‘মুই কেমন করি তোক ভুলিম বাবারে’
‘মোর বাবার টেনশন আছিলো, কতদিনে চাকরি হবে, কতদিনে বিয়া করিবে। মোর বাবা যে এ রকম করিয়া যাবে রে, মোর বাবাকে মুই কোটে পাইম। মোর বাবা যে কত সুন্দর মোক বুঝায় ওরকম বুঝ মোক কায় দিবে। বয়স্ক মানুষের মতো বুঝায়, ধর্ম জ্ঞান দিয়া বুঝায়। মোর বাবা দেখিতো সুন্দর। ও বাবা তুই কেনে গেলু বাবা, মোক একবার তুই আও না করি কেনে গেলু বাবা। মুই কেমন করি তোক ভুলিম বাবারে। মোর জীবন যতদিন ততদিন কান্দাবু বাবারে।’
এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) শিক্ষার্থী গৌর চন্দ্র রায়ের মা পুষ্প রাণী রায়।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) বিকেল ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন মহাবলিপুরের কামিনী রায় ছাত্রাবাস থেকে গৌর চন্দ্র রায়ের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
গৌর চন্দ্র হাবিপ্রবির কৃষি অনুষদের ২৩ ব্যাচের (২০২২-২৩) ‘এ’ সেকশনের শিক্ষার্থী ও নীলফামারীর ডোমারের সোনারায়ের জামিরবাড়ি গুপ্তপাড়া এলাকার ভুবন চন্দ্র রায়ের ছেলে। তিনি ২০২০ সালে ডুগডুগি বড়গাছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০২২ সালে ডোমার সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে গৌর বড়।
শুক্রবার (১০ নভেম্বর) সকালে গৌর চন্দ্রের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার মা আহাজারি করছেন। আত্মীয়-স্বজনও শোকে মূহ্যমান। তার মৃত্যুর খবরে তার বাড়িতে এসে ভিড় করেছেন প্রতিবেশীরা।
গৌর চন্দ্রের মা পুষ্প রাণী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কয়েকদিন আগত মোর বাবা বাড়িত আসছিল, যাবার সময় ধরনীগঞ্জে ওর পিসির বাড়িতে ঢুগছে, যাবার পারে নাই হরতালের কারণে। মোর বাবা মোক কয়ছে, মুই যাবারে পারো নাই হরতালের কারণে, কাইলকা যাম মা। পরে মুই আর মোর বাবার সঙ্গে কথা কবারে পারো নাই। এতো হতভাগা কপাল পোড়া মুই মোর ফোনত টাকায় আছিল না। তার জন্যে ফোন দিবার পারো নাই মোর বাবাটাক। মোর বাবার সঙ্গে আও করিলে হয়তো বোধ পানু হয়। ভার্সিটি যেয়া বাবা মোর কি করলু রে। মোর বাবা মোক খালি বুঝ দেয় চাকরি করি সুন্দরী বউ আনি দিবে। চাকরির সাথে সাথে মোর বাবা বিয়াও করিবে। মোক কইছে বউকে বেটির মতো দেখবার।’
গৌর চন্দ্রের ছোট ভাই নিতাই চন্দ্র রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভাই ৮-১০ দিন আগে বাড়ি থেকে মেসে গেছে। দুইদিন আগে আমাকে ফোন দিয়ে টাকা চেয়েছিল। সেই টাকা গতকাল দিতে বিকাশের দোকানে গেছিলাম। সেখানে যাওয়ার পর থানা থেকে ফোন দিয়ে বলল- আপনার ভাই আত্মহত্যা করেছে।
গৌর চন্দ্রের মামাতো বোন রত্না রাণী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওর একটা রিলেশন ছিল, কিন্তু ওকে আমি ব্রেকআপ করতে বলছিলাম। কিন্তু ও বলেছিল না দিদি আমি এক নারীতেই আসক্ত। কিন্তু আমি ওকে অনেক বোঝাইছি যে দেখ তোর পড়াশোনা শেষ করতে অনেক সময় লাগবে। এতদিন ওর বাবা মা ওকে রাখবে না সমস্যা হবে। এই বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক চিন্তিত ছিলাম, ও যে ইমোশনাল এ জন্যই আমি তাকে ব্রেকআপ করতে বলছিলাম। তারপর ও ফেসবুকে যে পোস্টগুলা দিতো দেখতাম সব কিছু ঠিক আছে, আমি কথাও বলছি তখন সে বলেছে দেখ দিদি সব ঠিক আছে আগে জব পরে সব- এভাবেই বলছে। কিন্তু সে আমাকে একদিন র্যাগিংয়ের বিষয়টি জানিয়ে বলছে যে- আমাকে র্যাগ দেয়। মিছিলের কারণে আমি ওকে বলেছিলাম মিছিলে না গেলে কোনো সমস্যা হবে কী? বলে যে দিদি গেলে সমস্যা না গেলেও সমস্যা, বিভিন্ন রকম কথা শুনাবে। এর পর একদিন সে আমাকে বলে যে দিদি আমি আর এগুলাতে যাব না।
গৌর চন্দ্রের পিসিমা স্বপ্না রাণী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গৌর খুব শান্ত ছেলে। সে কোনো দিনের জন্য কাউকে কোনো ধরনের উচ্চ স্বরে কথা বলেনি। কিন্তু ছেলে বাইরে থাকে, কেন এমন করলো কীভাবে বলবো। ওর এমনিতেও কোনো সমস্যা ছিল না। ওই ভার্সিটিতে বলে পার্টি করার জন্য একবার বলছিল। ও তো করিবার চায় নাই। এ তো গ্রামে ছিল শান্ত, খুব ভদ্র, কোনো প্রকার ঝামেলায় যায় না। পূজায় নাচ গানেও সে যায় না। অনেক সময় সবার সামনে এমন বক্তব্য দেয় তার বক্তব্য শুনে সবাই তাকে অনেক আশীর্বাদ করে- অনেক বড় হবে সে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ইউপি সদস্য হরি কিশোর রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদেরকে থানা থেকে জানানোর পর আমরা প্রথমে থানায় যাই। পরে হাসপাতালে মরদেহ পাই। পরে আমরা থানার ওসি ও কলেজের শিক্ষকের সাথে কথা বলি। আজ ময়নাতদন্তের পর মরদেহ আমাদের কাছে হস্তান্তর করবে।
তিনি বলেন, গৌর খুব ভালো ছেলে। এলাকায় সে কম বেড়াতো। সব সময় ঘরে বসে পড়ালেখা করতো। আমরা সেখানে খবর নিয়ে শুনছি প্রেমজনিত কারণে আত্মহত্যা করতে পারে। তাকে নিয়ে আমরা অনেক আশা করছিলাম। সে ভালো পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করে এলাকার সুনাম অর্জন করবে। আমরা অনেক সুযোগ-সুবিধা তার মাধ্যমে পাব। সব শেষ হয়ে গেল।
আরএআর