স্বপ্নের দিনেও কষ্টের ছাপ, চবির সমাবর্তনে আনন্দ-আক্ষেপ একসঙ্গে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পঞ্চম সমাবর্তন ছিল প্রায় ২৩ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য এক গর্বের মুহূর্ত। দীর্ঘ একাডেমিক পথচলার পর গাউন ও টুপি পরে ডিগ্রি গ্রহণ, প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে শেষবারের মতো একসঙ্গে হওয়া, বাবা-মায়ের চোখে সন্তানের সাফল্যের উজ্জ্বলতা– সবমিলিয়ে এটি ছিল অনেকের জীবনের এক স্মরণীয় দিন।
তবে এই আনন্দের আবহেই মিশে ছিল অসন্তুষ্টি ও দুর্ভোগের দীর্ঘ ছায়া। বিশাল বাজেটের আয়োজনেও দেখা গেছে শৃঙ্খলার অভাব। পর্যাপ্ত ফ্যান, পানি, বসার স্থান ও কার্যকর পরিবহন ব্যবস্থার ঘাটতিতে শিক্ষার্থীদের কেউ অসুস্থ হয়েছেন। কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন বাস বা ট্রেনের জন্য। প্যান্ডেলের তাপ, সাউন্ড সিস্টেমের ত্রুটি এবং ভিআইপিদের অগ্রাধিকার নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
আরও পড়ুন
একদিকে গর্বিত মুখ, অন্যদিকে ক্লান্ত দেহ- চবি সমাবর্তনের অভিজ্ঞতা তাই অনেকের কাছে রয়ে গেছে মিশ্র অনুভবের রূপে। শিক্ষার্থীরা জানান, সমাবর্তন শেষে তারা সবচেয়ে বেশি পরিবহনের সংকটে পড়েছেন। অবস্থা এমনও হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস থেকে শহরে পৌঁছেছেন ট্রাকে করে। বাস আর অটোরিকশায় ঠাঁই হয়নি অনেকের। কেউ কেউ ফিরেছেন অ্যাম্বুলেন্সে করে। এদিন সন্ধ্যার পর এমনও হয়েছে টাকা দিলেও যেন মিলছে না গাড়ি।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিপুল পরিমাণ লোকজনের যাতায়াত নিয়ে একেবারে কোনো পরিকল্পনা নেয়নি চবি প্রশাসন। সবমিলিয়ে উপস্থিত কনভোকিরা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে জানিয়েছেন, সমাবর্তনের জন্য সঠিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি।
সমাবর্তনে আসা ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এনামুল হক তাসনীম বলেন, কনভোকেশন থেকে ফেরার পথে পরিবহন সংকটের কারণে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। এ ছাড়া সমাবর্তনের প্যান্ডেলে পর্যাপ্ত পানি ও পাখার ব্যবস্থা ছিল না। ফলে তীব্র গরম ও খাবার পানির অভাবে অনেক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মমতাহীনা খানম বলেন, প্যান্ডেলে সবার বসার ব্যবস্থা সুন্দরভাবে করতে পারেননি। যারা না গেলেই নয় তাদের জন্য তো ভালো ব্যবস্থা করতেন। আমাদের জন্য ফ্যাকাল্টিতে স্ক্রিনের ব্যবস্থা করে দিলেও হতো। পর্যাপ্ত ফ্যান নেই পানি নেই, সাউন্ডও শোনা যায় না। তাহলে এত পথ হাঁটিয়ে এনে ওখানে বসে রাখার মানে কি হলো?
ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শিপন রায় লেখেন, সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এ যাত্রায় ১৬ মাস বয়সের ছোট ছেলেকে নিয়ে বেঁচে গেলাম। শাটল ট্রেনে ধাক্কা খেয়ে আমার ছেলে অসুস্থ হয়ে গেছে। আর হাত-পা ধরেও অনেক চেষ্টা করেছিলাম, তবুও একটা গাড়িতে শহরে আসার জন্য জায়গা পেলাম না। পরিবহন ব্যবস্থার সিস্টেম সুস্থ ও নিরাপদ না করে এমন আয়োজন করা অন্যকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া কিছুই নয়।
শুধুই কী হতাশা? তা নয়। নানা অব্যবস্থাপনা সত্ত্বেও সমাবর্তনে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাদের অর্জিত স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আনন্দিত। তারা দিনটিকে জীবনের একটি স্মরণীয় মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আনন্দের অংশীদার হয়েছেন।
সামিয়া আক্তার নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, সমাবর্তনের দিনটায় যেন চারপাশটা স্বপ্নের মতো লাগছিল। সহপাঠীদের চোখে আনন্দের ঝিলিক, একে অপরকে জড়িয়ে ধরা, হাসি আর অশ্রু মিশ্রিত মুহূর্ত– সবকিছু এক অপূর্ব আবেগ তৈরি করেছিল। গাউন আর টুপি পরে যখন পিতামাতার সামনে দাঁড়ালাম, তখন তাদের চোখে গর্ব আর ভালোবাসার সেই গভীর দৃষ্টি আমাকে যেন শক্তির এক নতুন রূপ দিল। মনে পড়ল আজকের এই অর্জনের পেছনে ওনারাই তো ছিলেন নীরব প্রেরণা। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন, এটা যেন জীবনের এক অনন্য সম্মান, এক চিরন্তন স্মৃতি।
মাহমুদুল হাসান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, সমাবর্তন মানেই কৃতিত্বের স্বীকৃতি। আর এই স্বীকৃতি পেয়ে আমি সত্যিই গর্বিত। আমার বাবা-মায়ের মুখে যে আনন্দ দেখেছি, সেটাই আমার সবচেয়ে বড় অর্জন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষাজীবনের শেষ করে এমন একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। সামনে নতুন যাত্রা, কিন্তু এই দিনের স্মৃতি সারাজীবন বয়ে বেড়াব।
সমাবর্তন নিয়ে পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ
এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সমাবর্তন উপলক্ষ্যে এক সপ্তাহ ধরে ব্যস্ত ছিল জেলা পুলিশ। নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সারা দেশ থেকে আনা হয় ৪০টি আর্চওয়ে। শুধু সমাবর্তনের দিনই কাজ করেছে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের দুই হাজার ৪০০ পুলিশ। বিপুল এই কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে জেলা পুলিশকে কোনো পেমেন্ট দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ব্যয় নির্বাহ করে জেলা পুলিশ। তবে পুলিশ কর্মকর্তাদের সবচেয়ে আক্ষেপ, যাদের ঘামে ভেজা পরিশ্রমে বিরাট এই সমাবর্তন কোনো অঘটন ছাড়া সম্পন্ন হয়েছে, তাদের খোঁজ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সমাবর্তনের দিন কাউকে দেওয়া হয়নি এক প্যাকেট খাবারও। এমনকি এক বোতল পানি কিংবা একটি স্যালাইনের ব্যবস্থাও করা হয়নি।
সমাবর্তন নিয়ে কাজ করা জেলা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুরু থেকে চবি প্রশাসন আমাদেরকে সহযোগিতা করেনি। ধারণা ছিল নিরাপত্তার কাজ পুরোটাই স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। তারপরও প্রধান উপদেষ্টার সফর, এ কারণে আমরা রাতদিন এক করে কাজ করেছি। সমাবর্তনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের জরুরি প্রয়োজনে পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। অসুস্থ হলে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা নিতে সহযোগিতা করা হয়েছে। সমাবর্তন শেষে চবি প্রশাসন আমাদেরকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দেয়নি। বিপুল পরিমাণ পুলিশ সদস্য কাজ করেছে। তাদের একবেলা খাবার পর্যন্ত দেয়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে চবি পঞ্চম সমাবর্তন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সমাবর্তনে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্যান্ডেলে পানি ও পাখার সংকটের কারণে চরম দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। এটার সঙ্গে আমি দ্বিমত করছি না। আমি সবার পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে পরিবহন সংকট হতে পারে। তবে এ বিষয়ে আমার জানা নেই। সংশ্লিষ্ট বিভাগ ভালো বলতে পারবে। আর পুলিশের সদস্যরা খাবার পায়নি, এটা প্রথম শুনলাম। আমরা ওপেনিং ডেতে সমাবর্তনের এসব বিষয় পর্যালোচনা করব।
জানা যায়, চবির পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার ৫৮৬ জন গ্র্যাজুয়েটকে ডিগ্রি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৪২ জনকে পিএইচডি, ৩৩ জনকে এমফিল ডিগ্রি এবং ২২ হাজার ৫২২ জনকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া হয়।
সমাবর্তনে ৪২ জন পিএইচডি ও ৩৩ জন এমফিল ডিগ্রিধারীসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি দেওয়া হয়। এই বিশাল আয়োজনকে ঘিরে খরচ ধরা হয় প্রায় ১৪ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৩ কোটি টাকায় নির্মিত হয়েছে দেড় লাখ স্কয়ার ফিটের অত্যাধুনিক প্যান্ডেল।
এমআর/