গৌরবের দেড়শ বছরে রাজশাহী কলেজ

প্রতিষ্ঠার দেড়শ বছরে পা দিল ঐতিহ্যের রাজশাহী কলেজ। ১৮৭৩ সালের ১ এপ্রিল ছয়জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করে কলেজটি। কালক্রমে তা হয়ে ওঠে দেশের একমাত্র মডেল কলেজ।
শুক্রবার (১ এপ্রিল) সকালে ১৫০ পাউন্ডের কেক কেটে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছে রাজশাহী কলেজ পরিবার। পরে কলেজ মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।
মেয়র লিটন বলেন, শিক্ষার প্রসারে রাজশাহী কলেজের ভূমিকা অনন্য। ঐতিহ্যবাহী দেশসেরা এই কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। আগামীতে দেশ ও জাতির কল্যাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে কলেজটি।
রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল খালেকের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর হবিবুর রহমান, রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. জোবাইদা আয়েশা সিদ্দিকা, নিউ গভঃ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর কালাচাঁদ শীল, রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজের প্রফেসর আমিনা আবেদীন প্রমুখ।

এদিকে পরতে পরতে ইতিহাস আর ঐতিহ্য ধারণ করে আছে রাজশাহী কলেজ। রয়েছে ঐতিহাসিক বেশ কিছু স্থাপনাও। সাজানো-গোছানো কলেজ ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দর্শনার্থীদেরও টানে।
বিভিন্ন সময় প্রকাশিত কলেজের বই-পুস্তক থেকে জানা যায়, প্রাচীন বাউলিয়া ইংলিশ স্কুল ও কলেজিয়েট স্কুলের হাত ধরেই আজকের রাজশাহী কলেজের যাত্রা। প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায় ১৮৭৮ সালে প্রথম গ্রেড মর্যাদা পায় কলেজটি।
রাজশাহী কলেজ নামকরণ হয় তখনই। উত্তরবঙ্গের প্রথম কলেজ হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর ওই বছরই চালু হয় বিএ কোর্স। এরপর ১৮৮১ সালে স্নাতকোত্তর এবং ১৮৮৩ সালে যোগ হয় বিএল কোর্স। যদিও ১৯০৯ সালে মাস্টার্স কোর্স ও বিএল কোর্সের অধিভুক্তি বাতিল করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরও অধিভুক্ত হয়। এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স ও সম্মান ডিগ্রি প্রদান করছে রাজশাহী কলেজ। চালু রয়েছে উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রমও।
ছাত্র নথিভুক্তি বন্ধ হওয়ায় ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বন্ধ ছিল এ কার্যক্রম। মাত্র ছয়জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করা রাজশাহী কলেজ এখন পরিণত হয়েছে উত্তরের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে।
১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত কলেজের প্রশাসনিক ভবনটি এখনো যে কারো নজর কাড়ে। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বিতল ভবনটির চুড়ায় এক সময় ছিল রোমান পুরাণের জ্ঞান ও চারুশিল্পের ভাস্কর্য প্যালাস-অ্যাথিনি। পরে একই আদলে আরও দুটো ভাস্কর্য হেমন্ত কুমারী ছাত্রাবাসে স্থাপিত হয়। এই চারটি ভাস্কর্যই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দখলদার পাক বাহিনীর দোসরদের চাপে অপসারিত হয়।
প্রশাসনিক ভবনটি কলেজের প্রথম নিজস্ব স্থাপত্যের নিদর্শন। এর জন্য ব্যয় হয় ৬০ হাজার ৭০৩ টাকা। পুঠিয়ার মহারাণী শরৎসুন্দরী দেবী ১০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন এই সুদৃশ্য ইমারত নির্মাণে।
মহারাণী কলেজের সীমানা প্রাচীর ও রেলিং নির্মাণেও অর্থ প্রদান করেছিলেন। তবে ১৯৩৩-৩৪ শিক্ষাবর্ষের প্রসপেকটাসে ভবন নির্মাণ ব্যয় মোট ৬১ হাজার ৭০৩ টাকার কথা উল্লেখ আছে।
নির্মাণ শেষে বাউলিয়া হাইস্কুল থেকে রাজশাহী কলেজের ক্লাসসমূহ এই নবনির্মিত ভবনে স্থানান্তরিত হয়। অনেকে ধারণা করেন এই নতুন ভবনে ক্লাস শুরু হলে বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর ক্লাসসমূহ চালুর বিষয় অনুমোদিত হয়।
প্রশাসন ভবনের পেছনে পুকুরের উত্তরে একই আদলেই গড়া ‘হাজী মুহম্মদ মুহসীন’ভবন। ১৮৮৮ সালে নির্মিত হয় এ ভবন। তখন প্রখ্যাত এই দানবীর হাজী মুহম্মদ মহসীন এটির নির্মাণে আর্থিক অনুদান দেন। তৎকালীন কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থিত মাদরাসা ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো এটি। পরে মাদরাসা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পর এ ভবনটি কলেজরই ভবন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
‘ফুলার ভবন’ রাজশাহী কলেজের আরেকটি ঐতিহাসিক ভবন। রাজশাহী কলেজ মাঠের পশ্চিমের এ ভবনটিও শত বছর পেরিয়েছে। মাঠের একেবারেই দক্ষিণে অধ্যক্ষের দোতলা বাসভবন। এই ভবনটিতে উপ-মহাদেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদগণ বসবাস করে গেছেন। এটিও নির্মিত হয়েছে ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীতে।
রাজশাহী কলেজ মুসলিম ছাত্রাবাস চত্বরে রয়েছে শহীদ মিনার। স্থানীয় ভাষা সংগ্রামীদের দাবি, এটিই দেশের প্রথম শহীদ মিনার। কেবল ভাষা আন্দোলনই নয়, রাজশাহী কলেজ মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির সকল আন্দোলন সংগ্রামের অংশ হয়ে রয়েছে।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/আরএআর