স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে লড়ছেন ১৪৫ জন প্রতিবন্ধী

সমাজের দরিদ্র শ্রেণির নারী, তালাকপ্রাপ্ত নারী, বিধবাসহ বৃদ্ধদেরও চিকিৎসা সহায়তা এবং ওষুধ কেনারও ব্যবস্থা করে থাকে এই ট্রাস্ট। কম্পিউটার শেখানো থেকে শুরু করে পবিত্র কোরআন মাজিদও পড়ানো হচ্ছে এখানে। খুবই সামান্য পরিসরে যাত্রা শুরু করে প্রতিবন্ধীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে পাবনার ‘মানবকল্যাণ ট্রাস্ট’ সবার অন্তরে জায়গা করে নিয়েছে।
শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে সিংগা এলাকায় অবস্থিত তিন বিঘা জমির ওপর ১৯৯৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে দৃষ্টিশক্তিহীন, শারীরিক প্রতিবন্ধী, বধিরসহ ১৪৫ জন শিক্ষার্থী ট্রাস্টের আবাসিকে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছে।
ট্রাস্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত) আবুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবন্ধী, গরিব-দুঃখী, মেধাবী শিক্ষার্থী ছাড়াও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে ট্রাস্ট আর্থিকভাবে সাহায্য করে। দরিদ্র নারী, তালাকপ্রাপ্ত নারী, বিধবাসহ বৃদ্ধদেরও চিকিৎসাসহ ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। বিনামূল্যে কোরআন শিখতে আসা নারীদের যাতায়াত ভাড়াও প্রদান করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি হিজড়া জনগোষ্ঠীদের পুনর্বাসনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পাঁচজন হিজড়া এই ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন।
তিনি জানান, এই ট্রাস্টে ৫৫ জন দৃষ্টিশক্তিহীন, ১২ জন শারীরিক প্রতিবন্ধী, ১৮ জন বধিরসহ ১৪৫ জন শিক্ষার্থী, ১৫ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসব শিক্ষার্থী এখানে এসে অবস্থান করছেন। প্রাথমিকের গণ্ডির বাইরে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারীরাও রয়েছেন এখানে। তাদের মধ্যে ৫০ জন পবিত্র কোরআনে হাফেজ ও ২৫ জন শিক্ষার্থী এমএ পাস করে বিভিন্ন কর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। হাফিজুর রহমান নামের এখানকার একজন ছাত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিরত। রাজশাহীর মনছুর নামের ছাত্র পোশাকশিল্পে অফিসার পদে চকরিরত রয়েছেন বলে জানান।
এখানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা ব্রেইল পদ্ধতিতে পবিত্র কোরআনসহ বাংলা শিক্ষা গ্রহণ করেন। দুই হাতবিহীন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা দুই পা দিয়ে লেখালেখি করেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা দুই হাত দিয়েই সমানতালে লেখেন। মুখ ও বধির প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা ইশারায় তাদের ভাষা প্রকাশ করেন। দুই হাত দিয়ে এ থেকে জেড পর্যন্ত ইশারা করে দেখান তারা। স্কিন রিডার সফটওয়্যারের মাধ্যমে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শেখানো হয় কম্পিউটার।
ট্রাস্টের ভেতরে ঢুকতেই নজরে আসে দৃষ্টিনন্দন ফুলের বাগান। যেটা প্রতিবন্ধীদের জন্য করা হয়েছে। ছুটির দিনে তারাই ট্রাস্টের ফুলের বাগান পরিচর্যা ও মাঠ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন। নিজের থাকার রুম, টেবিল বই-খাতা খুবই গোছালোভাবে সাজিয়ে রাখেন তারা। নিজের যাবতীয় কাজ কারও সহযোগিতা ছাড়াই সম্পাদন করছেন। মোবাইলের বোতাম চেপে নিয়মিত ফোনে কথা বলছেন তারা।
