এক চার্জেই ১২০ কিলোমিটার যায় সেলিমের বানানো গাড়ি

Dhaka Post Desk

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, রংপুর

২৯ মার্চ ২০২১, ০২:১৩ পিএম


পড়ালেখায় মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করেননি। নুন আনতে পান্তা ফোরানোর সংসার। তাই শৈশবে বইখাতা তাকে উঠিয়ে হয়ে ওঠেন কৃষক বাবার সহযোগী। কিন্তু স্বপ্ন দেখতেন একদিন একটি গাড়ি বানাবেন, নিজের বানানো গাড়িতে চড়ে বেড়ানোর। শত কষ্ট-বেদনার মাঝেও ইচ্ছাপূরণে তার মনোবল ছিল অবিচল। শুনে কিছুটা চমকে উঠলেও এমন স্বপ্নই বাস্তব করেছেন সেলিম মিয়া। অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে নিজের বানানো গাড়িতে চড়ে বেড়ালেন গ্রামে, যা দেখে অবাক এখন গ্রামের লোকজন।

২১ মার্চ দুপুরে গ্রামের মেঠোপথ ধরে গাড়িটি চালিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চত্বরে যান সেলিম। সেখানে ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরাসহ উৎসুক মানুষের মোবাইলে ক্যামেরাবন্দি হয় সেলিমের গাড়িটি।

দৃষ্টিনন্দন লাল রঙের গাড়িটির ছবি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। বিভিন্নজনের ফেসবুক আইডি থেকে তা জানাজানি হলে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক ছুটে যান সেলিমের খোঁজে। কিন্তু গ্রামে গিয়ে দেখা মিলল না সেলিমের। তবে তার ছোট ভাই আর মা-বাবা শোনালেন গাড়ি বানানোর গল্পটা।

রংপুর সদর উপজেলার সদ্যপুষ্করিণী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের নিভৃতপল্লি পশ্চিম কেশবপুর উত্তরপাড়া। সেখানকার কৃষক কফিল উদ্দিনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সেলিম বড় ছেলে। অভাবের তাড়নায় ছেলেকে বেশিদূর পড়ালেখা করাতে পারেননি। কিন্তু সন্তানের ইচ্ছাপূরণে কখনো বাধা দেননি মা-বাবা। বরং প্রতিবেশীরা যখন গাড়ি বানানোর প্রস্তুতি দেখে উপহাস করেছিল, তখন উৎসাহ দিয়েছেন তারা। সেই অনুপ্রেরণায় সেলিমও হার মানেননি।

Dhaka Post

গত বছরের জানুয়ারিতে গ্রামের বাড়িতে গাড়ি বানানোর কাজ শুরু করেন ৩০ বছর বয়সী সেলিম মিয়া। সেলিম নারায়ণগঞ্জে থাকেন। সেখানে সামুদা ক্যামিকেল নামের একটি কোম্পানিতে কাজ করেন তিনি ও তার আরেক ছোট ভাই ওমর ফারুক। ছুটি পেলেই বাড়ি ফিরে দুই ভাই মিলে একটু একটু করে গড়তে থাকেন স্বপ্নের গাড়ি। সেলিমের আরেক সহযোগী ছিলেন তারই ছোট ভাই নিয়ামুল ইসলাম। মাদরাসাপড়ুয়া নিয়ামুল বিভিন্ন সময়ে ছুটিতে বাড়ি এসে তার বড় ভাই সেলিমকে গাড়ি বানানোর কাজে সহযোগিতা করেন।

নিয়ামুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ভাইয়ের অনেক দিন ধরে একটা গাড়ি বানানোর স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন এখন পূরণ হয়েছে। আমার ভাই (সেলিম) ছোটবেলা থেকে কষ্ট করছেন। ইচ্ছা ছিল নিজের বানানো গাড়িতে চড়বেন। সেই ইচ্ছা থেকেই এক বছর ধরে গাড়িটা বানানো হয়েছে। এখনো গাড়ির সামান্য কিছু কাজ বাকি আছে। রমজান মাসের ছুটিতে বাড়ি এসে কাজটা শেষ করা হবে।

কীভাবে তৈরি হলো গাড়ি, এমন প্রশ্নে নিয়ামুল বলেন, গাড়ি তৈরির কাজের শুরুতে অনেক টাকা নষ্ট হয়েছে। তখন ইঞ্জিন লাগানোর পরিকল্পনা ছিল। পরে ইঞ্জিন বাদ দিয়ে চার্জার ব্যাটারি দিয়ে কাজ শুরু করা হয়। কখনো গাড়ির চাকা, মোটর, চেসিস নিয়ে এসে একটু একটু করে কাজ করেছি। এখন মোটামুটি গাড়িটা চালানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছে। এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকার কাছাকাছি। তারপর গাড়ির ওপরে ছাদ দেওয়া হবে। এখন দুই সিটের বানানো হয়েছে। ভবিষ্যতে চার সিটের গাড়ি বানানো যাবে।

Dhaka Post

সন্তানের এমন উদ্ভাবনী কর্মে খুশি সেলিমের বাবা কফিল উদ্দিন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমার ছেলেরা যখন গাড়ি বানানোর কাজ শুরু করে। তখন আমি তাদের উৎসাহ দিয়েছি। আমার তো টাকাপয়সা নেই। ছেলেরা যা রোজগার করে, তার মধ্য থেকে একটু একটু করে গাড়িতে ব্যয় করেছে। বড় ছেলের (সেলিম) সঙ্গে ছোট ছেলে (নিয়ামুল) মিলে কাজ করে গাড়িটা তৈরি করেছে। এখন সবাই বাড়িতে এসে গাড়িটা দেখে যাচ্ছে। আমার খুব ভালো লাগছে। ছেলেরা আমাকে গাড়িতে তুলে গ্রামে ঘুরিয়েছে। এটাই আমার মনের শান্তি।

