যিক সূত্রে তাদের আনাগোনা ছিল লক্ষ্যণীয়। সুতরাং ইউরোপিয় সংস্কৃতি যে আমাদের ওপর বেশ প্রভাব ফেলেছে তা বলাই বাহুল্য। তারা আমাদের লুণ্ঠন যেমন করেছে তেমন দিয়েছেও অনেক কিছু। ইংরেজরা ছিল আমাদের রাজা। ফরাসিরা রাজত্ব করতে পারেনি বটে তবে ভালোবেসেছে। আমি একবার চন্দননগরে গিয়েছিলাম যা ছিল ভারতবর্ষে ফরাসিদের উপনিবেশ। তখনও আমি ইউরোপ দেখিনি কিন্তু তার প্রতিচ্ছবি দেখেছিলাম। শতবর্ষীয় ভবনগুলো সত্যই রাজসিক। 

প্রচীন আভিজাত্য গায়ে মেখে সে যেন এক টুকরো ফ্রান্স। মনে হয়েছিল, আমি সপ্তদশ শতকের কোনো শহরে বিচরণ করছি। তাতেই বোঝা যায়, এ দেশটিকে ফরাসিরা ভালোবেসে ছিল নিজেদের মতো করে। 'এ টেল অফ টু সিটিস' এবং 'ওয়ার এন্ড পিস' পড়ে ফরাসিদের নিয়ে আমার ভাবনা বেড়ে গেল। তাদের শিল্পকলা, দর্শন ও বিজ্ঞানচর্চা আমাকে বিমোহিত করল। নেপোলিয়ানে আমি মুগ্ধ হলাম। তার বহু পরে ফরাসিদের দেশ থেকে কাঙ্ক্ষিত নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। সেই আমার প্রথম ইউরোপ যাত্রা। গন্তব্যস্থল ফ্রান্সের লিল শহর যা প্যারিস থেকে দুইশত কিলোমিটার দূরে।

প্যারিসের ‘চার্লস দ্যা গল বিমানবন্দরে যখন অবতরণ করলাম তখনও প্রত্যুষ হয়নি। তবে নেমেই বিভ্রাটে পড়লাম। বেল্টে আমাদের লাগেজ নেই। হায় হায়! এই শীতের দেশে কি হবে এখন, গরম কাপড় ছাড়া! কি আর করা, এয়ারলাইন্স কাউন্টারে অভিযোগ দিলাম। তারা আশ্বস্ত করল দুদিন পরে লাগেজ আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাবে। সম্ভবত ট্রান্সফারের সময় সেগুলো ভুল পথে চলে গেছে। কিন্তু দুদিন পরে কেন? কারণ, খোঁজাখুজিতে সময় তো দিতেই হবে। দ্বিতীয়ত, আগামীকাল এয়ার ফ্রান্স হরতাল করবে। ও বাবা, সাহেবেরাও হরতাল করে নাকি!

লিল যেতে আমাদের ট্রেনে চড়তে হবে। ইউরোপে বিমানবন্দর সংলগ্ন রেলস্টেশন খুব স্বাভাবিক দৃশ্য। ভ্রমণের জন্য তারা রেলকে খুব পছন্দ করে। বিমানের টিকিটের সাথে রেলের ই-টিকিট সংযুক্ত ছিল। তবু মূল টিকিট সংগ্রহ করতে হলো। ইতোমধ্যে সকাল হয়ে গেছে। সেন্ট্রাল হিটিং থেকে বেরিয়ে খোলা প্লাটফর্মে কনকনে শীতের মধ্যে পড়লাম। আমার হ্যান্ডব্যাগে মামুলি কিছু গরম কাপড় ছিল। সেগুলো গায়ে চাপালাম। কিন্তু সফরসঙ্গীনির অবস্থা খারাপ। তার শরীরে বাংলাদেশি পোশাক। বেচারি ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে। সময়টা অক্টোবর মাস। প্যারিসে সকালের তাপমাত্রা পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। আমার সঙ্গে একটি গরম শাল ছিল; সেটি তাকে দিতে চাইলাম। কিন্তু সে নিল না। কারণ এখানে তা খুব বেমানান। সাদা মানুষেরা চাদর গায়ে দেয় না। কিন্তু একজোড়া দস্তানা সে সানন্দে গ্রহণ করল।

