মুরগির ‘আগুনে’ পুড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষ

Dhaka Post Desk

মাসুদ আহমদ রনি, সিলেট  

০৯ মার্চ ২০২৩, ০১:৫৮ পিএম


অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়েছে ব্রয়লার মুরগির দাম। বর্তমানে সারা দেশে এ মুরগির দাম বৃদ্ধির সূচক ঊর্ধ্বমুখী। ব্রয়লার মুরগি যেন লাগামছাড়া ঘোড়ার ন্যায় ছুটছে। কোনো অবস্থাতে যেন এটিকে থামানো যাচ্ছে না। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেক শ্রেণি-পেশার মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ব্রয়লার মুরগি।

মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে এ মুরগির দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১১০ টাকা। গত মাসেও যেখানে মুরগির কেজি বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়, সেখানে ক্ষেত্রবিশেষে এখন সেই মুরগির দাম ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।

সারা দেশের ন্যায় সিলেটেও মুরগির বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বেশ জোরালোভাবে। প্রাণিজ আমিষের অন্যতম সরবরাহ হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি। এত দিন এ মুরগি মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ভেতরে থাকলেও এখন তা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

মুরগি কিনতে আসা আব্দুস সোবাহান নামের এক ব্যক্তি ক্ষোভ নিয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখনই মুরগির দাম ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা কেজি। এভাবে চলতে থাকলে রমজানে এ মুরগি ৩০০ টাকা দিয়েও কিনতে পারব কি না বুঝতে পারছি না। আমরা এ অবস্থা থেকে মুক্তি চাই।

মোশাহিদ মিয়া নামের আরেক ক্রেতা বলেন, সিন্ডিকেটের কারণে মুরগির অস্বাভাবিক দাম। কোনো রকমের নজরদারি নেই বাজারে।

বর্তমানে তারা যে দামে মুরগি বিক্রি করছেন সেটি সঠিক মূল্য। তারা মুরগির দাম বৃদ্ধির বিষয়টি মানতে নারাজ। কারণ হিসেবে তারা নানা ধরনের যুক্তিও উপস্থাপন করেছেন। তারা বলছেন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, অগ্রিম আয়কর, আমদানি শুল্ক ও কর্পোরেট ট্যাক্স প্রত্যাহার না হওয়ায় বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে দেশের পোল্ট্রি শিল্প। ফলে এ খাতের উদ্যোক্তারা প্রতিনিয়ত লোকসানের কারণে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন

ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অভিযান জোরদার করলে সিন্ডিকেটের কবল থেকে আমরা সবাই মুক্তি পাব। হঠাৎ দেশব্যাপী এ মুরগির অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে চেষ্টা করেছে দেশের জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্ট। সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা, বাজার ও প্রান্তিক পর্যায়ের খামার ঘুরে পাওয়া গেছে নানা তথ্য-উপাত্ত।

মাঠ পর্যায়ের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও খামারিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বর্তমানে তারা যে দামে মুরগি বিক্রি করছেন সেটি সঠিক মূল্য। তারা মুরগির দাম বৃদ্ধির বিষয়টি মানতে নারাজ। কারণ হিসেবে তারা নানা ধরনের যুক্তিও উপস্থাপন করেছেন। তারা বলছেন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, অগ্রিম আয়কর, আমদানি শুল্ক ও কর্পোরেট ট্যাক্স প্রত্যাহার না হওয়ায় বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে দেশের পোল্ট্রি শিল্প। ফলে এ খাতের উদ্যোক্তারা প্রতিনিয়ত লোকসানের কারণে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন।

dhakapost

এ বিষয়ে কথা হয় সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগর ইউনিয়নের বাসিন্দা ও জাতীয় যুব পদকপ্রাপ্ত উদ্যোক্তা ও খামারি নজরুল ইসলামের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আমরা যারা ব্রয়লার মুরগি উৎপাদন করি তারা করোনাকাল থেকে লোকসানের মধ্যে আছি। এ ব্যবসায় অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। আমার নিজেরও একসময় সাত থেকে আট হাজার মুরগির খামার ছিল। লোকসানে পড়ে এখন মাত্র দুই হাজার মুরগি লালনপালন করছি শুধু মার্কেটে টিকে থাকার জন্য।

লোকসানের মূল কারণ কী— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে আমরা পাইকারি বাজারে মুরগি বিক্রি করতাম ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। তখন এক দিনের মুরগির বাচ্চা কিনতাম ২৫ থেকে ২৮ টাকায়। এখন আমরা এক দিনের মুরগির বাচ্চা ক্রয় করি ৫৫ থেকে ৫৮ টাকায়। আবার বাচ্চাপ্রতি খামারে আসতে পরিবহন খরচ আগে ছিল তিন থেকে চার টাকা, এখন সেটা দাঁড়িয়েছে ১২ থেকে ১৫ টাকায়।

