চবিতে ভয়াবহ তাণ্ডব : পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

শিক্ষার্থীর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) স্মরণকালের ভয়াবহ তাণ্ডব চালানোর ঘটনা ঘটেছে গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে। একদল শিক্ষার্থী সে রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস-মাইক্রোবাসসহ অন্তত ৬০টি গাড়ি ভাঙচুর করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে শুরু করে ক্লাব ও উপাচার্যের বাসভবনসহ বিভিন্নস্থানে তাণ্ডব চালায় তারা।
গুজবকে কেন্দ্র করে টানা ৩ ঘণ্টা ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চললেও পুলিশ সেদিন রহস্যজনকভাবে নীরব ছিল। অগ্নিকাণ্ড ও ভাঙচুরের সময় পুলিশকে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় কয়েকটি ভিডিওতে। ঘটনার পর বিপুল সংখ্যক পুলিশ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। তারপরও ওই সময় হাতেনাতে কাউকে আটক করেনি তারা। ঘটনার দুদিন পর দুটি মামলা দায়েরের তথ্য জানায় জেলা পুলিশ। এসব মামলায় সাতজনের নাম উল্লেখ করা হয় এবং অজ্ঞাত আরও কয়েকশ জনকে আসামি করা হয়। তবে তাদের কাউকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, যেকোনো জায়গায় ফৌজদারি অপরাধ হলে পুলিশকে নিজে থেকে তৎপর হতে হয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা এবং অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা তাদের দায়িত্ব। সার্বিক বিষয় তদন্ত করে আদালতে অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করে পুলিশ।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস এম দিদার উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে দীর্ঘক্ষণ ধরে এমন তাণ্ডব চলল অথচ মামলা নিতে দুদিন লেগে গেল! আবার তিনদিন হয়ে গেলেও একজন আসামিও ধরতে পারল না পুলিশ। ব্যবস্থা নিতে এত সময় লাগলে অভিযুক্তরা তো পালিয়ে যাবে। সবমিলিয়ে এ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে একটি পুলিশ ফাঁড়ি আছে। যেখানে ১৫০ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। তাদের সঙ্গে সেদিন অতিরিক্ত সদস্য যোগ হলেও ঘটনার সময়ে হামলাকারীদের কাউকে বাধা পর্যন্ত দেয়নি পুলিশ। পুলিশের এ রহস্যজনক নীরবতা ভাবাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের। বিশেষ করে এখন পর্যন্ত কোনো গ্রেপ্তার না থাকাও প্রশ্নের উদ্রেক করে।
এ বিষয়ে রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সোয়েব আহমেদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওই ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
ঘটনার দিন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
চবি শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে যাতায়াতের প্রধান বাহন শাটল ট্রেন। যথানিয়মে গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে শাটল ট্রেন বটতলী স্টেশন থেকে ক্যাম্পাসের উদ্দেশে রওনা করে। রাত ৯টার দিকে ট্রেনটি চৌধুরীহাট রেলস্টেশন এলাকায় পৌঁছালে গাছের ডালের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ট্রেনের ছাদে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ২০ জনের মতো আহত হন।

অল্প সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাসে গুজব রটে যায়, শাটল ট্রেন থেকে পড়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী মারা গেছেন এবং অনেক হতাহত হয়েছে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে কয়েকটি স্থানে পৃথকভাবে জড়ো হন অনেক শিক্ষার্থী। তারা একে একে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দপ্তরে প্রায় ৬০টির মতো গাড়ি ভাঙচুর করেন। একই সময়ে উপাচার্যের বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে জড়ো হয়ে সেখানেও সিকিউরিটি বক্স ও বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালানো হয় এবং আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
ট্রেনের ছাদে ওঠা নিষিদ্ধ হলেও চবি শিক্ষার্থীরা এবং স্থানীয় কিছু লোক নিয়মিত শাটল ট্রেনের ছাদে যাতায়াত করেন। তবে আগে কখনো গাছের ডালে লেগে শিক্ষার্থী পড়ে যাওয়ার মতো এমন দুর্ঘটনা ঘটেনি। গত ৭ সেপ্টেম্বর হঠাৎ এমন দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষকরা আহতদের দেখতে হাসপাতালে যান এবং তাদের চিকিৎসার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
চবি প্রক্টর ড. নুরুল আজিম সিকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে দুর্ঘটনার বিষয়ে কারো হাত ছিল না। এ ঘটনায় কিছু শিক্ষার্থী ও বহিরাগত আহত হলেও আমরা ভাগ্যবান যে কারও মৃত্যু হয়নি। তারপরও একটি চক্র গুজব ছড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালিয়েছে। এটি কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান থাকবে, তারা যাতে কয়েকটি প্রশ্নকে সামনে রেখে তদন্ত শুরু করে। কারা এই গুজব ছড়িয়েছে, কারা জড়ো হয়ে হামলায় অংশ নিয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল এবং এই হামলার নেপথ্যে কারা? সবমিলিয়ে অপরাধীদের যাতে আইনের আওতায় আনা হয়।