বিরাট বিরাট ই-বোর্ডে ট্রেনের তথ্য প্রদর্শিত হচ্ছে। আমাদের বাহন ভাগ্যিস কয়েক মিনিট বিলম্বে চলছে। আর একটু হলেই ট্রেনটা মিস হতো এবং আমরা আরও সমস্যায় পড়তাম। হুড়মুড় করে ট্রেন চলে এল। সামনে যে কামরা পেলাম তাতেই উঠে পড়লাম, যদিও টিকিট অনুযায়ী কামরা নির্ধারিত ছিল। সেন্ট্রাল হিটিং এর মধ্যে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যাত্রী সংখ্যা হালকা। বসার অনেক জায়গা।

দুরন্ত গতিতে চলছে বুলেট ট্রেন। জানালায় ঝাপসা কুয়াশার মাঝে উঁকি দিচ্ছে উইন্ডমিল, বর্ণিল বৃক্ষরাজি এবং নয়নাভিরাম শস্যক্ষেত। হ্যাঁ, প্রত্যাশিত ইউরোপই বটে। টিকিট বাবু এলেন ঢিমেতালে। তার কাছে জানলাম লিল ওয়ান স্টপ জার্নি। দুইশ কিলোমিটার পাড়ি দিতে এক ঘণ্টা সময় নিবে। লিলে নেমে উম্মুক্ত প্লাটফর্মে আবার তীব্র শীতের মধ্যে পড়লাম। এসকেলেটর বেয়ে স্টেশনের প্রধান লবিতে উঠলাম। ইলেকট্রিক হিটারের পিলারে শরীর কিছুটা তাতানো যায় । অনুসন্ধান ডেস্কে খোঁজ করলাম আমাদের হোটেলের অবস্থান। কেউ বলতে পারল না। সাদা ড্রেস পরা সুন্দরী মেয়েটি ম্যাপ নিয়ে ছুটাছুটি করল বটে, কিন্তু বৃথা সে প্রয়াস।

চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম। এটাই প্রধান ফটক। ইউরোপের রেলস্টেশনগুলো এক একটি গোলক ধাঁধা। এক দুই তিন তলাগুলি তালগোল পাকিয়ে দেয়। রাস্তার ওপারে একটি বড় ইমারত। তার সমগ্র দেহে চিত্রকর্ম, জানান দিচ্ছে দেশটি ফ্রান্স, শিল্পীদের দেশ। রোদ উঠেছে, স্বস্তির রোদ।
কেউ একজন সেখানে যেতে বলল। সৌখিন দাড়িওয়ালা এক তরুণ খুব চেষ্টা করল কিন্তু বৃথা সে রোদন। অধিকাংশ ফরাসি ইংরেজি ভালো বোঝে না। সুতরাং, ভাষা এখানে যোগাযোগের সমস্যা বটে। 

আমরা চরকির মতো কিছুক্ষণ ঘুরলাম । অবশেষে, প্রবেশ দ্বারের কাছেই দেখি কয়েকটি টেক্সিক্যাব দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় বুদ্ধি এল, ওরা চিনতেও পারে! একজনকে দেখালাম হোটেলের কাগজ। আমার ধারণা ঠিক। ড্রাইভার সহজেই চিনলো । অথচ কতই না তকলিফ হয়েছে। বাক্যব্যয় না করে ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম।

হোটেল 'মিস্টার বেড লিল' শহরের একটি ব্যস্ততম চত্বরে অবস্থিত। সেখানে ট্রাক্সিক্যাবের প্রবেশ নিষেধ। সুতরাং আমাদের একটু আগেই নামতে হলো। দুজন বাদামি মানুষ ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটছে কিন্তু তাতে কারও উৎসুক্য নেই। ভদ্র জাতি এরা, কারও বিরক্তি উৎপন্ন করে না। নরম রোদ ছেড়ে আমরা হোটেলে চেক ইন করলাম। বিকালে উঁচু দামে গরম কাপড় কিনলাম। হোটেলের খুব কাছেই দোকানগুলো, একই স্কয়ারে। লিলে আমার দুটো এ্যাসাইনমেন্ট। প্রথমটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক সভায় অংশগ্রহণ, দ্বিতীয়টি আরেক বিখ্যাত সংস্থা দি ইউনিয়নের গ্লোবাল সম্মেলনে যোগদান। একই ভেন্যু। লিল গাঁপ্যালে বিশাল কনভেনশন সেন্টার কিন্তু যথারীতি প্রাচীন স্থাপনা।

