‘সবার রঙিন ছবি তুললেও আমার জীবনের ছবি সাদাকালোই থেকে গেল’

শারীরিক প্রতিবন্ধী মিন্টু ব্যানার্জী (৫১)। শৈশব কেটেছে সিলেটের চা বাগানে। সেখানে মালিকের নির্যাতনে পালিয়ে আসেন কক্সবাজার। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় কাজ শুরু করেন সৈকতের ফটোগ্রাফার হিসেবে। কিন্ত এই পেশায় ৩০ বছরেও তার ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। পেশায় ফটোগ্রাফার হলেও তার গান মন কাড়ে পর্যটকদের।
রোববার (২০ নভেম্বর) বিকেলে সৈকতের শৈবাল পয়েন্টে মিন্টু ব্যানার্জীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান জীবনের নানা দুঃখগাঁথা। এক ছেলে ও এক মেয়েসহ চারজনের পরিবার নিয়ে কক্সবাজার সমিতি পাড়ার একটি ঝুপড়ি ঘরে থাকেন। আলাপকালে মিন্টু হতাশ কণ্ঠে বললেন, ‘সারাজীবন সবার আনন্দের রঙিন ছবি ক্যামেরাবন্দী করেছি। কিন্তু আমার জীবনের ছবি সাদাকালোই থেকে গেল, রঙিন হলো না।’
মিন্টু ব্যানার্জী বলেন, প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর হাত ধরে অনেক গান গেয়েছি। আইয়ুব বাচ্চু আমার পিতৃতুল্য। ২০১০ সালে আইয়ুব বাচ্চু আমার কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে আমাকে ঢাকায় নিয়ে তার নিজস্ব স্টুডিওতে ১০টি গান দিয়ে একটি অ্যালবাম করে দেন। যে অ্যালবামের নাম ছিল মায়া। তিনি আমাকে ছবিছায়া উপাধি দেন।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমার পরিবারের অবস্থা তেমন ভালো না। নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা। আমি পড়াশোনা করতে পারিনি। আমার স্বপ্ন ছেলে-মেয়ে দুইজনকে পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করবো। ছেলে শ্রাবন এসএসসি দিয়েছে। তবে খরচ বহন করতে না পারায় তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়ে মিতু ব্যানার্জী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করছে। আমার যা আয় হয় তা দিয়ে ঠিকমতো সংসারই চলে না। সারাদিন পর্যটকদের ছবি তুলে ২শ থেকে ৩শ টাকা আয় হয়। মাঝেমধ্যে একদমই হয় না। কারণ আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি ও পানিতে নেমে ছবি তুলতে পারি না। তাই অনেকেই আমার থেকে ছবি তুলতে চাই না। মাঝেমধ্যে গান করে যা রোজগার হয় তা মেয়ের পড়াশোনার জন্য আলাদা করে রেখে দিই। দয়া করে আপনারা আমার মেয়েটিকে ডাক্তার বানানোর জন্য সহযোগিতা করুন।
মিন্টু ব্যানার্জী বলেন, ৩০ বছর ধরে সমুদ্রসৈকতে ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করছি। ২০ বছর ধরে পায়ের সমস্যার কারণে চলাচল করতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের সমস্যাও বেড়ে যাচ্ছে। টাকার অভাবে পায়ের চিকিৎসাও করতে পারছি না। তবুও বাঁচার তাগিদে সংগ্রাম করে যাচ্ছি। একদিন সৈকতে না গেলে খাবার জুটে না। তাই সব যন্ত্রণা এক পাশে রেখে পায়ে রশি বেঁধে সমুদ্রে আসতে হচ্ছে।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের শৈবাল পয়েন্টে মিন্টুর গানে মুগ্ধ হয়ে ৫শ টাকা দেন ঢাকা থেকে আগত পর্যটক শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, ফটোগ্রাফার মিন্টুর গান ফেসবুকে শুনেছি। আজ সরাসরি শুনে খুব ভাল লাগলো। প্রকৃত অর্থে তিনি একজন প্রতিভাবান শিল্পী। ভালো জায়গায় সুযোগ পেলে ভালো করতো। তার শারীরিক অবস্থাও তেমন ভালো না। পায়ে রশি বেঁধে যেভাবে ছবি তুলছেন এ যেন যুদ্ধ ময়দানের এক সৈনিক।
মিন্টু ব্যানার্জীর স্ত্রী তাপসী বানার্জী বলেন, আমার স্বামীর পায়ের অবস্থা তেমন ভালো না। কিন্তু কি আর করার। তিনি ছাড়া আয় করার কেউ নেই। পায়ে রশি বেঁধে এখন চলাফেরা করেন। আমাদের খাওয়াদাওয়া সবকিছু তার ক্যামেরার ওপর নির্ভর করে। তিনি যেদিন সমুদ্রসৈকতে না যান সেদিন আমাদের না খেয়ে থাকতে হয়। আপনারা যদি আমাদের একটু দয়া করেন তাহলে আমাদের পরিবারটা বাচঁবে।
এমজেইউ