শুঁটকির স্বর্ণভূমি, বছরে উৎপাদন ১০০ টন

পিরোজপুর সদর উপজেলার চিথলীয়া গ্রামের শুঁটকি পল্লী, নদী ও সাগরের সান্নিধ্যে গড়ে ওঠা এক জীবন্ত কর্মযজ্ঞ। কচা নদীর তীর ঘেঁষে সারি সারি বাঁশের মাচা, বাতাসে শুকনো মাছের ঘ্রাণ আর ব্যস্ত হাতের শব্দে দিনভর মুখর থাকে এখানকার শুঁটকি পল্লী। শীত এলেই যেন প্রাণ ফিরে পায় এই ছোট্ট পল্লীটি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নদী ও বঙ্গোপসাগর খুব কাছাকাছি হওয়ায় উপজেলার পাড়েরহাটে একটি মৎস্য বন্দর গড়ে ওঠে। এর পাশেই চিথলীয়া গ্রামে গড়ে ওঠে শুঁটকি পল্লী। বন্দর থেকে সামুদ্রিক মাছ সংগ্রহ করে তৈরি হয় শুঁটকি। অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে শুঁটকির কারবার।

সরেজমিনে দেখা যায়, পাড়েরহাট মৎস্য বন্দরের দক্ষিণে কচা নদীর তীরে পাঁচটি বাসা নিয়ে শুঁটকি পল্লী গড়ে উঠেছে। এখানে ৫ থেকে ৭ জন ব্যবসায়ী রয়েছেন। যেখানে কাজ করেন ১৫০ থেকে ২০০ শ্রমিক। শুঁটকি পল্লীতে মাস ও দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করেন তারা। ভরা মৌসুমে দিনভর কর্মব্যস্ত এসব শ্রমিকরা। কিছু শ্রমিক পাড়েরহাট বন্দর থেকে মাছ সংগ্রহ করে পেট কেটে ধুয়ে নিচ্ছেন। কেউ বড় মাছ কাটছেন আবার কেউ লবণ পানি মিশিয়ে বাঁশের তৈরি মাচার ওপরে বিছিয়ে মাছ শুকানোর কাজ করছেন। কেউবা শুকানো শুঁটকি বস্তায় ভরে বাসায় সংরক্ষণ করেছেন চালানের জন্য।

ব্যবসায়ীরা জানান, ১৮ বছর আগে পিরোজপুরের পাড়েরহাটে একটি বাসা থেকে শুরু হয় এই শুঁটকির ব্যবসা। ধীরে ধীরে ৮ থেকে ১০টি বাসা এখানে তৈরি হয়। পরে তা কমে এখন ৫টি বাসায় স্থায়ী হয়েছে। সাধারণত কোরাল, লইট্টা, ছুরি, চিতল, হাইতা, মর্মা, ঢেলা, মধু ফ্যাপসা, চাপিলাসহ ৩০ থেকে ৩৫ প্রজাতির মাছ শুঁটকি করা হয় এখানে। শীত মৌসুমে এসব প্রজাতির মাছ বঙ্গোপসাগরে জেলেদের জালে ধরা পড়ে বেশি। পাশাপাশি শীত থাকলেই শুঁটকির মান ভালো থাকে। বেশি গরম পড়লে শুঁটকির মান নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে শীত মৌসুমে জমজমাট হয়ে ওঠে এসব শুটকি পল্লী। মানভেদে প্রতি কেজি শুঁটকি বিক্রি হয় ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকা কেজিতে।
শুঁটকি ব্যবসায়ী মো. আনোয়ার হোসেন তালুকদার বলেন, আমরা এখানে বিভিন্ন রকমের মাছের শুঁটকি তৈরি করি। কোনো ধরনের ওষুধ ব্যবহার করি না। আমাদের মাছের শুঁটকি মোকামে প্রচুর চাহিদা থাকায় আমরা এই সময়ে শুঁটকি তৈরিতে ব্যস্ত থাকি।

সদর উপজেলার চিথলিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী আলী সরদার বলেন, মৌসুমের শুরুতে পাড়েরহাট মৎস্য বন্দরে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। জেলেরা মাছ ধরে সরাসরি বন্দরে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে আমরা শুঁটকির জন্য মাছ সংগ্রহ করি। এখানে ইলিশ বাদে প্রায় ৩৫ প্রজাতির মাছ শুঁটকি করা হয়। এটি প্রক্রিয়াজাতকরণে কোনো প্রকার কেমিক্যাল ব্যবহার না করায় মানুষ নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা পায়। তাই এখানকার উৎপাদিত শুঁটকি ব্যাপক জনপ্রিয়।
চার বছর ধরে এখানে কাজ করেন শুঁটকি শ্রমিক মো. ইব্রাহিম মুন্সি। তিনি বলেন, আমাদের শুঁটকিতে কোনো ধরনের কীটনাশক ব্যবহার হয় না। প্রাকৃতিকভাবে রোদে শুকিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে শুঁটকি করা হয়। যার কারণে এখানকার শুঁটকির চাহিদা অনেক বেশি।

শুঁটকি ব্যবসায়ী শাজাহান হাওলাদার বলেন, এখানে প্রথমে একটি বাসা ছিল। পর্যায়ক্রমে এখানে বর্তমানে পাঁচটি বাসা রয়েছে। যেখানে দুই শতাধিক শ্রমিক কাজ করেন। আমাদের এখানের শুঁটকির গুণগতমান ভালো হওয়ায় এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই দিন দিন শুঁটকি পল্লীর পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আমাদের এখানে একটি টিউবওয়েল, একটি ব্রিজ এবং কয়েকটি বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা করা হলে আমারা এ ব্যবসা আরও ভালোভাবে করতে পারতাম।
এই পল্লী থেকে প্রতিবছর ১০০ টনেরও বেশি শুঁটকি উৎপাদন হয়, যার বাজার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এ ব্যবসার উন্নয়নে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানসহ সরকারের কাছে সার্বিক সহযোগিতা কামনা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে পিরোজপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সঞ্জীব সন্নামত ঢাকা পোস্টকে বলেন, শীতের শুরুতে প্রায় চার মাস এখানে শুঁটকি কার্যক্রম চলে। এখানে শুঁটকি তৈরির পদ্ধতিটি খুবই নিরাপদ। সরকার এখানে দেখভাল করছে। মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এখানে শুঁটকি বেডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে এবং এখানে একটি শুঁটকি উন্নয়ন কার্যক্রম শীর্ষক প্রকল্পের প্রস্তাবনা রয়েছে। এ কার্যক্রম শুরু হলে আমাদের তদারকি আরও বাড়বে এবং এখানে তৈরি শুঁটকি দেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি করা যাবে।
এএমকে