‘বেচা না হলে গরুর খামারত দিবার লাগিবে’

‘শুরুতে ৬ টাকা ৭ টাকা পিস পাইছি, লাস্টে তো ২ টাকা ৩ টাকাতে আসছে। আবাদ করিয়া তো লাভ নাই। এক কেজি বীজের দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। ৪ বিঘা মাটি আবাদ করি খরচের টাকাই উঠে না। বর্তমানে ৪ টাকা টাকা পিস কয়ছে, বেচা না হলে বাকিগুলো নিগি গরুর খামারত দিবার লাগিবে। সেখানে ১ টাকা দেড় টাকা পিস দিবে।’
কথাগুলো বলছিলেন নীলফামারী সদর উপজেলার খোকসাবাড়ি ইউনিয়নের ফুলকপি চাষি সাফিয়ার রহমান। প্রতি বছরের মতো এবারও চার বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছেন তিনি। ফুলকপির বাম্পার ফলন হলেও বাজারে বর্তমানে উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় হতাশ তিনি। সাফিয়ার রহমানের মতো ফুলকপি চাষ করে একইভাবে হতাশ হয়ে পড়েছেন এই অঞ্চলের কৃষকেরা।
গত বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) শহরের বড় বাজারের পাইকারী সবজি বাজারে কয়েকজন সবজি চাষির সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের। সৈয়দপুর উপজেলার বোতলাগাড়ির হুগলিপাড়া থেকে ফুলকপি বিক্রি করতে এসেছেন হাবিবুর রহমান।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আগাম আবাদ করছি ৫ বিঘার মতো, সেটার দেড় বিঘার মতো বিক্রি হইছে, আর তিন বিঘার মতো মানুষে কাটি ধরি গেইছে। এক সমান গরু-ছাগল লাগে দিয়ে খাওয়াইছে, কাটি নিয়া মানুষ খাইছে। আর এটা নমলা উঠছে প্রায় তিন বিঘার মতো। তিন দিন নিয়ে আসলাম এই বাজারে। ৭ টাকা ৮ টাকা করে সকাল বেলা বাজার পাওয়া যায়। দুই ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টার মধ্যে যদি বিক্রি না হয় তাহলে মনে করে যে ফেলে দেওয়ার দাম ৩ টাকা ৪ টাকা পিস বিক্রি করতে হয়। বিক্রি করির না পাইলে গরুর পাটিকে দেওয়া লাগবে দেড় টাকা দুই টাকা পিস হিসেবে দিয়ে যাওয়ার লাগবে। মাল তো বাজা অনুযায়ী লাভ নাই। খালি গাড়ি ভাড়া আইসে, আর ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা ক্যাশ হয়। আড়তদারকে দিতে হয়, আরও কিছু খরচ আছে।’
সোহেল রানা নামে আরেক ফুলকপি বিক্রেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘৫ বিঘার মতো ফুলকপি লাগাইছি। এর মধ্যে সাড়ে চার বিঘাই বিক্রি করা হইছে। প্রথমের দিকে দাম পাই নাই। ছয় সাত দিন থাকি দাম পাইতেছি ৬ টাকা ৭ টাকা করি। আজকে ৪ টাকা ৫ টাকার বেশি দাম কইতেছে না। যেগুলা বিক্রি করছি করছি বাকিগুলা পানির দামে বিক্রি করতে হবে। আর যদি বিক্রি না হয় বাড়ি নিগি গরুকে খাওয়াবো।’
পাইকারি আড়তদারের প্রতিনিধি নন্দ রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, সবজির দাম কাস্টমারের ওপর নির্ভর করে। যেদিন কাস্টমার বেশি সেদিন দাম বেশি হয়। যেদিন কাস্টমার কম সেদিন দাম কম হয়। কাঁচামালের নির্ধারিত কোনো বাজার নেই।
বাজার ঘুরে জানা গেছে, পাইকারি বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা কেজি, করলা ৯০ টাকা, মরিচ ১১০–১২০ টাকা কেজি, আদা ৭০–৯০ টাকা কেজি, পেঁয়াজ ২০–২৫ টাকা, রসুন ৮০–১০০ টাকা, শুকনা মরিচ ৩৮০ টাকা, কাঁচা মরিচ ১১০–১২৫ টাকা, ধনেপাতা ৩০ টাকা, শসা ১৫–২০ টাকা, টমেটো ১৫ টাকা, শিম ৪০–৫০ টাকা, গাঁজর ১৫–১৮ টাকা এবং বেগুন ১৮–২০ টাকা কেজি। এ ছাড়া লেবু ১৬ টাকা হালি ও মিষ্টি কুমড়া ২০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
তবে পাইকারি বাজারের পাশেই খুচরা বাজারে প্রতিটি সবজি প্রায় ১০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারের ক্রেতাদের অভিযোগ- কয়েকটি সবজি বাদে সব কিছুর দাম চড়া।
এদিকে খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি- ভালো জিনিস বাছাই করে নেওয়ায় দাম একটু বেশি।
কথা হয় খুচরা সবজি কিনতে আসা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আবুল হোসেন সরকারের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সব জিনিসের দাম বেড়েছে, মুরগির দাম-সবজির দাম বেড়েছে। আমাদের চাওয়া- জিনিসের দাম কমুক, তাহলে আমরা খুশি।
আরেক ক্রেতা উম্মে কুলসুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সব জিনিসের দাম বেশি। আমাদের জন্য তো কষ্টকর। কারণ গরিবের অনেক সুবিধা-অসুবিধা আছে। আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে এত দাম দিয়ে বাজার করে খাওয়া সম্ভব না। আমরা গরিব মানুষ, সব কিছু আমাদের হাতের বাহিরে। জিনিস খেতে গেলে আমাদের দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে।
খুচরা সবজি বাজারের ব্যবসায়ী আবু তাহের ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সব সবজিতে ৫ টাকার বেশি লাভ রাখি না। তবে সব জিনিসের দাম বাড়ছে আরও বাড়বে। কাস্টমার তো পাই না কার কাছে বেঁচবো। কাস্টমারের তো টাকাই নাই।
রায়হান নামে আরেক খুচরা ব্যবসায়ী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি কিনতেছি কাড়াকাড়ি করে ভালো জিনিসটা বেশি দামে। কেনার পর বিক্রি করার সময় তেমন ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে মাল আমরা লস করতেছি অনেক। ফুলকপি আমরা কিনতেছি ১৫ টাকা করে, আমরা ভালোগুলো কিনছি, বাছাই করে নেওয়াতে আমাদের এগুলা দাম বেশি পড়ছে। দেখা যাচ্ছে ২০ কেজি কিনলে ফেলাইতে হয় ১০ কেজি। ক্রেতা নাই, দাম বেশি হওয়ার কারণে আগের মতো কাস্টমার নাই।’
শরিফুল ইসলাম/আরএআর