২০২১ সালে চবি হারিয়েছে ১৫ শিক্ষক
২০২০ সাল থেকে করোনা মহামারি ঘিরে রেখেছে পুরো পৃথিবীকে। ২১ সালেও জীবনবিনাশী করোনার ভয়াবহতা কমেনি। এতে মৃত্যুর মিছিলও হয়েছে দীর্ঘ। রাজনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেককে হারিয়েছে বাংলাদেশ। বাদ যায়নি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও। ২০২১ সালে করোনা আক্রান্ত ছাড়াও বার্ধক্যজনিত, ক্যানসারসহ নানা কারণে সাবেক এবং বর্তমান ১৫ জন শিক্ষক চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
জানা গেছে, ২৭ ডিসেম্বর একাউন্টিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বিনয় কৃষ্ণ শর্মা মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে ২১ ডিসেম্বর ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আসমা সিরাজুদ্দীন মৃত্যুবরণ করেন। তিনি জাতীয় অধ্যাপক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের সহধর্মিণী।
৭ আগস্ট করোনা আক্রান্ত হয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. গাজী সালেহ উদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী সালেহ উদ্দিন ছিলেন চবির সাবেক প্রক্টর, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের মহাসচিব ও চবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি রাঙামাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক এবং খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সভাপতি গাজী সালেহ উদ্দিন ছিলেন।
৪ জুলাই চবির বাংলা বিভাগের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. খালেদা হানুম মৃত্যুবরণ করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর সহধর্মিণী।
১৬ জুলাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন চবির ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. এ আহাদ ওসমান গনি। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার একাডেমিক অব গ্রাজুয়েট অ্যান্ড প্রফেশনাল স্টাডিজ ব্যবস্থাপনার পরিচালক এবং ডিন ছিলেন। ড. এ আহাদ ওসমান গনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির অ্যালামনাই সোসাইটির ‘আউট স্ট্যান্ডিং অ্যান্ড ডিস্টিংগুইসড ক্যারিয়ার অ্যাডভান্সমেন্ট’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শক শিক্ষক ছাড়াও হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট প্রোফাইলে তার রেফারেন্স নিবন্ধিত রয়েছে।
ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে ১৮ জুলাই চবির অধ্যাপক ড. নুরুল মোস্তফা মৃত্যুবরণ করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, পদার্থ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, বিজিসি ট্রাস্ট ও সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯ জুলাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চবি জাদুঘরের সাবেক কিউরেটর প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. শামসুল হোসাইন মৃত্যুবরণ করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যাদুঘরের প্রথম কিউরেটরিয়াল এবং প্রতিষ্ঠাতা একাডেমিক কর্মী। এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি এবং বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনায় যুক্ত ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা ও নিয়মিত লেখালেখি করতেন। চট্টগ্রামের মুসলিম ইতিহাস নিয়ে রচিত ‘মুসলিম মন্যুমেন্ট অব চিটাগাং’ গ্রন্থের লেখক ছিলেন তিনি।
২২ জুলাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ভূঁইয়া ইকবাল মৃত্যুবরণ করেন। প্রবন্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য ২০১৪ সালে অধ্যাপক ভূঁইয়া ইকবাল বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গবেষণা ও সম্পাদনা করেন। তার অন্যতম গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্র-সংবর্ধনা’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ’, ‘পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্র-বক্তৃতা’, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘শামসুর রাহমান: নির্জনতা থেকে জনারণ্যে’, ‘আনিসুজ্জামান: সমাজ ও সংস্কৃতি’।
২৩ জুলাই দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন চবির আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের প্রভাষক বাসবী বড়ুয়া।
২৪ জুলাই চবির ইতিহাস বিভাগের সুপারনিউম্যারারী অধ্যাপক ড. ইমরান হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। ৩ মাসের জন্য তিনি চবি ভিসির দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক ড. ইমরান হোসেন দুই মেয়াদে চবি কলা অনুষদের ডিন, সিন্ডিকেট সদস্য, সিনেট সদস্য, চবি জাদুঘরের কিউরেটর-সহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষক গ্রুপের আহ্বায়কও ছিলেন।
২৪ জুন চবির সাবেক উপাচার্য ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক সদস্য। এছাড়া তিনি কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের প্রথম ডিন এবং ১৯৮৫-৮৮ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন।
২৫ মে চবির ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হক মৃত্যুবরণ করেন। ড. মাহমুদুল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের একমাত্র ফুলব্রাইট স্কলারস ছিলেন এই গুণী অধ্যাপক। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
চবির ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি অধ্যাপক ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান মৃত্যুবরণ করেন ২৮ মার্চ। বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক ছিলেন। তিনি সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বহুভাষায় পারদর্শী ও সুফিবাদ তরিকার অন্যতম সহচর ড. খান বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান গবেষক ছিলেন।
১২ মার্চ করোনা আক্রান্ত হয়ে ফাইন্যান্স বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আ. ন. ম. আব্দুল মুক্তাদির মৃত্যুবরণ করেন।
৬ ফেব্রুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চবির সাবেক রেজিস্ট্রার ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হুদা মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ৯ মাস চবির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টারের দায়িত্ব পালন করেন।
অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে উল্লেখ করে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত এক বছরে বেশ কিছু শিক্ষক আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। যা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। যাদের হারিয়েছি আমরা তারা ছিলেন আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকতা জীবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে তারা যেসব অবদান রেখে গেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা চিরদিন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ রাখবে। খ্যাতিমান শিক্ষকদের মৃত্যুতে শিক্ষাক্ষেত্রে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
এসপি