আমি জানতাম আমার ছেলে একদিন গাড়ি বানাতে পারবে। এখন ছেলের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, আমি অনেক খুশি। এমন আত্মবিশ্বাস ছিল সেলিমের মায়ের। সন্তানের মহৎ কর্মে উৎফুল্ল মা সিদ্দিকী বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলে গাড়ি বানানোর জন্য ব্যাকুল ছিল। ছুটি পেলে বাড়িতে এসে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও করত না। দুই ভাই মিলে পড়ে থাকত গাড়ি নিয়ে। খুব কষ্ট করেছে গাড়িটা নিয়ে। এখন গাড়িটা দেখে মনটা আমার আনন্দে ভরে যাচ্ছে। প্রথমে আমাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে সেলিম নিজে গাড়ি চালিয়েছে। গ্রামের সবাই তখন দেখে প্রশংসা করেছে। এটাই তো আমার বড় পাওয়া।

Dhaka Post

বাড়িতে না থাকায় মোবাইল ফোনে সেলিমের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জানতে চাওয়া হয় তার স্বপ্নপূরণের পথচলা ও সফলতার গল্প। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, তার উদ্ভাবিত চার চাকার ইলেকট্রিক গাড়িটি ১০০০ ওয়াটের হাইস্পিড মোটর ও ৬০ ভোল্টের ব্যাটারিতে চলবে। এখন একবার চার্জ দিলেই ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার পথ যেতে পারবে। চার্জার মেশিন দিয়ে ব্যাটারি ফুল চার্জ হতে সাড়ে আট ঘণ্টা সময় লাগে। তবে ভবিষ্যতে এ গাড়িটিতে নতুন ডায়নামা সংযোজন করা হবে। এতে গাড়ির চাকা যত ঘুরবে, ব্যাটারি ততই চার্জ হবে। তখন প্রতিদিন চার্জার মেশিনে ব্যাটারি চার্জ করার প্রয়োজন হবে না।

সেলিম বলেন, আমার ছোট ভাই নিয়ামুলকে সঙ্গে নিয়ে মোটর ওয়াইন্ডিং, ইলেকট্রিক ফিটিং, চেসিসসহ গাড়ির যাবতীয় সব কাজ বাড়িতে করেছি। ইলেকট্রিক কাজের বিষয়ে আমার তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু সামুদা ক্যামিকেল কোম্পানির একজন ভারতীয় নাগরিকের কাছ থেকে আমি কার্বন ফাইবার বডি বানানো দেখে উদ্বুদ্ধ হই। আমার আগে থেকেই যেহেতু ইচ্ছা ছিল গাড়ি বানানোর, তাই আমি শুরু করি গাড়ি নির্মাণের কাজ। এক বছরের মধ্যে গাড়িটির কাজ মোটামুটি শেষ করেছি। আর সামান্য কিছু কাজ বাকি রয়েছে। এবারের ঈদের ছুটিতে গিয়ে বাকি কাজ শেষ করব।

আমি স্মার্টফোন ব্যবহার করি না। আমার সহকর্মীদের স্মার্টফোন কিছু সময়ের জন্য নিয়ে ইউটিউবে গাড়ি নির্মাণবিষয়ক কয়েকটি ভিডিও দেখেছিলাম। এভাবে দেখতে দেখতে নিজের ইচ্ছাপূরণের আকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে। একদিন গাড়ি বানানোর কাজ শুরু করেছিলাম, যোগ করেন সেলিম।

Dhaka Post

এখন পর্যন্ত দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান তিনি। তবে প্রথম অবস্থায় খরচ বেশি হলেও ভবিষ্যতে এক থেকে দেড় লাখের মধ্যে এটা বানানো সম্ভব হবে। এর জন্য গাড়ির বডির নকশা ও উন্নত কিছু ফর্মুলা তিনি নিজেই তৈরি করে রাখবেন।

সেলিমের প্রতিবেশী সুমন ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, সেলিম পড়াশোনা করেননি। যতদূর জানি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন। তবে তার মেধা খুব ভালো। সব সময় দেখেছি সেলিম নিজে কিছু করতে চান। এ কারণে আজ তিনি সফল হয়েছেন। আমার বিশ্বাস ছিল সেলিম গাড়ি বানাতে পারবেন। আজ তার গাড়ি দেখে খুব ভালো লাগছে। আমাদের গ্রামের সবাই খুশি। আমরা চাই দেশের কল্যাণে সরকার তার মেধাকে কাজে লাগাক।

স্থানীয় ইউপি সদস্য আফরোজা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেলিমের তৈরি ব্যাটারিচালিত গাড়িটিতে আমি উঠেছিলাম। আমি আনন্দিত। এই গাড়ি তেমন কোনো দূষণ ঘটায় না। এটা পরিবেশবান্ধব। মোটরযানশিল্পের বিকাশে এ ধরনের উদ্ভাবনকে উৎসাহ দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ রকম অনেক গাড়ি তৈরি করা সম্ভব হবে।

রংপুর সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নাছিমা জামান ববি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সমাজের উচিত এ ধরনের উদ্ভাবনকে উৎসাহ দেওয়া। গাড়ি তৈরির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শ করে গাড়িটির নকশা উন্নত করা যেতে পারে। গাড়িটি রাস্তায় নামানো হলে তা যেন নিরাপদ, স্বস্তি ও দক্ষতার সঙ্গে চলতে পারে, তার জন্যও বিভিন্ন সংস্থার পরামর্শ দরকার। আমার বিশ্বাস সেলিমের উদ্ভাবন বৃথা যাবে না।

এনএ

Link copied