ভাঙনে দিশেহারা তিস্তাপাড়ের মানুষ

তিস্তাপাড়ের বাসিন্দা মিনু বেওয়া (৭০)। তার স্বামী খোরশেদ মারা গেছেন প্রায় ১১ বছর। এরই মধ্যে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তিস্তাপাড়ে স্বামীর দেওয়া জমিতে থাকতেন তিনি। কিন্তু সেই জমিটুকুও কেড়ে নিয়েছে তিস্তা। তাই নিজের ঘরটি সরাতে ব্যস্ত তিনি। ঘরসহ আসবাবপত্র রাখার জায়গাও নেই তার।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের খামারটারী ও পূর্ব কালমাটি গ্রামের বাসিন্দা মিনু বেওয়া। তার মতো ওই গ্রামের শতাধিক পরিবারের বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
ভাঙনের মুখে পড়েছে চোংগাডারা উচ্চ বিদ্যালয়, খুনিয়াগাছ ইউনিয়ন পরিষদ, ভূমি অফিস, খুনিয়াগাছ উচ্চ বিদ্যালয়সহ নানা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। নদীর কিনারায় পড়েছে নির্মাণাধীন চোংগাডারা উচ্চ বিদ্যালয়ের চারতলা ভবনসহ শতাধিক বসতবাড়িও। মিনু বেওয়া বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্টে সন্তানদের বড় করে বিয়ে দিয়েছি। তারা এখন অনেক ভালো আছে। কিন্তু আমি ভালো নেই।

তিনি বলেন, পূর্ব কালমাটি গ্রামটি অনেক বড় ছিল। এখন ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আমার বাড়িতে হানা দিয়েছে। তাই বাড়ি সরিয়ে নিতে হচ্ছে। এই জমিটি ৩০ হাজার টাকায় বন্ধক নিয়ে তিনটি ঘর করে দুই ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছিলাম। সেই বসতভিটাও নদীর মুখে পড়েছে। বন্ধক নেওয়া জমি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় বন্ধকের ৩০ হাজার টাকাও দিচ্ছেন না জমির মালিক। এখন কোথায় যাব মাথায় আসছে না আমার। অন্যের জমিতে ভাঙা ঘরবাড়ি রাখতে হাতে-পায়ে ধরছি, কেউ জায়গা দিচ্ছে না। এখন কী করব বুঝতে পারছি না।
স্থানীয়রা জানান, গত সোমবার (১ আগস্ট) ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ মিটার ৮৫ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার (স্বাভাবিক ৫২ মিটার ৬০ সেন্টিমিটার) ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর পরের দিন পানি কমে ফের বিপৎসীমার ওপরে উঠে তিস্তার পানি। এতে ৪৪টি গেট খুলে দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন।
জানা গেছে, ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ঐতিহাসিক তিস্তা নদী। যা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশে যায়। দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার।
ভারতের গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভারত সরকার এক তরফা তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করায় শীতের আগেই বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরুভূমিতে পরিণত হয়। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে বাংলাদেশ অংশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। বন্যায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তিস্তার বাম তীরের জেলা লালমনিরহাট।

তিস্তা নদী জন্মলগ্ন থেকে খনন না করায় পলি পড়ে ভরাট হয়েছে নদীর তলদেশ। ফলে পানি প্রবাহের পথ না পেয়ে বর্ষাকালে উজানের ঢেউয়ে লালমনিরহাটসহ ৫টি জেলায় ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। এ সময় নদী ভাঙনও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। প্রতি বছরই নদী পরিবর্তন করছে তার গতিপথ। ফলে লালমনিরহাটে বিস্তীর্ণ জমি বালুময় চরাঞ্চলে পরিণত হচ্ছে।
বর্ষায় ভয়াবহ বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ভাঙনের কবলে পড়েন তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা। গেল সপ্তাহে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই তীব্র ভাঙনের মুখে পড়ে নদীপাড়ের মানুষ। এক একটি পরিবার ৮-১০ বার নদী ভাঙনের কবলে পড়ে সরিয়ে নিয়েছেন বসতভিটা। কেউ কেউ রাস্তার ধারে বা বাঁধের পাশে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
ওই গ্রামের লোকমান, রহমান, আছিয়াসহ অনেকেই বলেন, নদীর গর্ভে সব জমি চলে গেছে। বাকি বসতভিটার ৭ শতক জমি আছে সেটিও নদীতে যাওয়ার পথে। এই জমি চলে গেলে আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবে। কয়েকদিন আগে উপজেলা চেয়ারম্যান কিছু জিও ব্যাগ দিয়ে কোনো রকম ভাঙনটা রক্ষা করেছেন। না হলে এতদিনে এ গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হতো। রিলিফ নয়, দ্রুত নদী খনন করে স্থায়ী সমাধান দাবি করেন তারা।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, প্রতি বছর তিস্তাপাড়ের মানুষ এই কষ্টে পড়েন। সেই কষ্ট লাঘব করতে তিস্তাপাড়ের মানুষের সঙ্গে আমরা কাজ করি। তবে এবার আগের থেকে কিছুটা ভাঙন কমেছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে কাজ চলমান রয়েছে।
নিয়াজ আহমেদ সিপন/আরএআর