দুই মামলায় আসামি যারা
চবিতে তাণ্ডবের ঘটনায় হাটহাজারী থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা শেখ মো. আব্দুর রাজ্জাক বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। দণ্ডবিধি ১৪৩, ৪৪৭, ৪৪৮, ৩৮৫, ৩২৩, ৩০৭, ৩৭৯, ৪২৭, ৪৩৫ ও ৫০৬ (২)/৩৪ ধারায় দায়ের করা মামলাটিতে চবির সাত ছাত্রকে আসামি করা হয়েছে।
তারা হলেন- ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগের ২০১৯-২০২০ সেশনের শিক্ষার্থী শাকিল হোসেন আইমুন, সংস্কৃত বিভাগের ২০১৮-২০১৯ সেশনের শিক্ষার্থী দীপন বণিক দীপ্ত, শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের ২০১৯-২০২০ সেশনের শিক্ষার্থী মো. রিয়াদ হাসান রাব্বি, ইংরেজি বিভাগের ২০২০-২০২১ সেশনের শিক্ষার্থী নুর মোহাম্মদ মান্না, ইতিহাস বিভাগের ২০১৮-২০১৯ সেশনের শিক্ষার্থী সৌরভ ভূইয়া, পালি বিভাগের ২০১৮-২০১৯ সেশনের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম এবং পদার্থবিদ্যা বিভাগের ২০১৫-২০১৫ সেশনের শিক্ষার্থী শফিকুল ইসলাম। এছাড়া মামলাটিতে অজ্ঞাতপরিচয় ৫০০ থেকে ৬০০ চবি শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিরা গত ৪ সেপ্টেম্বর উপাচার্যের বাসভবনে যায়। সেখানে উপাচার্যকে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে বাসার কেয়ারটেকার মেহেদী হাসানকে জানায়, চবিতে চলমান উন্নয়নমূলক প্রকল্প থেকে তাদেরকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হবে। এই টাকা না পেয়ে আসামিরা চবির শাটল ট্রেনের দুর্ঘটনাকে পুঁজি করে গত ৭ সেপ্টেম্বর চবিতে তাণ্ডব চালিয়ে ক্ষয়ক্ষতি করে। এসময় তারা উপাচার্যের বাসভবনের নিরাপত্তার প্রহরীদেরও মারধর করে।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নুর আহমদ বাদী হয়ে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়। দণ্ডবিধি ১৪৩, ৩৪১, ৪৪৭, ৪৪৮, ৩৮৫, ৪২৭, ৪৩৫, ৩৭৯, ৫০৬ (২)/৩৪ ধারায় দায়ের হওয়া মামলাটিতে সাতজনের নাম উল্লেখ করা হয়।
তারা হলেন- দর্শন বিভাগের ২০১৫-২০১৬ সেশনের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন, পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-২০১৮ সেশনের শিক্ষার্থী মো. ইমরান নাজির ইমন, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ২০১৮-২০১৯ সেশনের শিক্ষার্থী আনিছুর রহমান, ইতিহাস বিভাগের ২০১৮-২০১৯ সেশনের শিক্ষার্থী নাসির উদ্দিন মো. সিফাত উল্লাহ, সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৭-২০১৮ সেশনের শিক্ষার্থী অনিক দাশ, বাংলা বিভাগ ২০১৮-২০১৯ সেশনের শিক্ষার্থী অনিরুদ্ধ বিশ্বাস এবং বাংলা বিভাগ ২০১৮-২০১৯ সেশনের শিক্ষার্থী মো. আজিমুজ্জামান। এছাড়া মামলাটিতে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৪০০ থেকে ৫০০ চবি শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, আসামিরা ৫ সেপ্টেম্বর পরিবহন দপ্তরের প্রশাসক মো. আশরাফ উদ্দিনের কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এই টাকা না পেয়ে তারা চবির শাটল ট্রেনের দুর্ঘটনাকে পুঁজি করে গত ৭ সেপ্টেম্বর চবিতে তাণ্ডব চালিয়ে ক্ষয়ক্ষতি করে।
এমআর/জেডএস
