প্রবাস ফেরত সুজন ছাদে ছাগল-মুরগি পালন করে এখন সফল খামারি

গাজীপুর মহানগরের চাপুলিয়া এলাকায় দোতলা ভবনের ছাদে ছাগল-মুরগি-কবুতর লালনপালন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন মোর্শেদ খান সুজন। একসময় বিদেশ ফেরত বেকার সুজন এখন নিজের পরিবারের যাবতীয় চাহিদাপূরণ করছেন। ছাদে ছাগল পালনে সফল হয়ে তিনি এখন সফল উদ্যোক্তা।
সুজন বলেন, অর্থের অভাবে আমি বেশি লেখাপড়া করতে পারিনি। অসুস্থ বাবা মো. মোশারফ হোসেন দীর্ঘদিন ধরে প্যারালাইজড হয়ে শয্যাশায়ী। আমার দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। ১৯৯৯ সালে এইচএসসি পাসের পর আমাকেই সংসারের হাল ধরতে হয়। সংসারে দেখা দেয় অর্থ সংকট। অস্বচ্ছলতা দূর করতে কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শেষে আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতায় চাকরি নিয়ে আবুধাবি চলে যাই। ছোটখাট কাজ করতে করতে একসময় সেখানে আবু নাসের জেনারেল ট্রান্সপোর্ট নামের তেল কোম্পানিতে চাকরি নেই। দীর্ঘদিন সেখানে চাকরি করে ২০২১ সালে আবার দেশে ফিরে আসি। পরে আমার নিকটাত্মীয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মোশারফ হোসেনের পরামর্শে আর আবুধাবিতে যাওয়া হয়নি। তারপরও নিজের ভাই-বোনদের দেখভালসহ নিজের স্ত্রী ও তিন সন্তানদের ভরণপোষণের দায়িত্ব আমাকেই নিতে হয়।

তিনি আরও বলেন, বিদেশ থেকে যে অর্থ নিয়ে এসেছিলাম তা দিয়ে চাপুলিয়া এলাকায় কেনা এক খণ্ড জমির উপর দোতলা বাড়িটি নির্মাণ করেছি। এছাড়া ছোট এক ভাইকেও সস্ত্রীক ফ্রান্সে পাঠিয়েছি। অন্য ভাই বোনদের লেখাপড়া করিয়ে বিয়ে দিয়েছি। এসব করতে গিয়ে আমার জমানো অর্থ প্রায় খরচ হয়ে যায়। পরে আমি আবার বেকার হয়ে পড়ি। বেকারত্ব ঘোচাতে দেশেই কিছু করার চিন্তা করতে থাকি।
তখন সুজন ইউটিউবে ছাগল-মুরগি পালনের সফলতার ভিডিও দেখে নিজেও ছাগলের খামার করার পরিকল্পনা করেন। তিনি তার দোতলা ভবনের ছাদে টিনশেড করে খামার নির্মাণ করেন। পরে অনলাইনেই উত্তরার এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকায় ভারতের হরিয়ানা জাতের ৭ মাস বয়সী পাঠা এবং ৯৬ হাজার টাকায় দুটি ছোট বাচ্চাসহ মাদী ছাগল ক্রয় করেন।
তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সুজনকে। এক এক করে তার ছাগলের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে অর্ধশতাধিক হয়। কিন্তু সেখানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় তিনি বেশ কিছু ছাগল বিক্রি করে দেন। এখনও তার খামারে ৩৫টির মতো ছোট-বড় ছাগল রয়েছে। প্রতিটি ছাগল বছরে দুবার বাচ্চা দেয়। এ ছাগল প্রতিবারে দুইটি/তিনটি করে বাচ্চা দেয়। তার ভবনের দোতলার এক ইউনিট তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করেন আর নিচতলাসহ বাকি ইউনিট ভাড়া দিয়েছেন। দোতলায় ছাগল পালন করলেও ভাড়াটিয়াদের কিংবা এলাকাবাসীরও কোনো অভিযোগ নেই। কারণ ছাদে খামার থাকায় নিচের দিকে কোনো দুর্গন্ধ যায় না। খামারের বর্জ্য ছাদ থেকে পাইপের মাধ্যমে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। ফলে দুর্গন্ধ ছড়ায় না।
ছাগল ছাড়াও সুজন কবুতর ও মুরগির খামার করেছেন একই ছাদে। বর্তমানে তার ২০ জোড়া (লাহরী ও ম্যাক্সি রেসার) কবুতর এবং ৩ শতাধিক দেশি মুরগিও রয়েছে। তার ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর একটি ইনকিউবেটরও রয়েছে। এর সাহায্যে প্রতিদিন তিনি মুরগির ডিম থেকে ৫০টি করে বাচ্চা ফোটান। পরে বিভিন্ন বয়সী মুরগির বাচ্চা বা মুরগি বিক্রি করে দেন।
সুজন জানান, খামার পরিচালনার জন্য তার খরচও কম। এসব দেখভালের জন্য মাসিক আট হাজার টাকায় এক নারী কর্মী নিয়েছেন। আর খাবারের জন্য তার মাসে ৬/৭ হাজার টাকা খরচ হয়।
তিনি বলেন, এ খামার শুরুর পর থেকে পরিবারের জন্য তাদের মাংস ও ডিম বাজার থেকে আর কিনতে হয় না। তার পারিবারিক প্রয়োজনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ঈদে তাদের খামারের ছাগল-মুরগি-ডিম-কবুতর থেকেই প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটান।
বর্তমানে ছাগলের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি বর্তমানে তার দোতলা ভবনের বাড়িটি তিনতলা করে খামার বাড়ানোর চিন্তা করছেন। ইতোমধ্যে ভবন নির্মাণকাজও শুরু করেছেন। তাই তিনি কিছু ছাগল/মুরগি/কবুতর বিক্রি করার পরিকল্পনা নিয়েছেন।

সুজন জানান, ছাগলের খাবারের জোগান দিতে তার ভবনের পাশেই জমিতে ঘাস চাষ করেছেন। এছাড়া কুড়া-ভুষি-ছোলাসহ প্রয়োজনীয় খাবার বাজার থেকে ক্রয় করে প্রক্রিয়াজাত করে সরবরাহ করেন। কবুতর-মুরগিকেও তিনি অর্গানিক ফুড সরবরাহ করেন। এতে ব্রয়লার মুরগির মতো মাংসে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয় না। ফলে এসব ছাগল-মুরগি-কবুতরের রোগবালাই নেই বললেই চলে এবং ক্রেতাদের চাহিদাও বেশি। স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অফিসের সহায়তায় এদের নিয়মিত ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেন।
গাজীপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. ওকিল উদ্দিন জানান, ছাদে ছাগল-মুরগির খামার নির্মাণ করার একটা পজেটিভ দিক হলো সেখানে রোগবালাই কম হয়। পড়ে থাকা ছাদটিও কাজে লাগে।
তিনি সুজনের খামার সম্পর্কে বলেন, আমরা ওই খামারের নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছি এবং প্রয়োজনে ভ্যাকসিন সরবরাহও করছি। ছাদে খামার স্থাপন করে পরিবারের পুষ্টির চাহিদা মেটানোয় সুজন প্রশংসার দাবিদার। ব্যাপারে তার আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন হলে আমরা ব্যবস্থা করব।
শিহাব খান/আরকে