আমার জমি আছে, তবু ঘর পেলাম না

পঞ্চগড়ের সদর উপজেলা ১ নম্বর অমরখানা ইউনিয়নের মধুপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আঞ্জুয়ারা বেগম। ওই এলাকার মৃত আনিছুর রহমানের একমাত্র সন্তান তিনি। বয়স প্রায় ৪০ বছর ছুঁইছুঁই। ওই এলাকার আর কয়েক জন নারী মতোই ১৮ বছর বয়সে পাশের এলাকার ইব্রাহিম নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে হয় আঞ্জুয়ারা বেগমের।
বিয়ে হওয়ার কিছুদিন পর তাদের কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক পুত্রসন্তান। কিন্তু তার চার মাস বয়সের শিশুকে রেখে তার স্বামী ইব্রাহিম তাদের অন্যত্র চলে গিয়ে করে আরেকটি বিয়ে করেন ৷ পরে স্বামীর বাড়ি থেকে ফিরে এসে তার ঠাঁই হয় গরিব বাবা-মায়ের বাড়িতে। মনের কষ্ট আর বিয়ে না করে তার বাবা-মা ও তার ছেলেকে বাঁচানোর জন্য শুরু হয় আঞ্জুয়ারার জীবনসংগ্রাম।
জীবনের তাগিদে দুই বেলা নুন-ভাত জোগাড়ে কখনো মানুষের বাড়িতে, কখনো মাঠে কামলা দিয়ে সংসারের হাল ধরেন। এভাবে মৌসুমভেদে বিভিন্ন কাজ করে দুধের শিশুকে বড় করেন। একমাত্র ছেলে জয়নাল আবেদিনকে বিয়ে দেন তিনি। ছেলে ঘরে দুই নাতি থাকলেও ছেলে তার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে থাকেন অন্যখানে। তিনিও পেশায় দিনমজুর।
শুধু তা-ই নয়, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে আঞ্জুয়ারা বেগম মানুষের বাড়িতে কাজ করে টাকা জমান। কয়েক বছর আগে প্রায় আট শতক জমি কিনে বসবাসের জন্য গড়ে তোলেন জমির এক কোণে দুটি ঘর। কষ্ট করে জমি কিনে কোনো রকমভাবে ঘর নির্মাণ করলেও তা বসবাসের অযোগ্য।
অন্যদিকে অভাব দূর করতে স্থায়ী তেমন কোনো কাজ না পেয়ে শুরু করেন পিঠার দোকান। তিনি ভোরবেলা প্রতিদিন পিঠা তৈরি করে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে পিঠা বিক্রি করেন। পিঠা তৈরির চালের গুঁড়ার জন্য তাকে বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে যেতে হতো। তাই তিনি বাড়িতে ছোট একটি ঢেঁকি তৈরি করেন। এখন ঢেঁকিতেই চালের গুঁড়া তৈরি করেন।
সরেজমিনে আঞ্জুয়ারা বেগমের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় তার জীবনযুদ্ধে বসবাস ও চলাচলের করুণ অবস্থা। আর নিজ জমিতে প্লাস্টিক, পাটখড়ি, ছেঁড়া বস্তা ও কয়েকটা ওপরে ছিদ্রওয়ালা টিন দিয়ে তৈরি করা দুটি ঘর। শীত ও বর্ষায় এভাবেই তিনি জীবনযাপন করেন এই জরাজীর্ণ ঘরে। টয়লেট ও টিউবওয়েল থাকলেও বেড়া দিয়েছেন কাপড় ও ছেঁড়া বস্তা দিয়ে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে বিভিন্ন সময়ে সাহায্যের আবেদন করলেও এতে তিনি কোনো সাড়া মেলেনি। তা ছাড়া ওই এলাকায় গত বছর ‘ভূমি আছে ঘর নাই’ এমন সরকারি প্রকল্প এলেও এতে তালিকায় ওঠেনি তার নাম। বিধবা ভাতার জন্য আবেদন করলেও এতে ভাতার বদলে জুটে তার কপালে অবহেলা।
এ বিষয়ে আঞ্জুয়ারা বেগম ঢাকা পোস্টকে জানান, স্বামী ও সন্তান অন্যত্র চলে যাওয়ার পর জীবন বাঁচাতে নেমে পড়ি কর্মের খোঁজে। একসময় পাথরের মেশিনে, স্থানীয় মানুষের বাড়িতে কাজ করছি। কিন্তু একদিন কাজ করলেও দুই দিন বসে থাকতে হতো। পরে আমি স্থায়ী কাজ না পাওয়ায় কয়েক বছর ধরে গ্রামে গ্রামে পিঠা তৈরি করে বিক্রি শুরু করি। প্রতিদিন পিঠা বিক্রি করে যা পাই, তা দিয়ে কোনো রকম চলি। আমি দীর্ঘদিন এসব কাজ করে টাকাপয়সা জমিয়ে ও ধারদেনা করে বসতবাড়ির জন্য জমি কিনেছি। কিন্তু এখন ঘর তৈরি করতে পারিনি। খুব আশা ছিল, কিন্তু ঘর তৈরির স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল।
তিনি বলেন, আমি আগের মতো পিঠার পাতিল মাথায় নিয়ে ঘুরতে পারি না। বৃষ্টির দিনে টিনের ছিদ্র দিয়ে ঘরে পানি পড়ে। বাতাস উঠলে বেড়ার ছিদ্র দিয়ে বাতাস ঢোকে, ঘর নড়াচড়া করে। আর শীতকালে ঠান্ডা বাতাস ঢোকায় ঘুমাতে পারছি না। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, মানুষের কিছুই নাই। তারপরও ঘর পায়। আমি কষ্ট করে জমি কিনেছি, তাও ঘর বা কোনো সহযোগিতা পাই না। আমি একটু সাহায্য পাওয়ার আশায় অনেকবারই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারের কাছে গিয়েছি কিন্তু কেউ আমার দিকে দেখছে না। প্রধানমন্ত্রী তো গরিবদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করছে। আমি কিছুই পাই না।
এদিকে মধুপাড়া এলাকার আঞ্জুয়ারা বেগমের প্রতিবেশী ছয়ফুন বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকে আঞ্জুয়ারা একটি ভাঙা ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তিনি পিঠা বিক্রি করে চলেন কিন্তু গরিব হিসেবে কোনো রকম সহযোগিতা সরকারের পক্ষ থেকে পান না। তিনি আগের মতো কাজ করতে পারেন না। আমরা প্রায় তাকে চালের গুঁড়া তৈরি করতে সহযোগিতা করি।
এ বিষয়ে পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফ হোসেন বলেন, আঞ্জুয়ারার বাড়িতে গিয়ে তাকে কয়েক দিন আগে কম্বল দিয়েছি। আগামী এক মাসের মধ্যে তাকে নতুন ঘর দেওয়া হবে। আশা করছি আগামী সাত দিনের মধ্যে ঘরের কাজ শুরু হবে। তাকে ভাতাও দেওয়া হবে। পাশাপাশি নিজেও তাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করব, যাতে তিনি ভালোভাবে থাকতে পারেন।
এনএ