পাট-হোগলাপাতা-কচুরিপানা দিয়ে তৈরি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ২৬ দেশে

রাজবাড়ীর সদর উপজেলার বরাট ইউনিয়নের ভবদিয়া গ্রামের গোল্ডেন জুট প্রোডাক্ট নামের একটি কারখানায় পাট, হোগলাপাতা, খড়, ছন ও কচুরিপানা দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন রকমের পরিবেশবান্ধব পণ্য। এসব পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপসহ ২৬ দেশে।
জানা গেছে, ২০১৪ সালে রাজবাড়ী শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে বরাট ইউনিয়নের ভবদিয়া গ্রামে অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী হাকিম আলী সরদার নিজের এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এমন কিছুর করার চিন্তা থেকেই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। নিজের দেড় একর জমি, জমানো কিছু টাকা ও ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গড়ে তোলেন গোল্ডেন জুট প্রোডাক্ট নামের প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এখানে নিয়মিত কাজ করছেন ৬০০ শ্রমিক। আর চুক্তি ভিত্তিতে কাজ করছেন আরও ১ হাজার ২০০ শ্রমিক।

এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৩ লাখ পিস পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়। ব্যাপক চাহিদা থাকায় এসব পণ্য বায়ারদের মাধ্যমে রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব, জাপান, জার্মান, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসহ ২৬টি দেশে।যার আর্থিক মূল্য ২ কোটি টাকার বেশি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি সব মিলিয়ে ভালো প্রভাব পড়ছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে।
সরেজমিনে এই প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, পাট, খড়, ছন, হোগলা পাতা, কচুরিপানা দিয়ে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ, ম্যাট, পাপস, পেট হাউস,ফাইল বক্স, ট্রে, টুপি, বাস্কেট, ফুলের টব, বাটি, ঝুড়ি, টিফিন বক্স, টিস্যু বক্সসহ প্রায় শতাধিক বাহারী পণ্য। এসব পণ্য তৈরিতে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা। কেউ পণ্য তৈরি করছেন, আবার কেউ তৈরিকৃত পণ্য সাজিয়ে রাখছেন। পরে এগুলো রপ্তানির জন্য যাচাই বাছাই করছেন অনেকে।
কারখানার শ্রমিক সুজন বলেন, এই কারখানার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আমি এখানে কাজ করছি। এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আমি স্বাবলম্বী হয়েছি। নিজের বাড়িতে থেকেই মাসে ভালো টাকা আয় করতে পারছি।
নারী শ্রমিক আয়েশা খাতুন বলেন, আগে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হতো। সন্তানদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতাম। এই ফ্যাক্টারি চালু হবার পরে এখানে কাজ করে পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো হয়েছে। মেয়েদের মাদরাসায় পড়াতে পারছি। আয় রোজগার ভালো হচ্ছে। আমি ও আমার স্বামী দুই জনে মিলে এখানে কাজ করে সংসার চালিয়ে কিছু টাকা জমাতে পারছি।
শ্যামলী, মমতাজ, মৌরি, লুবনাসহ একাধিক নারী শ্রমিক বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন তারা অধিকাংশই নদী ভাঙন এলাকার। বেশিরভাগ শ্রমিকদেরই সাংসারিক অবস্থা ভালো ছিল না। এই ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা হওয়াতে আশপাশের কয়েক গ্রামের নারী ও পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। সবার পরিবারের অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে।
কারখানার লাইনম্যান সোহেল রানা বলেন, আমি একজন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষ। লেখাপড়া শেষে বেকার ছিলাম। এলাকার অনেকেই আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো। গোল্ডেন জুট প্রোডাক্ট প্রতিষ্ঠানে লাইনম্যানের কাজ করে বাড়িতে উন্নতি করেছি। আমার মত অনেক প্রতিবন্ধী মানুষ এখানে কাজের সুযোগ পেয়েছে।

কারখানার ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের ফ্যাক্টরিতে সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরি করা হয়। এখানে পণ্য তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় পাট, হোগলাপাতা, ধানের খড় ও কচুরিপানা। আমাদের এই ফ্যাক্টরির মাধ্যমে এলাকার অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
গোল্ডেন জুট প্রোডাক্টের মহা ব্যবস্থাপক (জিএম) আলাউদ্দিন শুভ বলেন, আমরা গ্রাম পর্যায়ে থেকে ধানের খড় ও কচুরিপানা কিনে এনে সেগুলো দিয়ে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারপযোগী বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছি। এতদিন পাট হোগলাপাতা দিয়ে নানা ধরনের পণ্য তৈরি হলেও এ বছর যুক্ত হয়েছে ধানের খড় ও কচুরিপানা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমরা এসব কাঁচামাল আমলা সংগ্রহ করি।এই ফ্যাক্টরি থেকে উৎপাদিত পণ্য বিশ্বের প্রায় ২৬টি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে।
রাজবাড়ীর বিসিক শিল্প নগরীর সহকারী মহাব্যবস্থাপক চয়ন বিশ্বাস বলেন, রাজবাড়ী জেলায় বরাট ইউনিয়নের ভবদিয়া সহ আশপাশের এলাকায় পাট, হোগলাপাতা, কচুরিপানা দিয়ে পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন পণ্য তৈরি হচ্ছে। যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ফলে অর্জিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। আমরা ইতোমধ্যেই বিসিক জেলা কার্যালয়ের পক্ষ থেকে এসব কারখানা পরিদর্শন করেছি। এছাড়াও উদ্যোক্তাদের নানাবিধ পরামর্শ দিয়ে আসছি।
মীর সামসুজ্জামান/আরকে