চতুর্থ তলায় একটি কনফারেন্স রুম ভাড়া নেওয়া হয়েছে। লাল রঙ-এর ঢালাও মেঝে। বারান্দা ও জানালাগুলো শীত নিরোধক কাচে পুরো ঘেরা। বাইরে ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন দৃশ্যপট। বাতাসে ধুলো নেই। ভূমধ্যসাগর থেকে উড়ে আসা মেঘ থেকে প্রায় হালকা বৃষ্টি হয় যা ধুয়ে ফেলে বাতাসের ধুলো। নিচে চকচকে প্রশস্ত রাস্তা, মাঝে আইল্যান্ড বরাবর গাছের দীর্ঘসারি। গাছগুলো সব একই মাপের, নিয়মিত পরিচর্যায়। তাদের ডালে ডালে হলুদ পাতার বাহার। দূর থেকে দেখায় যেন দীর্ঘ লাইনে বন্দি হলুদ আগুন। বৃক্ষরাজির তলায় ঝরা পাতার ভিড়, কেউ তাদের বিরক্ত করে না। যখন অনেক জমে যায় তখন মালিরা খুব সকালে এসে নিপুণ হাতে তাদের পরিচর্যা করে।

জ্যাকেট পরেই মিটিং এ যোগ দিলাম। সেজন্য মাফ চাইলাম জানিয়ে যে আমাদের ল্যাগেজ পথ ভুলে চলে গেছে দুবাই, প্লেন পরিবর্তনকালে। ভেন্যুর কাছেই আমাদের হোটেল, আধা ঘণ্টার হাঁটা রাস্তা। সুতরাং হেঁটে ফিরলাম সদলবলে। বলাবাহুল্য আফরো-এশিয়ান একদল মানুষ এখন একই হোটেলের বাসিন্দা।


মন্ডল ভারতীয় বাঙালি। সেও মিটিং এ এসেছে এবং আমাদের হোটেলে উঠেছে। তার আদি নিবাস খুলনা। আমরা একসাথে নিকটস্থ একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খাই। সেখানে ডালভাত পাওয়া যায়। নামে ইন্ডিয়ান কিন্তু চালায় পাকিস্তানিরা। বিষয়টি অদ্ভুত হলেও ব্যবসার জন্য দরকারি। কারণ ইউরোপে ইন্ডিয়ান কুজিন মানে স্পাইসি ফুড। তাই ডিনার করতে অনেক ফরাসি এখানে আসে। মন্ডলের সাথে ডাল-ভাত খেতে খেতে জমিয়ে বাঙলায় গল্প করি। রেস্টুরেন্টের মালিক পাঞ্জাবি। সে সামান্য আপত্তি করে। উর্দুতে বলে, 'ও বাঙালি ভাই, দয়া করে জোরে কথা বলবেন না। ফরাসিরা হট্টগোল পছন্দ করে না। ওরা আমার দোকান থেকে ভেগে যাবে।'

কথাটি সত্যি। রাস্তাঘাট, দোকানপাট কোথাও তাদের উঁচুস্বরে কথা বলতে দেখিনা। তবে আমেরিকানরা তা থোড়াই পরোয়া করে। একদল আমেরিকান টুরিস্ট উঠেছে আমাদের হোটেলে। তারা মাঝরাত পর্যন্ত সামনের চত্বরে হৈ চৈ করে। বেড়াতে এসে চুপচাপ সময় কাটানোর পাত্র নয় তারা। কেউ অবশ্য বাধা দেয় না। ফরাসিরা সত্যি ভদ্র জাতি। সু-সংস্কৃতি তাদের চিন্তা চেতনায়, আচার ব্যবহারে।

লিল গ্রাপ্যালে দূরে নয়। আমরা হেঁটেই যাতায়াত করি। ট্যাক্সি ব্যয়বহুল। ট্রাম বেশ ঘুরে যায়। আর একটি যানবাহন অবশ্য আছে, সাইকেল। সারিসারি লাল সাইকেল সাজানো আছে যেখানে সেখানে। মেশিনে এক ইউরো দিলে লক খুলে যাবে। সারাদিন ব্যবহার করে যে কোনো স্ট্যান্ডে রেখে দিলেই হলো। সমস্যা নেই, এখানে কেউ সাইকেল চুরি করে না। হেঁটে যেতেই আমরা পছন্দ করি যদিও পিঠে ল্যাপটপ টানতে কষ্ট হয় বৈকি ।

