সুনসান নীরবতায় ঢাকা এক পাহাড়। চারদিকে সবুজ গাছপালা। তার পত্রপল্লবে বাতাসের গান। এরই মাঝে ভেসে আসে পশু-পাখির ডাক। নাগরিক যান্ত্রিকতা থেকে ছুটি নিতে সেখানে ছুটে যান শত শত পর্যটক। হাঁটেন দুর্গম পাহাড়ি পথে, কেউবা বসেন জাগ্রত শিবমন্দিরে। তারপর পাহাড়ের বুক থেকে রোমাঞ্চকর অনুভূতি আর পাহাড়সম মানসিক প্রশান্তি নিয়ে ফিরে আসেন কর্মচঞ্চল জীবনে। কিন্তু বিনিময়ে পাহাড়কে করে আসেন অপরিচ্ছন্ন। ‘দুদণ্ড শান্তি’ নিয়ে পাহাড়কে দিয়ে আসেন ‘বর্জ্যের স্তূপ’। রেখে আসেন নোংরা পায়ের ছাপ।   

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সৌন্দর্যমণ্ডিত এই পাহাড়ের নাম ‘চন্দ্রনাথ’। ১ হাজার ২৫০ ফুট উচ্চতার এই পাহাড়ে আছে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তীর্থ স্থান জাগ্রত শিবমন্দির। এছাড়া জায়গাটি পর্যটকদের ট্র্যাকিংয়ের জন্যও প্রিয়। দিন যত বাড়ছে, সেখানে পর্যটকদের আনাগোনাও বাড়ছে। প্রতিদিন কমপক্ষে কয়েক শতাধিক পর্যটকের পদচারণ হয় এই পাহাড়ে। অসচেতনতায় তাদের অনেকেই বর্জ্য-ময়লা ফেলে পাহাড়কে করছেন নোংরা। আর তাতে ক্ষতি হচ্ছে চন্দ্রনাথের পরিবেশ। 

বিষয়টি নিয়ে পরিবেশবিদরা বলছেন, আমাদের দেশে ১০০টির বেশি প্রাকৃতিক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। তবে সেগুলো সংরক্ষণ না করেই উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে পর্যটকদের জন্য। যার ফলে অসচেতন পর্যটকদের দ্বারা ওই সকল স্থানের মাটি, পানি ও বায়ু নিয়মিত দূষিত হচ্ছে। অন্যদিকে, প্রতিদিন পাহাড় থেকে ময়লা নিয়ে নিচে আসা সম্ভব না বলে জানিয়েছে সীতাকুণ্ড পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। তবে একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে তারা ময়লা আনতে পারবে। তাই, চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পরিবেশকে ঠিক রাখতে পর্যটকদের সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। 

সম্প্রতি সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় ঘুরে দেখা যায়, পাহাড়ের পাদদেশ থেকে উপর পর্যন্ত রয়েছে বেশ কিছু ছোট দোকান। দিন দিন সেই সংখ্যা বাড়ছেই। দোকানগুলোতে রয়েছে পানির বোতল, চিপস জাতীয় খাবার। হঠাৎ পাহাড়ে উঠতে প্রায় সবারই দম যায় যায় অবস্থা। আর এই সময় জীবন বাঁচাতে দরকার হয় পানির। তাই পর্যটকরা ওই সব দোকান থেকে বোতলজাত পানি কিনে পান করেন। ঘর্মাক্ত পর্যটকদের কেউ কেউ শরীরে লবণের ঘাটতি মেটাতে ওরস্যালাইন পান করেন। কিন্তু পান করার পর ওই পানির বোতল ও স্যালাইনের খালি প্যাকেট যেখানে সেখানে ফেলে দেন। চিপসসহ অন্যান্য খাবার খাওয়ার পর প্যাকেটগুলোও যত্রতত্র ফেলেন পর্যটকরা। আর তাই পাহাড়ে ওঠার পথের ডানে-বামে সবখানেই চোখে পড়ে প্লাস্টিকের বোতল ও প্যাকেট। যা ওই পাহাড়ের পরিবেশের জন্য হুমকি স্বরূপ। 

এছাড়া প্রতিটি দোকানের সামনে দেখা গেছে এসব ব্যবহৃত প্লাস্টিকের স্তূপ। দোকানিদের দাবি, তারা এগুলো সপ্তাহে একদিন পরিষ্কার করেন। তবে কতটুকু পরিষ্কার করেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে এক দোকানি হিমেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাহাড় থেকে প্রতিদিন তো ময়লা নামানো সম্ভব না। আমাদের দোকানগুলোর সামনে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া যত ময়লা আছে, তা আমরা একটা নিদিষ্ট জায়গায় রাখি। নিচ থেকে সপ্তাহে একদিন টোকাইরা আসে, তারা সব বোতল নিয়ে যায়। কিন্তু যেসব বোতল পর্যটকরা ছুড়ে ফেলে সেগুলো পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না। এই বোতল ও অন্যান্য প্যাকেট পাহাড়েই রয়ে যায়।

