যে হাটে পাখি আর মানুষের সহাবস্থান

হাটভরা মানুষ। চারদিকে হইচই। পা ফেলার ফুসরত নেই। জনাকীর্ণ এই হাটে আসা বেশির ভাগ মানুষের আকর্ষণ থাকে পাকুড়গাছ ঘিরে। সবুজ আচ্ছাদিত গাছে চলে পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর ওড়াউড়ি। সাদা বক, কালো পানকৌড়িসহ হরেক রকম পাখির ছোটাছুটিও। গাছভর্তি পাখির এই সমাবেশ হাটভর্তি মানুষকে মোহিত করছে বারংবার।
পাখির খেলা আর মেলা দেখতে থাকেন অন্নদানগর হাটে সওদা করতে আসা মানুষজন। ব্যস্ততম হাটের মাঝে কয়েক শ পাখির দুর্লভ বিচরণ দেখতে প্রতিদিন ভিড় জমে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় আবার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার আঁধার নামে, তার আগ পর্যন্ত সবাই উপভোগ করেন পাখির ওড়াউড়ি।
পাখিময় এই হাটের অবস্থান রংপুরের পীরগাছা উপজেলার অন্নদানগর ইউনিয়নে। হাটের নামকরণ হয়েছে ইউনিয়নের নামেই। সেখানে সপ্তাহে দুদিন হাট বসে। আর অন্যান্য দিনের পুরো সময় চলে জমজমাট কেনাবেচা। বিকেল হলে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়। ব্যস্তসমস্ত এই হাট এখন কয়েক শ পাখির অভয়াশ্রম।
জানা গেছে, অন্নদানগর হাটের মাঝে থাকা পাকুড়গাছ (বটপাইকর) ঘিরে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বাসা গড়ে রয়েছে। মানুষের হাটে এত পাখির নির্বিঘ্ন বসবাস অনেকটা বিস্ময়ের। তবে সময়ের সঙ্গে পাখির আনাগোনা বাড়া অন্নদানগর হাটের নাম বদলে গেছে। অনেকের কাছে এটি এখন ‘পাখির হাট’ হিসেবে পরিচিত।

এই হাটের দোকানদার তপন শাহ্ ও দুলাল চন্দ্র শাহ্ জানান, পাকুড়গাছ দুটি এখন পাখির অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। প্রায় ১৫ থেকে ১৭ বছর ধরে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বাসা করেছে। পাখির আবাস দেখতে বাহির থেকে প্রতিদিনই লোকজন আসে। হাটবারের দিন মানুষের ভিড় বেশি থাকে। কিন্তু পাখিগুলোর কোনো অসুবিধা হয় না।
নূর হোসেন নামে স্থানীয় একজন চাকরিজীবী বলেন, একবার কয়েকজন দোকানদার গাছটি কাটার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরে অধিকাংশ দোকানদার বাধা দেন। তারা খবর দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও)। তিনি এসে গাছ কাটা বন্ধ করেন এবং গাছটি পাখিদের অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করেন।
বর্তমানে পাকুড়গাছটিতে বক-পানকৌড়ির স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে পার্শ্ববর্তী একটি আমগাছেও আবাসা গড়েছে এসব পাখি। গত কয়েক বছরের চেয়ে এবার পাখি এসেছে বেশি। চারদিকে অসংখ্য দোকান। মানুষ গিজগিজ করছে। হাটের দিনে জনসমাগম হয় অনেক বেশি।
অন্নদানগর কলেজের অধ্যক্ষ হানিফ উদ্দিন বলেন, প্রায় এক যুগ আগে হঠাৎ এক সন্ধ্যায় পাকুড়গাছে কয়েক শ পাখি এসে বাসা বাঁধে। এর মধ্যে ছিল সাদা বক, কানি বক, ঝুঁটি বক, লাল হলদে বক, পানকৌড়ি, শালিক, চীল, কাক, শামুকখোল, কদমা। পরের দিন সকাল হওয়ার আগেই পাখিগুলো উড়ে যায়। আবার কিছু পাখি ফিরে আসে। এভাবেই বিভিন্ন জাতের পাখির আনাগোনা শুরু হয়। এখন দিনরাত পাখির মিলন মেলা হয়।

ইটাকুমারী শিবচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক নুর আফরোজ বলেন, সাধারণত পাখির বসবাসের জন্য নিরিবিলি ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন। কিন্তু হাটের মানুষ আর পাখির এমন সহাবস্থান দুর্লভ ব্যাপার। পাখির সঙ্গে এখানকার মানুষের সখ্য গড়ে উঠেছে। তারা পাখিদের আপন করে নিয়েছে। বাসা থেকে কোনো ছানা মাটিতে পড়ে গেলে তারা সেটিকে তুলে দিচ্ছে। কেউ যেন পাখি শিকার করতে না পারে, এ জন্য হাটের সবাই খুব সজাগ থাকে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং পাখি ও নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ব্যস্ত হাটে পাখিদের নির্ভয় আবাস গড়ার নেপথ্যে রয়েছে আশপাশে অনেক বিল। এই হাটের খুব কাছেই তিস্তা ও মানাস নদী। সে কারণে এখানে পাখির আনাগোনা বেশি। এই হাটের মানুষের পরম ভালোবাসা থেকেই পাখিগুলো নিরাপদ অবাস গড়েছে।
পাখিদের জীবনাচরণ নিয়ে তিনি বলেন, পাখিগুলো এসে বাসা বুনতে শুরু করে। এরপর ডিম দেয়, সেখানে বাচ্চা ফোটে। বাচ্চাগুলো ক্রমে বড় হতে থাকে। উড়তে শেখে, খেলা করতে শেখে। বাচ্চা পাখিগুলো মা কিংবা বাবা পাখির গলার ভেতর ঠোঁট ঢুকিয়ে খাবার সংগ্রহ করে। প্রতিটি বাসাই যেন একেকটি পরিবার। এভাবেই এই ব্যস্ত হাটের মানুষের সঙ্গে বছরের পর বছর পার করছে পাখিগুলো।
এনএ