চবিতে হামলা-ভাঙচুর : পুলিশের ‘প্রেসক্রিপশনে’ চাঁদাবাজির মামলা!

ছাত্রমৃত্যুর গুজব রটিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে(চবি) হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় দায়ের হওয়া দুই মামলা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। ইচ্ছেমতো মামলা সাজানোর অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেওয়া এজাহারও আমলে নেওয়া হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দাবি করছে, তাদের দেওয়া এজাহার বাদ দিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো মামলা সাজিয়েছে পুলিশ। এমনকি সামাজিক মাধ্যমে গুজব রটিয়ে হামলার বিষয়টিও এজাহারের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। আবার আসামি করা হয়েছে পুলিশের পরামর্শে। এমনকি যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের অনেকে ঘটনাস্থলেই ছিলেন না। আবার যেসব ধারায় মামলা হয়েছে সেগুলোর কিছু ধারায় অপরাধ সংঘটিত হয়নি। বরং ঘটনার প্রেক্ষিতে যেসব ধারায় মামলা হওয়ার কথা ছিল পুলিশ সেসব ধারা মামলার এজাহারে উল্লেখ করেনি।
পুলিশের এমন মামলাকাণ্ড নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। বিপাকে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ জানিয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসে চাঁদা না পেয়ে অভিযুক্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, চাঁদাবাজির কোনো ঘটনা ঘটেনি। ছাত্রের মৃত্যুর গুজব ফেসবুকে ছড়িয়ে দেশজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টির অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নিরাপত্তা প্রহরীদের উপর হামলা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন- চবিতে ভাঙচুর : দুই মামলায় ছাত্রলীগের ১২ জন আসামি
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাঙচুরের ঘটনার পরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে গোপন বৈঠকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এই ভাঙচুর, গানপাউডার দিয়ে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট করা হয়েছে উল্লেখ করে একটি এজাহার দায়ের করে। ওই এজাহারে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদেরই আসামি রাখা হয়।
কিন্তু পুলিশ সেই এজাহার গ্রহণ না করে শিক্ষার্থীদের নাম উল্লেখসহ চাঁদাবাজির অভিযোগ লিখে আনতে বলে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ পরামর্শ গ্রহণ না করায় দুইদিন মামলা রুজু থেকে বিরত থাকে হাটহাজারী থানা পুলিশ। পরবর্তীতে পুলিশের লিখে দেওয়া এজাহার অনুযায়ী মামলা রুজু হয়। আর পুলিশের ‘ইচ্ছেমতো’ চাঁদাবাজির ধারা ও ছাত্রদের নাম যুক্ত করে সাজানো এজাহারেই বাধ্য হয়ে সই করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শাটল ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে আহত শিক্ষার্থীদের কয়েকজন মারা যাওয়ার গুজব ফেসবুকে রটিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করে তোলা হয়। এ ধরনের ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা দায়ের করতে হয়। কিন্তু, হাটহাজারী থানা পুলিশ এ ধরনের মামলা রুজু করেনি।
আরও পড়ুন- চবিতে ভয়াবহ তাণ্ডব : পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ অপরাধীদের বাঁচাতেই হালকা ধারায় মামলা নিয়েছে। যে মামলার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের লোকজনের ওপর ‘জোর খাটিয়ে’ ছাত্রদের নাম মামলায় যুক্ত করিয়ে নিয়েছে। প্রশাসন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে এজাহার দিয়েছিল, যেন ভিডিও ফুটেজ-সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তদন্তের পর অপরাধীদের শনাক্ত করা যায়।
এদিকে ঘটনার দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহণ পুলে থাকা ৬০টির অধিক গাড়ি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন, শিক্ষক ক্লাবসহ বিভিন্নস্থানে ভাঙচুর চালায় একদল শিক্ষার্থী। তারা অগ্নিসংযোগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সম্পদ পুড়িয়ে দেয়। নিরাপত্তারক্ষীদের উপর হামলা চালায়। শাটল ট্রেনে ভাঙচুর করে। ট্রেনের লোকোমাস্টার ও গার্ডদের উপরও হামলা চালায়। এ ধরনের ঘটনায় পুলিশ সাধারণত বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা রুজু করে। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় চাঁদাবাজির মিথ্যা তথ্য দিয়ে দায়সারা মামলা রুজু করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে হাটহাজারী থানার বিরুদ্ধে।
একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার ধরন অনুযায়ী এটি ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপরাধ। এ আইনের ১৫(১)(ক) ধারায় উল্লেখ রয়েছে- কোনো ভবন, যানবাহন, সম্পত্তি বা সরকারের প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা ব্যাহত করা অথবা সম্পদের ক্ষতিসাধনের জন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোনো কাজ করলে তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫(৩) সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা করার বিধান রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তাণ্ডবের ঘটনায় এ ধারায় মামলা হতে পারত।
আরও পড়ুন- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে : উপাচার্য
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান খাঁন ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনার প্রেক্ষিতে বিশেষ ক্ষমতা আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আলাদা মামলা নেওয়ার কথা পুলিশের। কিন্তু, তারা তা না করে সাধারণ দণ্ডবিধি আইনে মামলা রুজু করেছে। সেখানে কোথাও ফেসবুকের গুজবের বিষয়টি আনা হয়নি। অথচ উচিত ছিল গুজবকারীকে আইনের আওতায় আনতে সংশ্লিষ্ট আইনে মামলা হওয়া। এগুলো আমলযোগ্য অপরাধ।
তিনি আরও বলেন, ফেসবুকে গুজব না রটালে এত বড় ঘটনার সুযোগ ছিল না। পুলিশ মামলা নিয়ে গাফিলতি করার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না তা পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের খতিয়ে দেখা উচিত।
তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের হওয়া একটি মামলার বাদী ও চবির প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশ আমাদের দেওয়া এজাহার নেয়নি। আমরা অজ্ঞাতনামা মামলার এজাহার দিয়েছিলাম। রাষ্ট্রের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি, ফেসবুকে গুজব, সরকারি কাজে দায়িত্বরতদের উপর হামলাসহ সকল ঘটনা উল্লেখ করে এই এজাহার দিই। আমরা বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, অগ্নিসংযোগ-গানপাউডার ব্যবহার করার কথা উল্লেখ করে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা রুজু করতে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু, দুইদিন ধরে পুলিশ আমাদের এজাহার গ্রহণ করেনি। পুলিশ শিক্ষার্থীদের নাম উল্লেখ করে মামলা করতে বলেছে, চাঁদাবাজির অভিযোগ আনতে বলেছে। শেষ পর্যন্ত সেভাবেই মামলা হয়েছে।
আরও পড়ুন- চবিতে ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা, নয় শতাধিক অজ্ঞাত আসামি
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি মামলার প্রধান আসামি সাজ্জাদ হোসেন দেড় বছর আগে পড়াশোনা শেষ করে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। ঘটনার সময় তিনি নিজ বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় ছিলেন।
এ বিষয়ে সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ২০২২ সালে আমার মাস্টার্স শেষ হয়ে গেছে। ৭ সেপ্টেম্বর ঘটনার সময় আমি বাড়িতে ছিলাম। প্রশাসন আমার মোবাইলের লোকেশন চেক করলেই জানতে পারবে আমি কোথায় ছিলাম। আমার এলাকায় জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে আমি কোথায় ছিলাম। আমার নাম হয়ত ভুলে দেওয়া হয়েছে। আমি মিথ্যা মামলা থেকে মুক্তি চাই।
ঘটনার বিষয়ে জানতে হাটহাজারী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মনিরুজ্জামানকে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সোয়েব আহমেদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাঙচুরের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। মামলার তদন্ত চলছে।
একাধিক প্রশ্ন করা হলেও এর বাইরে কিছু বলতে রাজি হননি এ পুলিশ কর্মকর্তা।
এমআর/এমজে