পাহাড় নোংরার বিষয়টি কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে ত্রিজ্ঞা দে নামের এক পর্যটক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা যদি ময়লাগুলো নিজেরা নিচে নামিয়ে নিয়ে আসি তবে ভালো। না হলে এক সময় সৌন্দর্যের পাহাড়ে আর সৌন্দর্য দেখতে পাবো না। মানুষ দেখাদেখি যেমন ভালো কাজ করে, তেমনি খারাপ কাজও করে। 

তিনি আরও বলেন, পাহাড়ের রাস্তায় যদি কিছু দূর পরপর এমন নির্দেশনা লেখা থাকে যে, পাহাড় নোংরা করা যাবে না, ময়লা পাহাড়ের নিচে ডাম্পিং স্টেশনে ফেলুন তাহলে ভালো হয়। ভুলবশত কেউ নোংরা করলেও পরবর্তীতে হয়তো সর্তক হবে। দোকানগুলোতেও এই সতর্কবাণী দেওয়া যেতে পারে। আমার মনে হয়, খাবারগুলো যদি উপরে বহন করে আনতে পারি তবে এগুলো বহন করে নিয়ে যাওয়াও খুব বেশি কষ্ট হওয়ার কথা না। সুতরাং, আমাদেরকে সতর্ক হয়ে এই কাজটুকু করতে হবে পাহাড়ের পরিবেশ রক্ষায়।

নাজমুল হাসান নামের আরেক পর্যটক  ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাহাড়ে আসি প্রশান্তি নিতে। কিন্তু এসেই দেখি চারপাশ নোংরা।  পর্যটকরাই নোংরা করেছে। এখানে যেহেতু কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই বাধ্য হয়ে আশপাশে ময়লা ফেলতে হয়। বুঝি পরিবেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু নিরুপায়। 

পাহাড়ে প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ ফেলায় সেখানে পরিবেশের কেমন ক্ষতি হচ্ছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি’র পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের দেশে যে পর্যটন স্পটগুলো আছে, সেগুলো ইকো ট্যুরিজমের আওতায় এখনও আনতে পারা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমাদের বেশির ভাগ ট্যুরিজম স্পট ন্যাচারাল। আর্টিফিশিয়াল ট্যুরিজম স্পট সারাদেশে ২/৩টির বেশি তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু ন্যাচারাল ট্যুরিজম স্পট আছে আমাদের ১০০টিরও বেশি। সেগুলো সংরক্ষণ না করে আমরা আমাদের ট্যুরিস্টদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছি। অসচেতন পর্যটকরা প্লাস্টিকের বিভিন্ন বোতল, চিপসের প্যাকেট, গ্লাস, প্লেট, পলিথিন ব্যবহারের পর বিক্ষিপ্তভাবে ফেলে আসছেন। ফলে সেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ, মাটি, পানি ও বায়ুসহ সবকিছুই দূষিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে এখানে বারবিকিউ-এর ব্যবস্থা করা হয়, যার ফলে প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া ও ধূলিকণা ওড়ে। 

তিনি আরও বলেন, সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় একদিকে প্রাকৃতিক, অন্যদিকে ধর্মীয় তীর্থস্থান। তাই সারাবছরই সেখানে পর্যটকরা যান। কিন্তু অসচেতন অনেক পর্যটক পরিবেশ দূষণ করছেন। এতে পর্যটনস্থলের সৌন্দর্যও নষ্ট হচ্ছে। তাই সেখানে বর্জ্যগুলোকে একটি ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। তারা যৌথভাবে কাজ করলে এখানের পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ হবে। 

পর্যটকদের ফেলা বর্জ্যে পাহাড় নোংরা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাহাড়ের ময়লা পরিষ্কারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না- জানতে চাইলে সীতাকুণ্ড পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব বদিউল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাহাড়ে ওঠার সময় পর্যটকরা যদি পানির বোতল হাতে নিয়ে যান, সেটি তো আমরা বাধা দিতে পারি না। কিন্তু তারা যদি একটু সতর্ক হয়ে বোতলগুলো নিয়ে নিচে নামেন এবং একটি জায়গায় সংরক্ষণ করেন তাহলে আমরা সেখান থেকে নিয়ে আসতে পারি। 

তিনি বলেন, পাহাড়ের দোকানগুলোতে ডাস্টবিন নেই। এদিকে প্রতিদিন ময়লার গাড়ি পাহাড়ে গিয়ে ময়লা আনা কঠিন। তবে পাহাড়ের নিচ থেকে আমরা নিয়মিত ময়লা সংগ্রহ করে থাকি। পাহাড় পরিচ্ছন্ন রাখতে ও পরিবেশ রক্ষায় পর্যটকদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান এই পৌর মেয়র।  

এমএইচএন/এইচকে