রাস্তাটি চেনা হয়ে গেছে। ঝকঝকে ফুটপাত, তকতকে দোকানপাট পেরিয়ে একরাশ বৃক্ষরাজির মধ্যে দিয়ে যেতে ভালোই লাগে। বাড়ির বেলকুনিতে ঝুলন্ত ফুলের টব, নিরাপদ রাজপথে অল্প মটরগাড়ি নিয়মিত দৃশ্য। এখানে জনসংখ্যা যেমন হালকা, তেমনই যান্ত্রিক যানবাহন। সুতরাং ঝরাপাতা মাড়িয়ে ভেন্যুতে উপস্থিত হই সহজেই। বলতে ভুলে গেছি, ইতোমধ্যে আমরা হারানো লাগেজ পেয়ে গেছি। কুরিয়ারের গাড়ি হোটেল রিসেপশনে সেগুলো পৌঁছে দিয়েছে।

ফেরার পথে বাড়িতে কথা বলি। তাতে সময়ের সমন্বয় হয়। অর্থাৎ আমি যদি বিকেল চারটায় রিসিভার তুলি, আমার স্ত্রী রাত দশটায় তা রিসিভ করবে। এখানে যত্রতত্র টেলিফোন বুথ, কয়েন পুশ করে কথা বলবেন। আট ইউরো দিয়ে কলিং কার্ড কিনেছি। মূল নাম্বার ও কান্ট্রিকোডের পূর্বে সেই সংখ্যা ডায়াল করে খুব সস্তায় বাংলাদেশের সাথে কথা বলা যায় ।

লিল খুব বিশাল শহর নয়। কিন্তু পরিচ্ছন্ন, নির্মল ও দৃষ্টি নন্দন। দুটো রেল স্টেশন আছে। ছোটটির নাম 'গ্যারে লিল ফ্লানডারস'। এটাই পুরাতন। তাই আর দশটা রেলস্টেশনের মতো কিছু দোকানপাট গজিয়েছে যেমন ম্যাকডোনাল্ডসের খাবার দোকান বা মানিচেঞ্জার স্টল; আমাদের আসা-যাওয়ার রাস্তায় পড়ে। চারটি রেলট্রাক, তিনটি প্লাটফর্ম এবং প্রশস্ত লবিসহ রেলস্টেশনটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে আমাদের কাছে। সেখানে আমরা প্রায় ঢুকি কেনাকাটা বা ডলার ভাঙ্গানোর জন্য। ডলারের দাম এখানে অপেক্ষাকৃত ভালো।

প্রথম পর্বের সভাটি আজ শেষ হলো। এবার শুরু হবে বড় সম্মেলন। বাংলাদেশ থেকে ই-মেইল পাচ্ছি। আরও ডেলিগেট আসছে। অগ্রবর্তী দল হিসেবে আমাদের সাপোর্ট আশা করে তারা; বিদেশ বিভুঁয়ে তা খুব জরুরি। লিলের প্রধান রেলস্টেশনটি বেশ বড়সড়। তার পেছনের চতুরে রয়েছে একটি অনুপম শিল্পকলা। অনেকেই একে লিলের ব্রান্ড বলে- ফুল, ফল ও পাতাসহ বিশাল একটি রঙিন অর্কিড।

আজ ঢাকা থেকে কয়েকজন আসছেন। তাদের পথ প্রদর্শনের জন্য আমরা স্টেশনে এসেছি, বেশ সকালবেলাতেই। নবাগতদের জন্য এসেই গোলক ধাঁধায় পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। আমরা নিজেরাই তার প্রমাণ। সুতরাং, স্বদেশিদের সাহায্য করা উচিত মনে করেছি। লিল গ্রাপ্যালে আজ দারুণ সেজেছে। উদ্বোধনী দিন বলে কথা। ফেস্টুন, ব্যানার এবং বড় বড় পেইন্টিং দিয়ে সাজানো হয়েছে রিসেপশন। বিশাল লবিতে ডেলিগেটরা কুশল বিনিময় করছেন পরিচিতের সাথে। রেজিস্ট্রেশন ডেস্কের সামনে লাইন দিয়েছেন অনেকে। নিরাপত্তা কর্মীরা সক্রিয়। গোটা কনভেনশন সেন্টারটি ভাড়া করেছে ইউনিয়ন। বছরে একবার পৃথিবীর বিভিন্ন ভেন্যুতে তারা বড় মাপের এই আয়োজনটি করে থাকে। চমৎকার কাজ। বিরাট মিলন মেলা, একটি মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে। যক্ষ্মা প্রতিরোধ এবং ফুসফুসের স্বাস্থ্য তাদের এজেন্ডা।

