ভ্যানচালক বাদশা যেন ‘জীবন্ত মানচিত্র’
বাদশা মিয়া, পেশায় ভ্যানচালক। নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। কিন্তু রয়েছে আশ্চর্য করার মতো প্রতিভা। মাত্র এক মিনিট ১১ সেকেন্ডে বলে ফেলেন বিশ্বের সব দেশের নাম। শুধু তাই নয় মাত্র ২৫ সেকেন্ডে বলতে পারেন দেশের ৬৪ জেলার নাম। শুধু মুখস্থ নয় যেন সবকিছুই তার ঠোঁটস্থ। লেখাপড়া না জানা বাদশা মিয়া বাংলাদেশের সকল জেলা, উপজেলা ও থানার নামও বলতে পারেন। এমন বিস্ময়কর প্রতিভার কারণে গ্রামের লোকেরা তাকে ‘জীবন্ত মানচিত্র’ নামে ডাকেন।
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৫ নম্বর তাকুল ইসাদ গ্রামের বাসিন্দা ভ্যানচালক বাদশা মিয়া। অভাবের সংসারে প্রাথমিকে বই কলম ছেড়ে ভ্যানের প্যাডেল ধরলেও বাদশা এখন জীবন্ত মানচিত্র হিসেবে পরিচিত উপজেলাজুড়ে। জীবনসংগ্রামে যুদ্ধ করে চলেছেন তিনি। ছোটবেলায় এলাকার মক্তবে কোরআন শিক্ষা গ্রহণ করে ধর্মের প্রতি সর্বদা অনুগত বাদশা মিয়া। তাই আল্লার ৯৯ নামও ২৬ সেকেন্ডে বলার দক্ষতা আয়ত্ত করতে পেরেছেন।
ছন্দে ছন্দে বাদশা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মনে অনেক কষ্ট, বুকে অনেক ব্যথা। এতকিছু শিখেও আমি পাইনি সফলতা। তাই তো এখনো চালাই অটোরিকশা, নাম বাদশা বাসা পীরগাছা। দুঃখে ভরপুর জেলা আমার রংপুর। আমি মূর্খ হতে পারি অভদ্র নই। অশিক্ষিত হতে পারি অভস্য নই। এক কথা এক জবান, নাম আমার বাদশা দেওয়ান।
এখানেই থেমে থাকেনি ভ্যানচালক বাদশার জ্ঞান চর্চার পরিধি। গ্রামের মেলা থেকে কিনে আনা একটি মানচিত্র দেখে বিশ্বের সবকটি দেশের নাম মুখস্থ করার নেশায় সহযোগী ছিল তার ছোট বোন। প্রতিদিন দশটি করে দেশের নাম ধারণ করতে করতে এখন তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন ‘মানচিত্র বাদশা’। আল্লাহর নাম, গুণগানও গাইতে পারেন- বলেন বাদশা।
পরিবারে অসুস্থ বাবা আর বৃদ্ধা মাকে নিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে নিজেকে দৃঢ় করে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন বাদশা। স্বপ্ন পূরণে চান সরকারসহ বিত্তবানদের সহযোগিতা। এলাকাবাসীর মতো আর ছেলের কর্ম ও সদাচরণে খুশি বাদশার বাবা-মাও।
বাদশার বাবা আব্দুল হামিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছেলের প্রতিভা দেখে তো ভালো লাগে। মানুষ ওর (ছেলের) প্রশংসা করলে নিজেকে গর্বিত মনে হয়। আমার ছেলে তো শিক্ষিত না কিন্তু তারপরও অনেক শিক্ষিত ও গুণীজ্ঞানী মানুষ যা বলতে পারবে না সেটা বলতে পারে। অভাবের কারণে ছেলেকে আমি লেখাপড়া করাতে পারিনি। এখনো অভাবের সঙ্গেই আমাদের সংসার টেনেটুনে চলছে। তারপরও ছেলের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।
মা মোর্শেদা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘হামার সংসারের হাল ধরার মতো কায়ো নাই। ব্যাটা কোনায় সোগ। ভ্যান চালাবার পাশাপাশি ওই (ছেলে) যা শিখছে, তার শুনি হামরা নিজেরাও খুশি। আল্লাহর রহমতে ছাওয়াটা খুব মেধাবী কিন্তুক অভাবের কারণে পড়ালেখা করাবার পাই নাই। বইনের কাছ থেকে মানচিত্র দেখি দেখি বাদশা অনেক কিছু শিখছে।’
লিখতে বা পড়তে না পারলেও বাদশা মিয়া তার মনের ডায়েরিতে প্রতিনিয়ত লিপিবদ্ধ করে চলেছেন এসব প্রতিভার পাশাপাশি নতুন নতুন গানও। তাই প্রত্যাশা সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থেকে স্বপ্ন জয়ী হতে চান তিনি। দরিদ্র পরিবারের ছেলে বাদশার এমন বিরল প্রতিভায় পঞ্চমুখ পুরো এলাকাজুড়ে। জীবিকার তাগিদে ভ্যান নিয়ে বের হলেই যাত্রীসহ সব বয়সীর মানুষ আবদার করে বসেন বাদশার মুখ থেকে প্রতিভাগুলো শুনতে।
স্থানীয় প্রতিবেশী মাহাতাব হোসেন বলেন, আমি অনেককে দেখেছি কিছু দেশের বা এলাকার নাম মুখস্থ বলতে পারে। কিন্তু বাদশার মতো বিশ্বের সব দেশের নাম, বাংলাদেশের জেলা, উপজেলা ও থানার নাম বলতে পারা মানুষ দেখেনি। আমার কাছে বাদশাকে বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী মনে হয়। ভীষণ ভালো লাগে যখন মাত্র কয়েক সেকেন্ড সবকিছু চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে। আমরা তার প্রতিভায় গর্ববোধ করি। তিনি আমাদের এলাকাকে আলাদা ভাবে পরিচিত করে তুলেছে।
মামুন মিয়া নামে আরেকজন বলেন, মানুষের ইচ্ছা শক্তিতে যে অনেক কিছুই আয়ত্ত করা সম্ভব, তার উদাহরণ আমাদের গ্রামের বাদশা মিয়া। দেশবিদেশের নাম, আল্লাহর ৯৯টি নাম, বিভিন্ন গানের সুর সবকিছুই যেন তার ঠোটে লেগে আছে। তার প্রতিভা দেখে সবাই খুশি। তার সঙ্গে কথা বলার জন্য অনেকেই ভ্যানে চড়ে ঘুরে বেড়ান। আমরা চাই অসহায় এই পরিবারের পাশে সরকার এগিয়ে আসুক।
বাদশা মিয়ার প্রতিভা নিয়ে সাধারণ মানুষের মতো গর্ববোধ করেন পীরগাছা সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. মোস্তাফিজার রহমান। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, প্রতিদিন শুনি রংপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষজন ওই ছেলেকে দেখতে আসে। ভ্যানে চড়ে ঘুরে ঘুরে বাদশার কাছ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাম শুনে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডে দেশবিদেশের নাম মুখস্থ বলতে পারা তো সহজ কাজ না। এটা যে বাদশা আয়ত্ত করতে পেরেছে, এ জন্য আমরা তার প্রশংসা করি। তার প্রতিভার সুনাম এখন পুরো উপজেলাতে ছড়িয়ে পড়েছে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএএ