ঘরে বসে লক্ষাধিক টাকা আয় করেন দেশ সেরা এই ফ্রিল্যান্সার
১০ বছরের ফ্রিল্যান্সিং অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ বর্তমানে মাসে তিন থেকে চার লাখ টাকা আয় করছেন মাদারীপুরের আল শাহরিয়াত করিম। তিনি লেখাপড়া শেষ করেছেন রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ২০১১ সাল থেকে শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিং। এখন আয় করার পাশাপাশি তিনি প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন অন্যদেরও।
শাহরিয়াত বলেন, ২০০৯ সালে যখন সারা বাংলাদেশ বিভিন্ন সিম কোম্পানি তাদের ইন্টারনেটে সেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটা ক্যাম্প করে ছিল। মোবাইলের ভেতর ইন্টারনেটের মাধ্যমে কয়েকটি কুইজ থাকবে সেই কুইজ নির্দিষ্ট মিনিটের মধ্যে যে উত্তর দিতে পারবে তাকে আমরা একটি মডেম উপহার দেব। আমি তাদের নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সঠিক উত্তর দেওয়ার কারণে তারা আমাকে মডেমটি উপহার দিয়েছিল। সেখান থেকেই আমি এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করি। এরপর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইউটিউবে একটি ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কিত ভিডিও আমার সামনে আসে। পরবর্তীতে ফ্রিল্যান্সিংয়ে ক্যারিয়ার গড়া সফল ব্যক্তিদের ভিডিও দেখে আমার এ পথে আসার আগ্রহ জন্মায়। এরপর আমি ফ্রিল্যান্সিং ফিল্ড সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি এবং এ কাজে জড়িতদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সেই সঙ্গে ইউটিউব ও বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল প্লাটফর্ম থেকে ডিজিটাল মার্কেটিং শেখা শুরু করি।
বলছি মাদারীপুর পৌরসভার বটতলা এলাকার তরুণ ফ্রিল্যান্সার আল শাহরিয়াত করিমের কথা। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মো. বজলুল।
শাহরিয়াত মাদারীপুর সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাসের পর রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউল্যাব এ স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। তিনি ভবিষ্যতে সুইডেন থেকে পিএইচডি করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে চান।
২০১১ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর তিন মাসের অবসর সময় পান শাহরিয়াত। এখনকার মতো তখন দ্রুতগতির ইন্টারনেট ছিল না। ফ্রিল্যান্সিং শেখার আগ্রহ নিয়ে ‘সামহোয়্যারইন ব্লগে’ লেখা পড়তে শুরু করেন শাহরিয়াত। সেখানে প্রথম ব্লগিং ও অ্যাডসেন্স নিয়ে ধারণা পান। ইংরেজিতে লিখে ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করতেন। রাত জেগে প্রতিদিন ব্লগে লেখা পড়তেন। ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে বিস্তারিত জানতে কয়েকশ লেখা পড়েছেন।
তিনি জানান, আয়ের টাকা পাওয়ার আগে তার বিশ্বাসই হয়নি, অনলাইনে আয় করা সম্ভব। এরপর একটি ডোমেইন কিনে ফ্রিল্যান্সিং করা শুরু করেন। কিন্তু আয় কম হওয়ায় তিনি প্রফেশনাল কনটেন্ট রাইটার, অনুবাদক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। এরপর ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস ‘ওডেক্স ডটকমে’ অ্যাকাউন্ট খোলেন তিনি। কিন্তু বয়স ১৮ না হওয়ায় বিপত্তি বাধে। পরে বাবার নামে অ্যাকাউন্ট খুলে কাজের সন্ধান করেন। ওই মার্কেটপ্লেস থেকে বিদেশিদের দেওয়া প্রথম কাজ পেয়ে ২৫৮ ডলার আয় করেন তিনি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসে বিচরণ ঘটে তার।
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, প্রথমে অনুবাদ, মার্কেটিং এর কাজ করতাম। প্রথম মাসে আয় হতো ১৫০ ডলারের মতো। তবে এখন আমি আগের মতো কাজ করি না। বর্তমানে পশ্চিমা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করি। ট্রেডমার্ক, পেটেন্ট, কপিরাইট নিয়ে কাজ করে বর্তমানে প্রতি মাসে আমার গড় আয় চার লক্ষাধিক টাকা। আমি এই সাফল্যের কারণে ইতোমধ্যে তিনি জাতীয় পর্যায়ে পাঁচটি পুরস্কারও পেয়েছেন।
