করতোয়ায় নৌকাডুবিতে পূজার আনন্দ ম্লান
রাত পোহালেই শুরু হবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। পাঁচ দিনের দুর্গোৎসবে মাতবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তবে এ বছর পঞ্চগড়ের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজার সব আনন্দই তলিয়ে গেছে করতোয়ায়। নৌ দুর্ঘটনার রেশ এবারের দুর্গাপূজায়ও।
জেলার পূজা মণ্ডপগুলোতে নেই ঢাকের বাড়ি-শাঁখের আওয়াজ। নেই গৃহিণীর উলুধ্বনি। আছে কেবল শোকে স্তব্ধ স্বজনের কান্নার শব্দ। আল্পনা আঁকার কথা ছিল মণ্ডপের আঙিনায়, কিন্তু চন্দনের ফোঁটা আঁকতে হয়েছে মৃত স্বজনের কপালে। দেবীর আরতির ধুপের বদলে গ্রামে গ্রামে জ্বলেছে স্বজন-প্রতিবেশীদের চিতা।
কেউ হারিয়েছেন সন্তান, কেউ বাবা, কেউবা মা, কেউবা আপন বোন কিংবা নিকটাত্মীয়। কোনো কোনো পরিবারে হারিয়েছে তিন থেকে চারজনকে। উৎসবের রং যে এতটা কষ্টের হতে পারে, তা মেনে নিতে পারছে না শোকে বিহ্বল পরিবারগুলো।
দুর্গাপূজা শুরুর প্রাক্কালে চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে আমন্ত্রণ জানাতে মহালয়ার দিন পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরে দুর্গার আবাহন উপলক্ষে আয়োজন করা হয় বিশাল এক ধর্মসভার। এতে যোগ দিতে ধর্মাবলম্বীরা নদী পেরিয়ে মূলত ওই মন্দিরেই যাচ্ছিলেন। সবার ইচ্ছে ছিল বোধন থেকে বিসর্জন পর্যন্ত দুর্গার পূজা করে আনন্দের সঙ্গে এই বড় ধর্মীয় উৎসব পালন করার। নতুন পোশাক আর রঙিন সাজ নিয়ে শতাধিক মানুষ ওঠেন নৌকায়। কিন্তু ধারণক্ষমতার থেকে বেশি যাত্রী উঠায় ঘাট থেকে কিছুদূর যাওয়ার পরই তীব্র স্রোতে উল্টে যায় নৌকাটি।
সে সময় কিছু লোক সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও নারী ও শিশুরা পানিতে ডুবে যায়। পরে একে একে উদ্ধার করা হয় ৬৯টি মরদেহ। এর মধ্যে ৬৮ জনই সনাতন ধর্মের। কেবলমাত্র মাঝি হাশেম আলীই ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এছাড়া আরও তিনজন এখনো নিখোঁজ। এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় শোকে স্তব্ধ পুরো জেলা। শোকে ম্লান পঞ্চগড়ের ২৯৫টি পূজা মণ্ডপের শারদীয় দুর্গোৎসব।
ডুবে যাওয়া নৌকার যাত্রী ছিলেন বোদা উপজেলার ময়দানদিঘী এলাকার হিমালয় ও তার স্ত্রী বন্যা রানী। তার স্ত্রী কোনোভাবে বেঁচে ফিরলেও গত বুধবার মরদেহ পাওয়া যায় হিমালেয়ের। তাকে খুঁজতে নদীপাড়ে বোন নীতি রানীর কান্না কাঁদিয়েছে সবাইকে। স্বামীকে হারিয়ে এখন বাকরুদ্ধ হয়ে শয্যাশায়ী বন্যা রানী। বার বার স্বামীকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়েছিলেন তিনি, ফিরে পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু মৃত। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় হিমালয়ের মা-বাবা।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার কাজলদিঘী গ্রামের বাসিন্দা ধীরেন চন্দ্র। আউলিয়া ঘাটে ভয়াবহ নৌকাডুবিতে জোতি ও জয়া নামে দুই মেয়েকে হারিয়েছেন তিনি। প্রথম দিনেই ছোট মেয়ে জ্যোতির মরদেহ পেলেও ছয় দিনেও খোঁজ মেলেনি বড় মেয়ে জয়ার। ছোট মেয়ের সৎকার করার পর বড় মেয়ের খোঁজে আউলিয়া ঘাট থেকে ইউনিয়ন পরিষদ আর পরিষদ থেকে ঘাটে ছয় দিন ধরে ছুটছেন ধীরেন চন্দ্র। নিজ হাতে বড় মেয়ের মরদেহ সৎকার করতে চান তিনি।
