চার বছরে ঠাকুরগাঁওয়ে এসেছে ৪ নীলগাই

২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার কুলিক নদের ধারে পুনরায় দেখা গেছে বিলুপ্ত প্রাণী নীলগাইকে। সে বছর ভারত থেকে দলছুট হয়ে বাংলাদেশে চলে আসার মাধ্যমে দেশের প্রথম নীলগাই হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর আরও চলে আসায় দেশের বুকে নতুন করে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তৃণভোজী এ প্রাণীকে ঘিরে।
আকস্মিক আবির্ভাব যেন মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের বুকে বিলুপ্ত হয়ে পড়া আরও কয়েক ডজন প্রাণীর কথা। গত শতাব্দীতে মানুষের লোভী প্রবৃত্তির শিকার হয়ে দেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়া প্রাণীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। গন্ডার, গাউর, বুনো মোষ, ময়ূর, হাড়গিলা, নীলগাই, ঘড়িয়াল, জলার কুমির, বারশিঙ্গা, হায়েনা, চিতা, ধূসর নেকড়ে, কৃষ্ণষাঁড়, মন্থর ভালুকসহ প্রায় ৩১ প্রজাতির প্রাণী বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
নীলগাই শুনলেই মাথায় আসে নীল চামড়ার এক গরুর ছবি। কিন্তু এরা বাস্তবে কোনো গরু বা গরুজাতীয় প্রাণী নয়। এরা হরিণ জাতীয় প্রাণী। এশিয়ার বুকে বিচরণ করা হরিণ জাতের প্রাণীগুলোর মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড় এরা। যদিও বাহ্যিক দিক থেকে দেখতে এরা অনেকটাই ঘোড়ার মতো। ঘোড়ার যেমন লম্বা ঘাড় এবং এর মধ্যে হালকা কেশর থাকে। এদের মাথা খানিকটা সরু এবং ঘোড়ার ন্যায় এদের শক্ত পা থাকে। আবার পিঠের শেষে এদের গরুর মতো লেজও রয়েছে। আকারে ভারতীয় গরুর চেয়ে বড় হয়। লম্বায় প্রায় ৫ ফুট হয়ে থাকে। গড় ওজন ৩০০ কেজির মতো হয়। এরা সাধারণত পেছনের পায়ে ভর করে ঘাড় উঁচু করে পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে।
নীলগাইয়ের বৈজ্ঞানিক নাম Boselaphus tragocamelus। এরা তৃণভোজী প্রাণী। এদের খাবারের তালিকায় ঘাস, লতাপাতা, গুল্ম, ঝোপ ইত্যাদি তৃণজাতীয় খাদ্য রয়েছে। তাই এসব খাবারের প্রাচুর্য রয়েছে, এমন জঙ্গলে বা জলাভূমির দিকে নীলগাইদের বেশি দেখা যায়।
এদের গড় আয়ু ২১ বছরের মতো। একে অনেকেই শান্ত ও বোবা প্রাণী হিসেবে মনে করে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় নীলগাইয়ের শব্দ রেকর্ড করতে সক্ষম হয়েছেন। এরা দিবাচর প্রাণী। প্রচণ্ড গরমেও এদের দিনের বেলায় দিব্যি খাবারের সন্ধান করতে দেখা যায়। এরা তখন প্রচুর পরিমাণে পানি পান করে। তবে গ্রীষ্মকাল ছাড়া অন্যান্য সময় এরা পানি না খেয়ে দুই-তিন দিন কাটিয়ে দিতে পারে।
স্ত্রী ও পুরুষ নীলগাইয়ের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। প্রথম দেখাতেই যদি নীলগাইয়ের মাথায় শিং নজরে আসে, তাহলে চোখ বন্ধ করে সেটি পুরুষ নীলগাই বলে চিহ্নিত করা যায়। এ ছাড়া পুরুষ নীলগাইদের গায়ের চামড়ার রং ধূসর থেকে নীলচে-ধূসর বর্ণের হয়ে থাকে। এদের গাল ও ঠোঁটের চারদিকের রং কিছুটা সাদাটে হয়ে থাকে। এদের কান ও লেজের শীর্ষ কালচে রঙের। পুরুষদের শিংজোড়া ১৫ থেকে ২৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। স্ত্রী নীলগাইয়ের রং হয় বাদামি। এদের দেহেও পুরুষদের মতো সাদা ফোঁটা দেখা যায়। কিন্তু এদের কোনো শিং নেই। তবে এদের ঘাড়ে কেশর রয়েছে।
ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও যুক্তরাষ্ট্রে নীলগাই পাওয়া যায়। তবে এদের ভারতের স্থানীয় পশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে দক্ষিণে ভারতের কর্ণাটক পর্যন্ত নীলগাইদের বসতি। তবে আসাম ও মালাবারে এদের দেখা পাওয়া যায় না। ভারতের রাজস্থান ও গুজরাটের গভীর অরণ্যে প্রচুর নীলগাই দেখা যায়। এ ছাড়া পুরোনো নথিপত্রে দাক্ষিণাত্যে নীলগাই থাকার কথা পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, সেগুলো বুনো নীলগাই ছিল। অতীতে বেঙ্গালুরুর উত্তর দিকে কিছু নীলগাই ছিল এবং এখনো থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
নেপালে দক্ষিণাঞ্চলের নিচু ভূমিতে নীলগাই পাওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে নীলগাই পাওয়া যায় মার্কিন মুলুকে। ১৯২০ সালে দর্শণার্থীদের বিনোদনের জন্য টেক্সাসে বেশ কিছু নীলগাই ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে বেশ কিছু নীলগাই দলছুট হয়ে টেক্সাসের দক্ষিণাঞ্চলে বংশবিস্তার করেছে। এরা সাধারণত ঘন অরণ্য এড়িয়ে চলে। এদের মাঝেমধ্যে কৃষিজমিতে ফসল খেতে দেখা যায়।
ফসল নষ্ট করে বলে ভারতের কিছু অঞ্চলে লাইসেন্স নিয়ে নীলগাই নিধন করার অনুমতি আছে। ভারতে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ নীলগাই রয়েছে। আমেরিকা মহাদেশে নীলগাইদের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজারের মতো।
প্রাণিজগতে বহু প্রজাতির পুরুষ প্রাণী নারীসঙ্গের জন্য প্রতিযোগিতা করে থাকে। নীলগাইও ব্যতিক্রম নয়। প্রজননক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য পুরুষ নীলগাই মাদিদের মন জয় করার জন্য ঘাড় সোজা করে নিজেদের সুদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে। কিন্তু ঝামেলা শুরু হয় যখন একাধিক নীলগাইয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। তখন সাধারণ রূপ প্রদর্শনী পরিণত হয় শিং-যুদ্ধে। নীলগাইয়ের চামড়া মোটা হলেও মাঝেমধ্যে সংঘাতে অনেকে গুরুতর আহত হয়। তবে এই প্রতিযোগিতা মাদিদের মধ্যেও দেখা যায়। এদের শিং না থাকায় এরা ঘাড় দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে।
প্রতিযোগিতা শেষে একটি পুরুষ নীলগাই একাধিক মাদির সঙ্গে মিলিত হয়। এরা সামাজিকভাবে নির্দিষ্ট সঙ্গী নিয়ে ঘোরাফেরা করে না। একটি নীলগাই গড়ে ২৪৩ দিন গর্ভবতী থাকে। প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে এরা যমজ শাবকের জন্ম দেয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ১ থেকে ৩টি শাবকের জন্ম হয়। নীলগাই শাবকের গড় ওজন ১৪ থেকে ১৬ কেজি। শাবক জন্ম নেওয়ার পর মা নীলগাই কিছুদিন একাকী সন্তানের সঙ্গে বসবাস করে। শাবকগুলো খুব ডানপিটে স্বভাবের হয়। জন্মের ৪০ মিনিটের মাথায় এরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। এক মাসের মধ্যে এরা নিজের খাবার খুঁজতে পারে। পুরুষ শাবক তিন বছর এবং মাদি শাবক দুই বছরের মাথায় প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে। তবে প্রজননক্রিয়ার জন্য এরা চার বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করে।
