ভবঘুরে ও বহিরাগতদের দখলে ক্যাম্পাস, বিরক্ত-ক্ষুব্ধ ঢাবি শিক্ষার্থীরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডের পর ক্যাম্পাস থেকে ভবঘুরে ও ভাসমান লোকজন উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ঘোষণাটি ছিল জোরালো, তবে বাস্তবে তা রয়ে গেছে কেবল কাগজে-কলমেই।
প্রতিদিন রাত নামলেই ক্যাম্পাসের ফুটপাত, মেট্রোরেলের নিচের ব্যারিয়ার ও অন্যান্য উন্মুক্ত স্থান ভবঘুরে ও ভাসমান মানুষের অস্থায়ী আবাসস্থলে পরিণত হয়। আর দিনের বেলায় ঢাবি ক্যাম্পাস যেন পরিণত হয় জনসাধারণের চলাচলের পথ ও অবাধ বিনোদনের স্থানে।
রাত ১২টার পর ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ২০০ জনের মতো ভাসমান ও ভবঘুরে মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়কের ফুটপাতে রাত্রিযাপন করছেন। বিশেষ করে মেট্রোরেল লাইনের নিচের ব্যারিয়ারঘেরা অংশ এবং টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন এলাকা তাদের মূল আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা মনে করেন, ঢাবির ভিসি চত্বর, মল চত্বর, টিএসসি, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি এলাকা ও হাকিম চত্বর বহিরাগতদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এসব এলাকায় মানুষের ভিড় বেড়ে যায় কয়েকগুণ, যার ফলে যানবাহনের চাপও বাড়ে এবং শিক্ষার পরিবেশে সৃষ্টি হয় ব্যাঘাত।
রাতের ঢাবি ক্যাম্পাস ভবঘুরে ও ভাসমান মানুষের রাত্রিযাপনকেন্দ্র
রাত ১২টা পার হলেই বদলে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসের চিত্র। শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই ক্যাম্পাস যেন রাতের বেলায় ভবঘুরে ও ভাসমান মানুষের রাত্রিযাপন কেন্দ্রে রূপ নেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বুয়েট সংলগ্ন রাস্তা, বিশেষ করে জগন্নাথ হলের সামনের অংশে সারি সারি মানুষকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। বেশভূষা ও চলাফেরায় বোঝা যায়, তাদের অনেকেই মাদকাসক্ত।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, কাজী মোতাহার হোসেন ভবন ও শহীদ ডা. মোহাম্মদ মুর্তজা মেডিকেল সেন্টারের সামনের চিত্রও একই রকম। এখানে রাতভর ঘুমিয়ে থাকেন ২০-২৫ জন ভবঘুরে ও পথশিশু।
রাত আড়াইটার দিকে রোকেয়া হল ও শামসুন্নাহার হলের সামনেও একই চিত্র। ভবঘুরে উচ্ছেদের নামে প্রশাসনের ঘোষণাগুলো যেন কেবল রসিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব হলের সামনের প্রতিটি কংক্রিট বেঞ্চে শুয়ে থাকেন একেকজন ভাসমান মানুষ। এসব এলাকায় ১৫-২০ জন ভবঘুরে মানুষকে নিয়মিত রাত্রিযাপন করতে দেখা যায়।
রাজু ভাস্কর্য থেকে চারুকলা অনুষদ পর্যন্ত মেট্রোরেলের পিলারের নিচেও নারী, পুরুষ ও শিশুরা ঘুমান। কেউ কেউ মশারি টানিয়ে, কাপড় দিয়ে পার্শ্বপ্রাচীর তৈরি করে নিজেদের মতো করে ঘর বানিয়ে নিয়েছেন। পাশেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাতেও প্রতিরাতে ঘুমান প্রায় ৫০-৬০ জন মানুষ।

এই ভাসমান ও ভবঘুরে জনগোষ্ঠীর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা প্রায়ই হেনস্তার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল ও কবি সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থীরা ভবঘুরে ও মাদকাসক্তদের অশালীন আচরণ এবং মন্তব্যের মুখোমুখি হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা রক্ষায় বারবার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয় বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
বহিরাগত যানবাহন ও ভবঘুরে বিষয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডের পর ক্যাম্পাসে ভবঘুরে ও ভাসমান মানুষের উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন কঠোর সিদ্ধান্তের কথা জানালেও বাস্তবে তেমন কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান নয়।
আরও পড়ুন
বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু করে নারী আবাসিক হলগুলোর সামনেও রাতের বেলা রাত্রিযাপন করতে দেখা যায় ভবঘুরে ও উদ্বাস্তু মানুষকে। বিশেষ করে দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত সড়কজুড়ে ভাসমান মানুষের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে।
শুধু ভবঘুরে নয়, দিনভর ক্যাম্পাসে অবাধে চলাচল করছে বহিরাগত যানবাহন, বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণহীনতায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন শিক্ষার্থীরা। অটোরিকশার বেপরোয়া চলাচলে প্রায়শই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন তারা-কেউ পা ভাঙছেন, কেউবা মারাত্মক আঘাত পাচ্ছেন।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা অভিযোগ করছেন, প্রশাসন নিরাপত্তার আশ্বাস দিলেও বাস্তবায়নের দিক থেকে রয়েছে চরম গাফিলতি। নিরাপদ ক্যাম্পাস পাওয়ার যে প্রত্যাশা, তা পূরণ হচ্ছে না বলে দাবি তাদের।
বিরক্ত, ক্ষুব্ধ ঢাবি শিক্ষার্থীরা
ঢাবির শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান রাফি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলে, এটা নাকি সিটি করপোরেশনের রাস্তা-এ কারণে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে, একাডেমিক এরিয়ায়ও যানবাহনের চলাচল বেড়েছে। এমনকি ফুটপাত দিয়েও চলছে। বহিরাগত যানবাহনের চাপে এখন ক্যাম্পাসেই তৈরি হচ্ছে যানজট। তাহলে আমরা শিক্ষার্থীরা যাব কোথায়?

আরেক শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ বলেন, ক্যাম্পাসের ভেতরে এখন ফুটপাত দিয়ে রিকশা, বাইসাইকেল এমনকি মোটরবাইকও চলছে। কেউ প্রতিবাদ করলে পথচারীরাই উল্টো শিক্ষার্থীদের প্রতি মারমুখী হয়ে উঠছে। রাস্তার অর্ধেক খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ওয়াসা দখল করে রেখেছে, আর বাকি অংশে চলছে যানবাহন। শিক্ষার্থীরা যেন নিজের ক্যাম্পাসেই এখন অরক্ষিত। এ অবস্থার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তীব্র নিন্দা জানাই।
লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ইব্রাহিম মাহমুদ বলেন, ঢাকা শহরে ভবঘুরে ও মাদকাসক্তদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এরা এখানে নিশ্চিন্তে রাত কাটায়, আবার দিনে মাদক সেবন ও ভিক্ষাবৃত্তি করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনো শিক্ষার্থীদের এদের হাত থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তানভীর আল হাদী মায়েদ বলেন, গত ৯ মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের মূল দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে একধরনের পপুলিস্ট কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত। সাম্য হত্যাকাণ্ড সেই ব্যর্থতারই প্রতিফলন। তার মৃত্যুর পরও প্রশাসন ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এটি তাদের অদক্ষতারই প্রমাণ।
তিনি বলেন, সাম্যর মৃত্যুর পরেও একাধিক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা মেডিকেল মোড়ে এক ভবঘুরে ছুরি নিয়ে শিক্ষার্থীদের তাড়া করে, ভিসি চত্বরে উল্টো দিক থেকে আসা অটোরিকশা একজন শিক্ষার্থীকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এসব ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অনিরাপত্তারই বহিঃপ্রকাশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ বলেন, গতকাল রাতেও আমরা প্রক্টরিয়াল টিম নিয়ে ভবঘুরে ও উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদ করেছি। কিন্তু তারা আবার ফিরে আসে। ভোরের দিকে আবারও নারী শিক্ষার্থীদের হলগুলোর সামনে থেকে তাদের সরানো হয়েছে। এই প্রক্রিয়া আমরা আগামী ১০-১২ দিন ধরে চালিয়ে যাব। আশা করছি এরপর ক্যাম্পাস থেকে তাদের সরানো সম্ভব হবে।
তিনি জানান, ভবঘুরে ও উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব সমাজসেবা অধিদপ্তরের, আমরা আগেও তাদের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেছি। কিন্তু তারা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
সাদ আদনান রনি/এমএসএ