ট্রাস্টের সার্বিক কর্মকাণ্ড এবং পরিবেশ দেখে অভিভূত হন এখানে ঘুরতে আসা মানুষ। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এই জেলায় বেড়াতে এলে মানসিক হাসপাতালের পাশাপাশি এই মানবকল্যাণ ট্রাস্ট পরিদর্শন না করে যান না তারা। শোনেন অন্ধ প্রতিবন্ধীদের মুখে পবিত্র কোরআন পড়া। আর এই কর্মযজ্ঞ দেখে আবেগে আপ্লুত হন সবাই। আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করেন দেখতে আসা মানুষেরা। শিক্ষা বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রতিবন্ধীদের প্রতিভা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়েছেন, দিয়েছেন পুরস্কার, করেছেন আর্থিক সহযোগিতা।
এসব মহতী কর্মকাণ্ড পরিচালনা কোনো একক ব্যক্তির পক্ষে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তাই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাসহ সমাজের বিত্তশীলদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠানটিকে আরও বহুদূর এগিয়ে নিতে সহযোগিতার আহ্বান জানান।
তোফায়েল আহমেদ নামে শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এখানে ব্রেইল পদ্ধতিতে পবিত্র কোরআন মাজিদ শিক্ষা নিচ্ছি। মক্তব থেকে পড়াশোনা শুরু করে এখন পুরো কোরআন মাজিদ মুখস্থ করেছি। প্রথমে কঠিন মনে হলেও এখন অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে। ভালোভাবেই কোরআন পড়তে পারি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী রাসেল আহমেদ বলেন, আমি এখানে আবাসিকে থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সম্প্রতি করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এখানে কম্পিউটার শিখতে এসেছি।
শহীদ এম মনসুর আলী কলেজের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রোস্তম আলী বলেন, আমি কম্পিউটার শিখে একজন দক্ষ প্রোগ্রামার হতে চাই, কস্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই, সে জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছি।
কম্পিউটার শিক্ষক আলহাজ উদ্দিন বলেন, আমি এই ট্রাস্টে আবাসিকে থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করি। পরে কম্পিউটার শিক্ষক হিসেবে এখানে যোগদান করি। স্কিন রিডার সফটওয়্যারের মাধ্যমে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। দুই ব্যাচে মিলে ৩০ জন প্রতিবন্ধী এখানে কম্পিউটার শিখছে।
শিক্ষক রহমত আলী বলেন, আমি এখানে নতুন চাকরিতে যোগদান করেছি। শিশুদের কোরআন মাজিদের প্রাথমিক শিক্ষা দিই। এই অল্প সময়ে দেখছি এখানে যত অন্ধ প্রতিবন্ধী লেখাপড়া করে, সবাই খুব মেধাবী এবং বিভিন্ন গুণে গুণান্বিত। আবাসিকে অবস্থান করে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করছে, জিপিএ-৫-এর মতো কৃতিত্ব অর্জন করছে তারা, এটা খুবই চমৎকার ব্যাপার।
ট্রাস্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল হোসেন দাবি করেন, প্রতিষ্ঠানটি শুধু পাবনা নয়, দেশ-বিদেশের সব ধরনের প্রতিবন্ধীর আশ্রয়স্থল। সব অসহায় প্রতিবন্ধীর আশ্রয়কেন্দ্র বানাতে চাই, বিশ্বমানের একটি জাদুঘর করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি, হিজড়াদের পুনর্বাসনের কাজ হাতে নিয়েছে, অচিরেই সব বাস্তবায়িত হবে আশা করেন তিনি। সেই সঙ্গে দেশ-বিদেশ থেকেও সরকারি-বেসরকারি আর্থিক সহযোগিতা পেলে প্রতিষ্ঠানটি আরও সুন্দর ও আধুনিকায়ন করা করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।
পাবনার জেলা প্রশাসক মো. কবির মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানবকল্যাণ ট্রাস্ট যে কাজগুলো করছে, সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। তাদের কাজ ইতোমধ্যেই স্বীকৃতি লাভ করেছে। তাদের ট্রেইনার পদ্ধতি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। অন্ধদের জন্য তারা কাজ করছে, এটা অতি মহতী উদ্যোগ। জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে, করোনাকালীন, এই শীতে তাদের সহযোগিতা করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা সব সময় থাকবে। মানবতার সেবায় কাজ করছে তাদের জন্য শুভকামনা থাকবে।
এনএ