নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে নোংরা রাজনীতি, ভোটও চাই আবার নারীদেরই!

নানা শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা কাটিয়ে অবশেষে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। আগামীকাল ৯ সেপ্টেম্বর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। শিক্ষার্থীরা এখন অপেক্ষা করছেন একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচনের জন্য।
অভিযোগ উঠেছে, এবারের ডাকসু নির্বাচনে নারীদের রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। একদিকে নির্বাচনী মাঠে নারীদের নাম ব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের নারীদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর বিদ্বেষ প্রচার করা হচ্ছে। তাদের সামনে রেখে করা হচ্ছে নোংরা রাজনীতি।
আরও পড়ুন
এবারের ডাকসু নির্বাচনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নারী প্রার্থীদের ভূমিকা ও নারী নিরাপত্তা ইস্যু। প্যানেলগুলোর দেওয়া ইশতেহারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দটিও ‘নারী নিরাপত্তা’। এর মধ্যেই নারী প্রার্থীদের ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে নানা ধরনের সাইবার বুলিং ও অপপ্রচার, যা নিয়ে উঠেছে নানা অভিযোগ। ছাত্রদল ও শিবিরের পক্ষ থেকে এ নিয়ে একাধিকবার অভিযোগ তোলা হয়েছে।
সাইবার বুলিংয়ের নিশানায় নারী প্রার্থীরা
ডাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নারী প্রার্থীদের ব্যক্তিগত চরিত্রহননের চেষ্টা চলছে বলে বিভিন্ন পক্ষ অভিযোগ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের অতীত কর্মকাণ্ড ঘিরে করা হচ্ছে সাইবার বুলিং। বিশেষ করে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেল থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন পদের প্রার্থী ফাতেমা তাসনিম জুমা, উম্মে সালমা ও সাবিকুন্নাহার তামান্না ব্যাপকভাবে বুলিং-এর শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে প্রমাণসহ অভিযোগ জানিয়েছেন ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ। অন্যদিকে বামপন্থি ও ছাত্রদলের প্যানেলের নারী প্রার্থীরাও বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, এ ধরনের অপরাধ মানবাধিকার পরিপন্থি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক বার্তায় সতর্ক করে বলা হয়, যদি কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার বা সাইবার অপরাধ প্রমাণিত হয়, তবে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের গঠিত আচরণবিধি সংক্রান্ত টাস্কফোর্স এবং সাইবার নিয়ন্ত্রণ সেলের মাধ্যমে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপও গ্রহণ করা হবে।
নেতৃত্বে আসতে চাওয়া নারীদের প্রতি আক্রমণ বেশি
ক্যারিয়ার উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী নিশি আক্তার বলেন, ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নারীদের নিয়ে যে নোংরা ও কুৎসিত রাজনীতি চলছে তা শুধু লজ্জাজনকই নয়– এটি আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির নৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ। নারী প্রার্থীদের যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা ও ভাবমূর্তির পরিবর্তে তাদের চরিত্রহনন, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুৎসা রটানো এবং অপমানজনক প্রচারণা চালানো– এসব কার্যক্রম শুধু নারীবিদ্বেষী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ নয়, এটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্টেরও ঘৃণ্য চেষ্টা।
তিনি বলেন, আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, নারী শিক্ষার্থীরা কোনো রাজনৈতিক দলের খেলনার বস্তু নয়। তারা সমানভাবে যোগ্য, সক্ষম ও সম্মান পাওয়ার অধিকারী। নারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচার, ভয়ভীতি ও হয়রানির যে সংস্কৃতি তৈরি করা হচ্ছে তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাই– এই নোংরা রাজনীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও অংশগ্রহণের অধিকার রক্ষাই এখন সময়ের দাবি।
ডাকসুর কমনরুম, রিডিং রুম ও ক্যাফেটেরিয়া পদে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থী উম্মে সালমা অভিযোগ করে বলেন, আমাদের নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে ফেসবুকের কমেন্টে ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে বিভিন্নভাবে অশ্লীলতা ছড়ানো হচ্ছে। এমনকি ধর্ষণের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নারীদের সুরক্ষায় একটি সেল গঠন করা হয়েছে। আমি আশা রাখি তারা আমাদের সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেবে এবং নারীদের অনলাইনে হেনস্তাকারী মস্তিষ্ক বিকৃত মানুষদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আরও পড়ুন