বহুতল এই কনভেশন সেন্টারে আছে বিশাল একটি রাজকীয় অডিটোরিয়াম, অনেক কনফারেন্সরুম এবং বেশ কিছু হলঘর। নাম নিবন্ধন করলে সবই উম্মুক্ত। ইউনিয়ন ভিলেজে স্টল দিয়েছে সারা দুনিয়ার নামি দামি ফার্মাসিউটিক্যালস, ডায়াগনস্টিকস এবং সেবা সংস্থা যারা যক্ষ্মা বা ফুসফুসিয় স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে। সহজ উদ্বোধন। রাজ- রাজরা কেউ নয়, একজন বিজ্ঞানীর বক্তৃতার মধ্য দিয়ে কাজটি সম্পন্ন হলো। অতঃপর হ্যামিলনের বংশিবাদকের মতো পাইপ বাজিয়ে সকলকে ডেকে নেওয়া হলো ককটেল পার্টিতে।

ভাস্কর্যের শহর লিল। রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্ট্যাচু বা মনুমেন্ট, দুর্গ বা ক্যাথেড্রালের ছড়াছড়ি। লা-রিপাবলিক চত্বরে এমনই এক প্রাচীন দুর্গে স্থাপিত হয়েছে বিখ্যাত যাদুঘর 'প্যালেডেস্ বুত্তক্স আর্ট।' লিলে গিয়ে যদি এখানে না আসেন তবে বৃথাই আপনার অর্থ ব্যয়। এটি একটি আর্ট মিউজিয়াম। ভাস্কর্য ও পেইন্টিং এর এমন সমারহ সত্যই বিরল। নিপুণ দক্ষতায় তাদের যেমন সৃষ্টি করা হয়েছে, তেমনই পরিপাটি করে সাজান হয়েছে। উপর তলায় বিশাল চিত্রকর্মগুলির সাথে তালমিলিয়ে মেঝেতে লাল রঙ। নিচের গ্যালারিতে দুগ্ধধবল ভাস্কর্যের পায়ের তলায় তা স্বচ্ছ।

ওদিকে জমে উঠেছে কনফারেন্স। বৈজ্ঞানিক সিমপোজিয়ামে ভরপুর সভাকক্ষ। লবিতে চলছে সাইড মিটিং। পোস্টার প্রেজেন্টেশন হচ্ছে হল রুমে। টি কর্ণার প্রস্তুত হচ্ছে ব্রেকের জন্য। প্রধান দরজার বাইরে রাস্তা ও ফুটপাতে গড়াগড়ি দিচ্ছে নরম রোদ, নীল আকাশের নিচে। ভ্যানগাড়িতে খাবারের অস্থায়ী দোকান বসেছে। সেখানে তিন ইউরো খরচ করে পাচ্ছি ঠোঙাভর্তি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। ফুটপাথের রোদে বসে খেতে খেতে মনে হচ্ছে এ যেন আমাদের পৌষ মাস। উৎসবমুখর দারুণ পরিবেশ!

আমাদের হোটেলের কাছেই লা-গ্রান্ড প্লেস যা কিনা লিলে শ্রেষ্ঠ দর্শনীয় স্থান। একটি মনুমেন্টকে আবর্তন করে সপ্তদশ শতাব্দীয় ভবনগুলোর জাঁকজমক দেখার মতো। মনুমেন্টের নিচেই পানির ফোয়ারা এবং জমকালো চত্বর। সেখানে দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই আছে। ভবনগুলোর অভ্যন্তরে সুপার মার্কেট। আধুনিকতার সাথে ঐতিহ্যের এমন সংমিশ্রণ ইউরোপের বৈশিষ্ট্য। সম্মেলন শেষে ভেঙে যাবে মিলন মেলা। আমরাও ছেড়ে যাব অনিন্দ্যসুন্দর নগরী, ফিরে যাব প্রিয় স্বদেশে। তবে মোনালিসার সাথে দেখা হলো না। কাছেই প্যারিস। সেখানে ল্যুভ নামিয় যাদুঘরে বুলেট প্রুফ কাচের আড়ালে সে অধরাই রয়ে গেল।

লেখক: আশেক হোসেন, এলামনাস, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলে, যুক্তরাষ্ট্র; সাবেক পরিচালক এমবিডিসি ও লাইন ডাইরেক্টর টিবি/লেপ্রসি,এনটিপি, ডিজিএইচএস