কোনো প্রাণী বিপন্ন, বিলুপ্ত বা সংকটাপন্ন হলে তাকে চিহ্নিত করে তালিকা প্রণয়ন করে UCN (International Union for Conservation of Nature) নামক সংস্থা। IUCN-এর তালিকায় নীলগাই নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সহজ কথায়, নীলগাই বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় থাকা বা বিপন্ন প্রাণী নয়। কিন্তু এমন ঝুঁকিতে থাকা একটি প্রাণী বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
ভারত বিভাজনেরও আগে শেষবারের মতো এই অঞ্চলে নীলগাই দেখা গিয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও আশপাশের জেলাগুলোতে নীলগাইয়ের বিচরণ ছিল। তবে বন উজাড় এবং অবাধ শিকারের কারণে এদের সংখ্যা দিনে দিনে কমতে থাকে। বাংলাদেশের সর্বশেষ স্থানীয় নীলগাইয়ের নিবাস ছিল পঞ্চগড়ে। ১৯৪০ সালের পর নীলগাই বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত ঘোষিত হয়। তবে সুসংবাদ হচ্ছে, স্থানীয় নীলগাই না থাকলেও বাংলাদেশে এখনো চারটি নীলগাই রয়েছে।
২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ভারত থেকে আসে মাদি নীলগাই। ২০১৯ সালে নওগাঁয় আরেকটি নীলগাই ধরা পড়ে। সেটি ছিল পুরুষ। পরে বংশবৃদ্ধির জন্য স্ত্রী ও পুরুষ নীলগাইকে রামসাগর জাতীয় উদ্যানে রাখা হয়েছিল। ২০১৯ সালের ১৬ মার্চ মাদি নীলগাইটি দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ায় একা হয়ে পড়ে পুরুষ নীলগাই। এর মাধ্যমে নীলগাই বংশবিস্তারের পরিকল্পনা ব্যাহত হয়। তবে ২০২০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে কাদায় আটকে পড়া একটি মাদি নীলগাই উদ্ধার করা হয়। এখন এ দুটির মাধ্যমে বংশবিস্তারের পরিকল্পনা চলছে।
বন বিভাগ ঠাকুরগাঁওয়ের রেঞ্জ অফিসার হরিপদ দেবনাথ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত চার বছরে চারটি নীলগাই ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন উপজেলার সীমান্তে পাওয়া গেছে। ২০২১ সালের ৯ মার্চ বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ধনতলা ইউনিয়নে একটি নীলগাই আটক করে স্থানীয়রা। সীমান্ত এলাকায় হওয়া সেটি বিজিবির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, একই বছরের ২৬ নভেম্বর হরিপুর সীমান্তবর্তী মিনাপুর এলাকায় পুলিশ-গ্রামবাসীর তাড়া খেয়ে একটি পুরুষ নীলগাই মারা যায়। পরে ২০২২ সালের ৮ জানুয়ারি পীরগঞ্জে বৈরচুনা ইউনিয়নের জগন্নাথপুর শালবাগানের সীমান্ত এলাকায় একটি নীলগাই আটক করে এলাকাবাসী। সেটি বিজিবি ক্যাম্প-১-এর নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। একই বছরের ১২ মে রাণীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড় ইউনিয়নের মন্ডলপাড়া গ্রামে একটি নীলগাই আটক করে এলাকাবাসী। সেটিকে জবাই করে ফেলে এলাকাবাসী। এটি নিয়ে মামলা চলমান রয়েছে।
জেলার চারটি নীলগাইয়ের মধ্যে দুটি বিজিবির নিয়ন্ত্রণে আছে। একটি মারা যায় এবং একটিকে জবাই করে স্থানীয় জনগণ।
দুটি নীলগাইয়ের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁও বিজিবির ব্যাটালিয়ন-৫০ অধিনায়ক লে. কর্নেল শহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে আমাদের কাছে কোনো নীলগাই নেই। যখন এদের আটক হয়েছিল, আমি ছিলাম না। সে বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।
এম এ সামাদ/এনএ