সমাজসেবা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী সীমা আক্তার বলেন, নারী নেতৃত্ব সবাই চায়। কিন্তু নারীরা নেতৃত্বে কীভাবে উঠে আসবে, সেই পথটা মসৃণ করে দিতে কেউ চায় না। ডাকসুতে নেতৃত্ব দিতে আসা নারী, সে যে মতের বা মতাদর্শেরই হোক না কেন, তাকে নোংরাভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে। এটা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হচ্ছে যাতে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। নারী হওয়ার কারণে আমাদেরকে জেন্ডার বেজড স্ল্যাং করা হচ্ছে ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে, যাতে আমরা ভয় পাই। নারী নেতৃত্বকে যারা ভয় পায়, তারাই এ ধরনের কাজগুলো করছে।
ডাকসু নির্বাচনে নারীকে ‘মানবঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে : ইউটিএল
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স লিংক (ইউটিএল) অভিযোগ করেছে, ডাকসু নির্বাচন ঘিরে নারীকে রাজনৈতিকভাবে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সংগঠনটির দাবি, নির্বাচনী মাঠে নারীদের নাম ব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া হলেও প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের নারীদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর বা নারীবিদ্বেষী তৎপরতা চালানো হলে তখন নীরবতা পালন করা হচ্ছে।
তাদের মতে, নিজের পক্ষে আঘাত এলে সরব হওয়া কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের নারীদের বিরুদ্ধে অপমান বা বিদ্বেষ ছড়ালে চুপ থাকা– এই দ্বৈত মানসিকতা নারীর মর্যাদার জন্য কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়।
এ ছাড়া নির্বাচনে নারীবিদ্বেষ ছাড়াও আরও বেশকিছু উদ্বেগজনক প্রবণতা লক্ষ্য করার কথাও জানিয়েছে সংগঠনটি।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক অধ্যাপক মু. আতাউর রহমান বিশ্বাস এসব অভিযোগ করেন।
আরও পড়ুন
নারী শিক্ষার্থীদের ভোট লুফে নিতে মরিয়া প্রার্থীরা
এসবের পরও নারীদের ভোট লুফে নিতে মরিয়া প্রার্থীরা। ডাকসু নির্বাচনে নারী ভোটারের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় প্রায় সমান। মোট ভোটারের প্রায় ৪৮ ভাগই নারী, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে রোকেয়া হলে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলে মোট ভোটার ৩৯ হাজার ৮৭৫ জন। এর মধ্যে শুধু পাঁচটি ছাত্রী হলে ভোটার সংখ্যা ১৮ হাজার ৯৫৯ জন, যা মোট ভোটারের ৪৭.৫৪ শতাংশ। শুধু রোকেয়া হলেই ভোটার সংখ্যা ৫ হাজার ৬৬৫ জন।
মোট ভোটারের অর্ধেক নারী। তবে প্যানেলগুলোতে ছেলে প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। ডাকসুর কোন প্যানেলে কতজন নারী প্রার্থী আছেন সেটিও এবার আলোচনায় আছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, শিবিরের প্যানেলে চারজন, ছাত্রদলের প্যানেলে দুজন নারী প্রার্থী রয়েছেন।
নারীদের ভোট নির্বাচনের চিত্র বদলে দিতে পারে বলে মনে করেন অনেকে। বিশ্লেষকদের মতে, নারী ভোটাররা যদি কোনো একটি পক্ষে ঝুঁকে পড়ে তবে জয়-পরাজয়ের নির্ধারক ভূমিকা রাখবেন তারাই।
মেয়েদের হলে প্যানেলগুলোর নানা কর্মসূচি
ক্যাম্পাসে উৎসবমুখর পরিবেশে শেষ হয়েছে নির্বাচনের প্রচারণা। প্রার্থীরা লিফলেট বিলি করে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিয়েছেন নিজেদের প্রতিশ্রুতি। নারী ভোটারের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক হওয়ায় ছাত্রীদের হলে প্রচারণায় বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছে সব সংগঠন ও জোট। কক্ষ ধরে ধরে গণসংযোগ ছাড়াও হলের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘প্রজেকশন মিটিং’, যেখানে নারী ভোটারদের সরাসরি প্রভাবিত করার চেষ্টা চালান প্রার্থীরা।
ষড়যন্ত্রের ঘেরাটোপ পেরিয়ে ভোটের অপেক্ষায় শিক্ষার্থীরা
নির্বাচন ঘিরে নানা শঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বাধা কেটে ভোটের পথ সুগম হয়েছে। জিএস প্রার্থী এসএম ফরহাদের প্রার্থিতা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিএম ফাহমিদা আলম হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। ওই নারী প্রার্থীকে গণধর্ষণের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আলী হুসেন বহিষ্কৃত হন।
ফাহমিদার রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত প্রথমে নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করলেও পরে চেম্বার জজ আদালত তা বাতিল করেন। যা বহাল রাখেন আপিল বিভাগও। এরপর ভিপি প্রার্থী জুলিয়াস সিজার তালুকদার রিট দায়ের করলেও তা কার্যতালিকা থেকে বাদ পড়ায় সব শঙ্কার অবসান ঘটে। ফলে শিক্ষার্থীরা এখন অপেক্ষা করছেন একটি সুষ্ঠু ডাকসু নির্বাচনের।
এসএআর/এসএসএইচ/এমজে