ফ্রিল্যান্সিং পেশায় পা রেখে শাহরিয়াত শিখেছেন অ্যানিমেশন ডিজাইন, বিগ ডেটা ভিজুয়ালাইজেশন, ই-কমার্স ম্যানেজমেন্ট, প্রমোশন অ্যান্ড ব্র্যান্ডিং, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, ভায়াবিলিটি অ্যান্ড ফেসিয়াবিলিটি রিসার্চ, পিআর পাবলিকেশনসহ বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে। অনলাইনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কোর্স করেছেন তিনি। আপওয়ার্ক মার্কেটপ্লেসে ‘টপ রেটেড প্লাস’ ফ্রিল্যান্সার তিনি। আল শাহরিয়াত বলেন, প্রতি মাসে ফ্রিল্যান্সিং থেকে তার গড়ে আয় পাঁচ হাজার ডলারের মতো। আপওয়ার্ক থেকে তিনি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ ডলার আয় করেছেন।
শাহরিয়াত করিম আউটসোর্সিং খাতে বিশেষ অবদান রাখায় এখন পর্যন্ত পাঁচটি পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৫ সালে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলকের হাত থেকে জাতীয় হাইস্কুল প্রোগ্রামিং কনটেস্ট অ্যাওয়ার্ড (এনএইচএসপিসি-ঢাকা আঞ্চলিক), ২০১৭ সালে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসকের হাত থেকে এলইডিপি বেস্ট ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড, ২০১৮ সালে ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের হাত থেকে জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড এবং ২০২০ সালে বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড পান উদ্যমী এই তরুণ।
শাহরিয়াত বাংলাদেশে থেকেই সুইডেনভিত্তিক আন্তর্জাতিক কসমেটিকস বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এক্সল্যাশেলিগ্যাল অ্যাডভাইজর (ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অ্যান্ড কন্ট্রাক্ট) হিসেবে কাজ করছেন। সেখান থেকে তিনি প্রতি মাসে ১ হাজার ৪০০ ডলার আয় করছেন।
আল শাহরিয়াত বলেন, ‘ইউরোপে আমার দুটি জব অফার আছে। একটি সুইডেনে, আরেকটি এস্তোনিয়ায়। বর্তমানে সুইডিশ একটি প্রতিষ্ঠানে রিমোট জব করছি। মূলত সেখানেই জয়েন করার ইচ্ছা আছে। ইউরোপের কোথায় গিয়ে থাকব, সেটা নির্ভর করছে ভালো স্কলারশিপের ওপর। আমার কাছে জবের চেয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।’
২০১৭ সালের শেষের দিকে তুরস্কের একটি প্রতিষ্ঠানের কাজ নিয়ে প্রথমবারের মতো নয়াদিল্লিতে যান শাহরিয়াত। এরপর বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় দুবাই, ওমান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপাল, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন তিনি।
আল শাহরিয়াত করিম বলেন, এ সময়ের যুবকরা মাদকে আসক্ত না হয়ে তারা নিজেরা কিছু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করুক। যারা এ সব কাজ করতে আগ্রহী আমি তাদের পাশে থেকে সহযোগিতা করব।
স্হানীয় বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম বলেন, আল শাহরিয়ার করিম ফ্রিল্যান্সিং কাজ করে নিজের সফলতা অর্জন করেছে। আমরা চাই প্রশিক্ষণ নিয়ে তার মতো যাতে সফল হতে পারি।
আল শাহরিয়ত করিমের বাবা বজলুল করিম বলেন, আমার ছেলেকে দেশ সেরা ফ্রিল্যান্সার তৈরি করতে উৎসাহিত করেছিলাম আমি। আমার কাছে ভালো লাগে যে আমার ছেলে নিজে এ কাজ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন তার কাছ থেকে অনেক অনেক যুবক প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আমি চাই আমার ছেলের মতো তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুবকেরা প্রতিষ্ঠিত হোক।
এ ব্যাপারে মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাইনউদ্দীন বলেন, এখনকার সময় যুবকরা মাদকের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। কিন্তু তার ব্যতিক্র আল শাহরিয়ারত করিম।সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ফ্রিল্যান্সিং করে। আমি চাই তার দেখাদেখি যুবকরা উৎসাহিত হোক তার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা নিজেরা আত্মকর্মসংস্থার সৃষ্টি করুক।
রাকিব হাসান/আরকে