গলগণ্ড নিয়ে মানবেতর জীবন কাটছে কুড়িগ্রামের অসংখ্য নারীর

থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকেই গলগণ্ড বা গয়টার বলা হয়। থাইরয়েড হলো প্রজাপতি আকৃতির একটি গ্রন্থি, যা হলে গলার গোড়ায় ফুলে যায়। আঞ্চলিক ভাষায় এ রোগকে (ঘ্যাগ) বলা হয়। এ রোগে সাধারণত গলার বিভিন্ন অংশে ফুলে যায়। দেখা দেয় বিভিন্ন রকমের গোটা।
এ রোগের অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ আয়োডিনের ঘাটতি। এক সময় কুড়িগ্রামের গ্রামগঞ্জে প্রচুর গলগণ্ড রোগী দেখা যেত। তবে ধীরে ধীরে আয়োডিনযুক্ত লবণ, সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নতির ফলে রোগটি অনেকাংশে কমে গেছে। এর পরেও জেলার বিভিন্ন এলাকায় দেখা মেলে গলগণ্ড রোগে আক্রান্ত রোগীর। তবে এই রোগে নতুন আক্রান্তের চেয়ে, পুরাতন রোগীর সংখ্যাই বেশি। তবে জেলায় কতসংখ্যক গলগণ্ড আক্রান্ত রোগী রয়েছে তা জানাতে পারেনি স্বাস্থ্যবিভাগ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময়ের দারিদ্র পিরিত জেলা কুড়িগ্রামে স্বাস্থ্য সচেতনতাসহ আয়োডিনের ঘাটতির কারণে গ্রামাঞ্চলসহ চরাঞ্চলগুলোতে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে দেখা মিলতো গলগণ্ড রোগে আক্রান্ত মানুষের। রোগটিতে সাধারণত পুরুষদের চেয়ে নারীরাই বেশি আক্রান্ত হয়। কালের পরিক্রমায় এ অঞ্চলের দরিদ্রতা হ্রাস, সরকারের স্বাস্থ্যনীতি, ব্যাপক জনসচেতনতার ও বাজারে আয়োডিনযুক্ত লবণ সরবরাহসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে অনেকাংশে রোগটি কমে গেছে।
কথা হয় গলগণ্ড রোগে আক্রান্ত সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের কলেজ মোড় এলাকার ছকিনা বেগমের (৬০) সঙ্গে। তিনি গত ৩০ বছর যাবৎ গলগণ্ড রোগে আক্রান্ত। ছকিনা বলেন, গত ২৫/৩০ বছর আগে এক সন্তানের মা হওয়ার পর গলায় একটা ছোট গোটা দেখা দেয়। শুরুতে তেমন গুরুত্ব দেইনি। আস্তে আস্তে গোটাটা অনেক বড় হয়েছে। এটাকে আমরা ঘ্যাগ বলি। কি জন্যে এমন হয়েছে তা জানি না। অভাবী সংসার হওয়াই ডাক্তার দেখাতে পারিনি। এখন সমস্যা হয়েছে ভাত খেতে কষ্ট হয়, ঘুমাতে গেলেও শ্বাসকষ্ট হয়। জোরে কথাও বলতে পারি না। স্বামী সন্তান বলতে কেউ নেই আমার। এ রোগ থেকে মুক্তি পেলে বাকি দিনগুলো ভালোভাবে কাটাতে পারতাম।
একই ইউনিয়নের মিলপাড়া এলাকার বিবিজন বেগম (৫০)। তিনিও দীর্ঘদিন ধরে গলগণ্ড রোগে আক্রান্ত। তিনি বলেন, ‘২০-২৫ বছর থাকি মোর গলা ফুলা। ভাত খাওয়ার সময় ভাত গলাত আটকি যায়। মাঝে মাঝে বমিও হয়। অভাবে কোনোদিন ডাক্তারোক দেখাবার পাংনাই। হামার গ্রামোত আরও ৩-৪ জনের এই ঘ্যাগ আছে। কেউ কোনোদিন ডাক্তার দেখাইনি।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, এই ইউনিয়নে শুধু ছকিনা ও বিবিজনই এই রোগে আক্রান্ত নন। তাদের মতো অসংখ্য নারী আছে তারাও গলগণ্ড রোগে আক্রান্ত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আক্রান্ত নারীরা বেশির ভাগই অসচ্ছল ও অভাবী পরিবারের।
অবহেলা করে তারা রোগটি নিয়ে চিকিৎসকদের কাছে যাননি। একদিকে তাদের অভাব, অন্যদিকে অবহেলা করে রোগটিকে সঙ্গী করে কাটিয়ে দিচ্ছেন, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। এভাবে কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছরও। সরকারিভাবে যদি এসব নারীদের চিকিৎসার আওতায় আনা যেতো। তাহলে হয়ত এ মানুষগুলো সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বাকি জীবন অতিবাহিত করতে পারতো।
এ বিষয়ে কথা হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মো. মাঈদুল ইসলাম মুকুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে গলগণ্ড বা গয়টার বলা হয়। আঞ্চলিক ভাষায় এটিকে ঘ্যাগ বলে। সাধারণত আয়োডিনের ঘাটতির কারণে এই রোগ হয়। উত্তরবঙ্গে আগে এই রোগ সবচেয়ে বেশি দেখা যেত। আয়োডিনযুক্ত লবণের ব্যবহার এই রোগের প্রাদুর্ভাব অনেক কমিয়ে দিয়েছে। গয়টারের আকৃতি এবং বয়সভেদে এই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি বিভিন্ন হয়ে থাকে। চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর মধ্যে ওষুধ, সার্জারি এবং তেজস্ক্রিয় আয়োডিনের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মঞ্জুর-এ মোর্শেদ বলেন, আগে এ অঞ্চলে গলগণ্ড রোগে আক্রান্ত রোগী অনেক দেখা যেতো। বর্তমানে আয়োডিন যুক্ত লবণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তার পরেও এখনো গলগণ্ড রোগী দেখা যায়, কিন্তু অনেক কম। তবে জেলায় কি কতসংখ্যক গলগণ্ড রোগী আছে আমাদের কাছে সেই পরিসংখ্যান নেই।
মো. জুয়েল রানা/এএএ