হিজড়া হিসেবেই ভোট দেবেন তারা

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত সদস্য মারুফা আক্তার মিতু। তিনি পুরো জেলার তৃতীয় লিঙ্গের প্রথম নির্বাচিত ইউপি সদস্য। মিতুর মতো দেশের বিভিন্নস্থানে তৃতীয় লিঙ্গের অনেকই প্রার্থী হয়েছেন। কেউ কেউ জনপ্রতিনিধিও হয়েছেন। তবে এবারই প্রথম রংপুর-৩ আসন থেকে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করছেন আনোয়ারা ইসলাম রানী। নিজ পরিচয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পেয়ে উচ্ছ্বসিত রানী। আর ভোট প্রদানের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় খুশি তৃতীয় লিঙ্গের অন্য সদস্যরাও।
এবারের ভোটার তালিকা অনুযায়ী রংপুর জেলায় তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছে ২৪ জন। তবে জেলার অন্তত চার শতাধিক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে লিঙ্গ পরিবর্তনের আবেদন করেছিলেন।
ন্যায় অধিকার ট্রান্সজেন্ডার উন্নয়ন সংস্থা সূত্রে জানা যায়, রংপুর জেলার চার শতাধিক হিজড়া তাদের পরিচয়পত্রে লিঙ্গ পরিবর্তনের আবেদন করেছিলেন। ২৪ জন তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পেরেছেন। যারা এবারের সংসদ নির্বাচনে নিজ লিঙ্গ পরিচয়ে ভোট দেবেন।
রংপুরের ৬টি সংসদীয় আসনে মোট ভোটার ২৪ লাখ ৩২ হাজার ৫০৫ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার রয়েছে ১২ লাখ ২০ হাজার ৩৯৪ জন। পুরুষ ১২ লাখ ১২ হাজার ৮৭ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছে ২৪ জন। ভোটার তালিকা অনুযায়ী রংপুর-১ আসনে তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ২ জন, রংপুর-২ আসনে তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছে ৪ জন, রংপুর-৩ আসনে ২ জন, রংপুর-৪ আসনে ৪ জন, রংপুর-৫ আসনে ৪ জন ভোটার এবং রংপুর-৬ আসনে রয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের ৪ জন ভোটার। তবে তারা তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারেননি তাদের অনেকেই নারী-পুরুষ পরিচয়ে ভোটার তালিকায় আন্তর্ভুক্ত রয়েছেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গ বা ‘হিজড়া’ হিসেবে পরিচিত মানুষদের লিঙ্গ পরিচয়কে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার পরও এতোদিন নারী বা পুরুষ পরিচয় বহন করেই নথিভুক্ত হতে হয়েছে। ২০১৩ সালে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয় সরকার। ভোটার তালিকায় নারী ও পুরুষের পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে আরেকটি পরিচয় অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন।
সমাজের অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে লক্ষ্যে ২০০৯ সালে ‘ন্যায় অধিকার ট্রান্সজেন্ডার উন্নয়ন সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন গড়ে উঠে। এই সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি সদস্য মারুফা আক্তার মিতু বলেন, আমরা পোশাক পরি নারীদের, কিন্তু ভোট দিতাম পুরুষের নামে। এতে আমরা মন থেকে আনন্দ পেতাম না। এবারই আমাদের মধ্য থেকে প্রথমবার অনেকেই নিজস্ব পরিচয়ে ভোট দেবেন। এটা শুধু আনন্দের নয় আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে যাবার একটি অংশ।
তিনি বলেন, আমাদের একজন এবার সংসদ নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সমাজ ও রাষ্ট্র আমাদেরকে একটু সহানুভূতি ও সহযোগিতা করলে আমরাও অন্য আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারব, একই সঙ্গে জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারব।
সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও রংপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আনোয়ারা ইসলাম রানী জানান, ইতোপূর্বে অনেক নির্বাচনে হিজড়ারা পুরুষ ও নারী পরিচয়ে তাদের ভোট দিয়েছেন। তিনি গত বছর সর্বশেষ রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে হিজড়া পরিচয়ে তার ভোট দিয়েছেন। কিন্তু এবারই প্রথম হিজড়া পরিচয়ে তাদের অনেকেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেবেন। বিষয়টি তাদের জন্য অনেক বেশি আনন্দের। এজন্য তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
তিনি জানান, আমরা সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর একাংশ। মানুষ আগে আমাদের যেভাবে দেখতো, এখন সেই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে নাগরিক হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন। আমাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ করে দিয়েছেন। এখন তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীও দেশের জন্য, সমাজের জন্য কিছু কিছু কাজ করছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবার তিনি অংশ নিয়েছেন। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলে স্বগোত্রীয় মানুষজনকে মূলধারায় চালিত করতে তিনি সকল ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। সেই সঙ্গে মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেবেন।
রংপুর জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান জানান, বর্তমানে রংপুর-১ আসনে নয়জন, রংপুর-২ আসনে তিনজন, রংপুর-৩ আসনে ছয়জন, রংপুর-৪ আসনে তিনজন, রংপুর-৫ আসনে আটজন এবং রংপুর-৬ আসনে সাতজনসহ মোট ৩৬ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
তিনি আরও জানান, জেলায় মোট ভোটার ২৪ লাখ ৩২ হাজার ৫০৫ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার রয়েছে ১২ লাখ ২০ হাজার ৩৯৪ জন। পুরুষ ১২ লাখ ১২ হাজার ৮৭ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ২৪ জন ভোটার রয়েছে। জেলার মোট ৮৫৮টি ভোটকেন্দ্রের ৫ হাজার ১৭৬টি ভোটকক্ষে ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা করেছে নির্বাচন কমিশন। আগামী ৭ জানুয়ারি রোববার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
এমএএস