ধীরেন্দ্র চন্দ্র বলেন, ছোট মেয়ের সৎকার করেছি। এখনো বড় মেয়ের কোনো খোঁজ পাইনি। ঘটনার দিন থেকে ঘুরছি। কোনো কিছু খেতে পারছি না। খেয়ে না খেয়ে সময় পার হয়ে যাচ্ছে আমার। হোক মৃত, তবু আমার মেয়েকে আমার কোলে ফিরিয়ে দিন। আমার সব শেষ হয়ে গেল। কী নিয়ে বেঁচে থাকব আমি।
দেবীগঞ্জের শালডাঙা হাতিডোবার জলেশ্বরী রানীর গগন বিদারী আর্তনাদে স্তব্ধ পুরো এলাকা। একই পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হারিয়ে অনেকটা পাগলপ্রায় ষাটোর্ধ্ব জলেশ্বরী। করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাট থেকে বদেশ্বরী মন্দিরে যাওয়ার সময় নৌকাডুবির ঘটনা দেখেছেন নিজ চোখেই। তিনি ছিলেন অন্য নৌকায়। পাঁচ বছর বয়সী দীপংকর ও দেড় বছরের নাতি বিষ্ণুর স্মৃতিচারণ করে বিলাপ করছেন রাতভর।
বোদা উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের ছত্রশিকারপুর গ্রামের তিন বছর বয়সী দীপু। নৌকাতেই মা-বাবার সঙ্গে মহালয়া দেখতে যাচ্ছিল সে। নৌকাডুবিতে নিজে বেঁচে ফিরলেও মা রুপালি রানী ফিরেছেন লাশ হয়ে। আর বাবা ভুপেন্দ্র নাথ এখনো নিখোঁজ।
দীপুর বড় ভাই দীপেন বলেন, এই দুর্গোৎসব আমাদের এতিম আর নিঃস্ব করে দিল। এখন কীভাবে চলব আমরা? কারা আমাদের দেখাশুনা করবে? আমার ছোট দুই ভাইকে কীভাবে বড় করব? আমি এ শোক সইতে পারছি না। এত অল্প বয়সে মায়ের মরদেহ সৎকার করতে হবে ভাবিনি। এখনো আমার বাবার মরদেহ খুঁজে পাচ্ছি না।
স্বজনহারা পরিবারের মঙ্গলু চন্দ্র রায় বলেন, আমার পরিবারের তিনজনকে হারিয়েছি। ছেলে-মেয়ে এবং বউমাকে হারানোর এই ব্যাথা কীভাবে সহ্য করি। যাকে নিয়ে আমি চলে ফিরে খাই, সে চলে গেছে। আমি এখন কী করে চলবো? এই বয়সে। তীর্থস্থান যাওয়ার পথে তারা চলে গেছে, এখানে বলার কিছু নাই। এই শোক, কষ্ট আর সইতে পারছি না।
স্থানীয় সংসদ সদস্য ও রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, এমন নৌকাডুবির ঘটনা পঞ্চগড়ের মানুষ কখনো দেখেনি। এখানে প্রশাসনের গাফিলতি ছিল। আমাদের লোকও দেখেননি, ঘাটের লোকও দেখেননি। এটা একটা অবহেলা। যাত্রীদেরও অবহেলা আছে। মাঝিরও উচিত ছিল একসঙ্গে এত মানুষ নৌকায় না উঠানো। আর যারা ঘাটের দায়িত্বে ছিলেন তাদেরও দায়িত্বের অভাব ছিল। যদি দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটত না। কারা দায়িত্ব পালন করেছে আর কারা করেনি তা খতিয়ে দেখার জন্য জেলা থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন হাতে পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুর আড়াইটার দিকে উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। ঘটনার দিন ২৫ জন, দ্বিতীয় দিন ২৬ জন, তৃতীয় দিন ১৭ ও চতুর্থ দিন একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নৌকাডুবিতে মৃত ৬৯ জনের মধ্যে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ৪৫ জন, দেবীগঞ্জের ১৮ জন, আটোয়ারীর ২ জন, ঠাকুরগাঁওয়ের ৩ জন ও পঞ্চগড় সদরের ১ জন রয়েছেন। মৃত ৬৯ জনের মধ্যে নারী ৩০ জন এবং পুরুষ ১৮ জন। বাকি ২১ জন শিশু।
এদিকে নৌকাডুবির ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দীপঙ্কর রায়কে প্রধান করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। আগামী রোববার (২ অক্টোবর) কমিটি প্রতিবেদন জমা দেবে বলে জানা গেছে।
আরএআর