‘এছাড়া মূল যে কারণে মুরগির দাম খামার পর্যায়ে বেড়েছে তা হচ্ছে মুরগির ফিডের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। করোনাকালেও যেখানে আমরা ৫০ কেজির একটি ফিডের বস্তা কিনতাম ২১০০ থেকে ২২০০ টাকায়, সেখানে একই বস্তা এখন আমাদের কিনতে হচ্ছে ৩৬৫০ থেকে ৩৭০০ টাকায়। এসব মুরগির স্টার্টার ফিড ও গ্রোয়ার ফিডের দাম বাড়ার কারণেও উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ, ওষুধ, শ্রমিকের খরচ বাড়ায় বেড়েছে মুরগির দাম।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, গত কয়েক বছরে আমাদের পোল্ট্রি শিল্পের অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। সরকারের উচিত এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে কাজ করা।

জানা গেছে, এক মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে প্রায় ১০০ টাকার মতো বেড়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সোনালি মুরগিও বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩৩০ টাকায়। মাসখানেক আগেও যা ছিল মাত্র ১৯০ থেকে ২০০ টাকায়। লাল লেয়ার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৪৯০ টাকা আর দেশি মুরগি ৫৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, এর আগে কখনও ব্রয়লার মুরগি এত দামে কেনা-বেচা হয়নি। আগে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা পর্যন্ত দাম উঠলেও এখন তা ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে হঠাৎ দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে লোকসান গুনে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে বেড়ে গেছে মুরগির খাবারসহ উৎপাদন খরচ। তারা এজন্য দায়ী করছেন দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে। এ সিন্ডিকেটের কারণে তারাও পড়েছেন লোকসানে। কারণ, দাম বাড়লে ক্রেতারা পণ্য কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

এদিকে, সরেজমিনে সিলেটের বিভিন্ন বাজারে গিয়ে দেখা যায়, গত এক থেকে দেড় বছরে পোল্ট্রি মুরগির খাবার বিশেষ করে সয়াবিন মিল, ভুট্টার গুঁড়া, গমের গুঁড়া, চালের কুঁড়াসহ সব ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেটের বন্দরবাজার লালাবাজারের মুরগির পাইকারি ব্যবসায়ী বাবুল আহমদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিন্ডিকেটের চাপে জনগণের সঙ্গে আমরাও জিম্মি হয়ে পড়েছি। একটি মুরগির ডিমের দাম ১২ টাকা আর এক দিনের একটি মুরগির বাচ্চার দাম ৫৫ টাকা। ডিম থেকে মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের খরচ কী ৪৩ টাকা? আর ২২০০ টাকার ফিডের দাম ৩৭০০ টাকা। জরুরি ভিত্তিতে বিষয়টি সুরাহা না হলে কোনোভাবেই মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বলেও জানান এ ব্যবসায়ী।

লালবাজারের আরেক খুচরা ব্যবসায়ী বোরহান আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা খুচরা ব্যবসায়ীরা কেজিপ্রতি মুরগিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা লাভ করি। আগে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৭০০ কেজি মুরগি বিক্রি করতে পারতাম, সেখানে গত কয়েক দিন মাত্র ১৫০ থেকে ২০০ কেজি মুরগি বিক্রি করছি। কর্মচারীদের বেতন, দোকান ভাড়া ও অন্যান্য খরচ দিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাম কম থাকলে মানুষ বেশি কেনাকাটা করেন, দাম বাড়লে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

dhakapost

এদিকে, চাহিদা মতো জোগান না পাওয়ায় দাম বেড়েছে ডিমের। আড়তগুলো ঘুরে দেখা যায়, মুরগির লাল ডিম ১০০ পিস বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ১০০ টাকা, হাঁসের ডিম বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৭৫০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা। বাজারে অন্যান্য মাংসের দামও বাড়তি। প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা এবং খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকায়।

এমন পরিস্থিতিতে বাজার তদারকির বিষয়ে জোর দাবি জানিয়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।

বাজার তদারকির বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা মুরগির দাম বৃদ্ধির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। বিভিন্ন কারণে মুরগির দাম বেড়েছে। ফিডের দাম, বাচ্চার দাম ও আনুষঙ্গিক অনেক কারণেই বাজারে মুরগির দাম চড়া। তবে কেউ সিন্ডিকেট করে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এমজেইউ

Link copied