তোমরা আমাকে বাঁচাও, আমি তোমাদের শ্যামা
ময়লা-আবর্জনার স্তূপ থেকে হঠাৎ কান্নার আওয়াজ। ছোট্ট এক শিশু একা বসে হাউমাউ করে কাঁদছে। সে বলছে, ‘তোমরা আমাকে বাঁচাও, আমি শ্যামা। তোমাদের শ্যামা। সেই ১৮৯০ সাল থেকে তোমাদের ঘরবাড়ির পানি আমার বুকে নেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। কিন্তু দিনে দিনে তোমরা আমাকে ভুলে যাচ্ছ। আমার বুকে ময়লা-আবর্জনা ফেলে আমাকে ভরাট করছ। এভাবে ভরাট করলে তো তোমাদের ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে যাবে।
‘তোমাদের মনে নেই, গতবার ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে গিয়েছিল। তোমরা যদি আমাকে একদম ভরাট করে ফেলো, তাহলে তো আমি আর তোমাদের পানি আমার বুকে নিতে পারব না। যখন বর্ষাকাল আসবে, তখন পানি নিতে পারব না। তোমাদের ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে যাবে।’
এমন সময় কেউ একজন শ্যামার বুকে ময়লার ব্যাগ ছুড়ে মারে। তখন শ্যামা চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘আহ্ আহ্, কে ফেলল, কেন ফেলল? কেন ফেলল? তোমরা এ রকম করিয়ো না। তাহলে আমি ভরাট হয়ে যাব। ভরাট হয়ে যাব।’
শিশু জান্নাতুল মাওয়ার বয়স ছয়ের কাছাকাছি। রোববার (৫ জুন) বিকেলে যখন তার খেলার কথা, ঠিক ওই সময়টায় রংপুর নগরীর কটকিপাড়ার পিটিআই সেতু-সংলগ্ন শ্যামাসুন্দরী খালের পাশে ময়লা-আর্বজনার স্তূপে বসে এভাবেই কান্না করছিল।
মূলত বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে নগরবাসীকে সচেতন করার জন্য রংপুরের ১৩২ বছর বয়সী শ্যামাসুন্দরী খালটি বাঁচাতে এমন আয়োজন। দখল, দূষণ আর ময়লা-আবর্জনার স্তূপে ভরাট হয়ে এটি এখন মৃতপ্রায়।
শ্যামাসুন্দরী খালের বুকে আগের মতো নেই পানিপ্রবাহ। বরং বছরের পর বছর ধরে অবহেলায় নিজের সৌন্দর্য হারিয়েছে শ্যামাসুন্দরী। এখন খালের কালো বর্ণ ধারণ করা দূষিত পানি আর ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে এর পাশ দিয়ে হাঁটাও দুষ্কর। শুধু তা-ই নয়, এই খাল এখন মশা প্রজননেরও কারখানা। তাই মনোরম পরিবেশ দেওয়ার বদলে এটি এখন নগরবাসীর জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রংপুরের দ্য মিলিনিয়াম স্টারস স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম শ্রেণিপড়ুয়া জান্নাতুল মাওয়া তার মায়ের হাত ধরে প্রতিদিন এই খালের পথ ধরেই চলাফেরা করে। খালের এই নোংরা দশায় মন ভেঙেছে তার। তাই মা মনিরা আকতারের পরামর্শে বিশ্ব পরিবেশ দিবসে শ্যামা চরিত্রে প্রতীকী অভিনয় করে খালের বর্তমান ভগ্নদশা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে মাওয়া। নগরবাসীসহ সব মানুষের প্রতি নদ-নদী, খাল-বিলকে বাঁচানোর জন্য আশ্রুসিক্ত কণ্ঠে জানিয়েছে আকুতি। মাওয়ার এই অভিনয়ের ভিডিওটি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।
মাওয়ার মা রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক মনিরা আকতার ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শ্যামাসুন্দরী রক্ষায় নানা পরিকল্পনার কথা শুনে আসছি। কিন্তু বাস্তবে কোনো অগ্রগতি নেই। শ্যামাসুন্দরী খালের বর্তমান অবস্থার জন্য সিটি মেয়র দায়ী নন, আমরাই দায়ী। কারণ, এই খালের আশপাশে আমরা যারা আছি, থাকছি, তাদের দ্বারাই খালটি দূষিত হচ্ছে। আমাদের সচেতন হতে হবে। মানুষকে সচেতন করতে সিটি করপোরেশনকে উদ্যোগ নিতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রংপুর মহানগরের সভাপতি অধ্যক্ষ খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু জানান, পরিকল্পনা মাফিক কোনো উন্নয়নকাজ না হওয়ায় শ্যামাসুন্দরী খালটি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। একসময়ের ৬০ ফুট চওড়া খালটি বর্তমানে ১০ থেকে ১৫ ফুটে এসে ঠেকেছে। খালের বেশির ভাগই দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালী লোকজন। আবার কোথাও কোথাও ভরাট হয়ে গেছে ময়লা-আবর্জনায়।
সম্প্রতি খাল থেকে কচুরিপানা ও ময়লা-আবর্জনা তুলে খালের দুপাশে রেখে খালটি কিছুটা পরিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু মশার উপদ্রব কমেনি। বরং খাল সংস্কার ও খনন না হওয়ার কারণে বর্ষায় শহরের জলাবদ্ধতা দূর হচ্ছে না।
রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান বলেন, শ্যামাসুন্দরী খাল পরিকল্পিতভাবে সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। খালের কেমন সংস্কার প্রয়োজন, তার জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে ১৭০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছি। এ ছাড়া পাউবো খাল পুনঃখননে একটি উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণ আমাদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত দ্রুত রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন হবে, ততই এই নগরের জন্য ভালো হবে।
প্রসঙ্গত, জলাবদ্ধতা দূর ও ম্যালেরিয়ার হাত থেকে রংপুরকে মুক্ত রাখতে পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান ও ডিমলার রাজা জানকী বল্লভ সেন ১৮৯০ সালে তার মা চৌধুরানী শ্যামাসুন্দরী দেবীর নামে খালটি পুনঃখনন করেন। ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ খালের সম্মুখে রয়েছে নগরীর কেলাবন্দের ঘাঘট নদ। সেখান থেকে শুরু করে নগরীর ধাপ পাশারীপাড়া, কেরানীপাড়া, মুন্সীপাড়া, ইঞ্জিনিয়ারপাড়া, গোমস্তাপাড়া, সেনপাড়া, মুলাটোল, তেঁতুলতলা শাপলা সেতু, নূরপুর, বৈরাগীপাড়া হয়ে মাহিগঞ্জের মরা ঘাঘটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
দীর্ঘদিন থেকে সংস্কার না করায় শ্যামাসুন্দরী খালটি নাব্যতা হারিয়েছে। এর দুই পাশ অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ায় সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে খালটি। সামান্য বৃষ্টিতেই গোটা শহরে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। করোনার প্রকোপের আগে খালের উৎসমুখ থেকে মাহিগঞ্জ পাটবাড়ি পর্যন্ত খালের দুই পাশের প্রায় ১০ কিলোমিটার সংস্কারকাজ হাতে নেওয়া হয়।
এর জন্য আগে রংপুর বিভাগীয় প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় হাল জরিপ করা হয়েছে। মৌজাভিত্তিক কেল্লাবন্দ, রাধাবল্লভ, আলমনগর, রঘুনাথগঞ্জ ও ভগি এলাকার ১৭০ জনকে অবৈধ দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। খালটিকে ঘিরে উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি।
এনএ