‘বন্যার কারণে কাজকর্ম নেই, বউ-বাচ্চা নিয়ে বিপদে আছি’

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বন্যা সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় সদর উপজেলার যাত্রাপুর, উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ, সাহেবের আলগা, চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট, চিলমারী ইউনিয়ন ও রৌমারী-রাজিবপুর উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক চরাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে।
গত এক সপ্তাহের তুলনায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো পানিবন্দি রয়েছে প্রায় ১০ হাজার পরিবার। এসব চরাঞ্চলে কৃষকের বীজতলা, শাকসবজি ও রোপা আমন ধান ডুবে গেছে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় গো-খাদ্য ও জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) ব্রহ্মপুত্র নদের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার নিচ দিযে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যান্য নদ-নদীর পানিও সমতলে হ্রাস পাচ্ছে।
রোববার দুপুরে স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে জানা যায়, রৌমারী উপজেলার ফলুয়ারচর, পালের চর, গোয়ালের চর, খেরুয়ারচর, সুখেরবাতি, ধনারচর, রাজিবপুর উপজেলার চর সাজাই, ডাটিয়ারচর, কোদালকাটি, শংকর মাধবপুর, বড়রচর, সাজাই মন্ডলপাড়ার প্রায় ২৫টি গ্রামে বন্যার পানি উঠেছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ছয় হাজারের বেশি পরিবার।
ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ, সাহেবের আলগা, চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়ন, সদর উপজেলার যাত্রাপুর, পাঁচগাছী, ভোগডাঙ্গা, মোগলবাসা, ঘোগাদহ ইউনিয়ন, চিলমারী উপজেলার চিলমারী সদর ইউনিয়ন, অষ্টমীর চর ইউনিয়নের মানুষের মাঝে জ্বালানি ও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। গবাদিপশুর খাদ্য সংকট নিয়ে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের ঝুনকার চরের আনোয়ার জানান, পাঁচ দিন থেকে বাড়িতে পানি উঠেছে। ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে খুব বিপদে আছি। এদিকে গবাদিপশুর খড় শেষ হয়ে যাচ্ছে। বানের পানি দ্রুত নেমে না গেলে জমানো খড় শেষ হয়ে যাবে। গরু নিয়ে বিপদে পড়তে হবে বলেও তিনি জানান।

সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের মিলপাড়া এলাকার নামদেল আলী বলেন, আমি দিনমজুরি করে খাই। বন্যার কারণে অনেকদিন থেকে কাজকর্ম নেই, বসে আছি। বউ-বাচ্চা নিয়ে খুব বিপদে আছি। একবেলা খাই তো আরেক বেলা নাই। বন্যা আসছে থেকে খুব কষ্টে আছি।
পাঁচগাছী ইউনিয়নের সিতাইঝাড় এলাকার মফিজুল ইসলাম বলেন, রাস্তায় এখনো পানি। কোথাও গেলে নৌকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বর্তমানে আমাদের এখানকার যাতায়াতে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাঁচগাছী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল বাতেন সরকার বলেন, পানি কিছুটা কমেছে। পানি কমলেও নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাট এখনো তলিয়ে আছে। তারা বর্তমানে নৌকায় যাতায়াত করছেন। বড় ধরনের বন্যা না হওয়ায় মানুষজন খুব একটা সমস্যায় পড়েনি। সরকারিভাবে দুই টন চাল পেয়েছি। আগামীকাল থেকে তা বিতরণ করা হবে।
সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল গফুর বলেন, আমার ইউনিয়নটি বেশিরভাগ ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায়। তবে গতকাল থেকে নদের পানি কমতে শুরু করেছে। এখনো ৭০০-৮০০ পরিবার পানিবন্দি জীবনযাপন করছে। এছাড়াও চারণভূমি তলিয়ে থাকায় গো-খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নবেজ উদ্দীন আহমেদ জানান, জেলায় বন্যার কারণে ৪০টি বিদ্যালয়ের পাঠদান তিন দিন বন্ধ ছিল। পানি কমে যাওয়ার কারণে আজ থেকে পাঠদান শুরু হয়েছে।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত জানান, বন্যার পনিতে তলিয়ে গেছে ৫ হাজার ৩২৮ হেক্টর জমির আমন ক্ষেত, ৬৭ হেক্টর জমির বীজতলা ও ২৮৮ হেক্টর জমির বিভিন্ন শাক-সবজি। বন্যার পানি শুকিয়ে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, চলতি বন্যায় ১৮২ মেট্রিক টন চাল, ১০ লাখ টাকা ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও ২৮০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ টাকা এবং ৩ হাজার ৭০০ প্যাকেট শুকনো খাবার মজুত আছে। গো- খাদ্যের জন্য ৫ লাখ টাকা এবং শিশু খাদ্যের জন্য ২ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
জুয়েল রানা/আরএআর