কামরুল এখন চাকরিদাতা

শেরপুর সদর উপজেলার চরশেরপুর ইউনিয়নের পূর্বপাড়া (হাইটাপাড়া) গ্রামে গড়ে উঠেছে তাঁতকুটির। যেখানে চাহিদাসম্পন্ন ও উন্নত মানের জামদানি শাড়ির পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে টু পিস কাপড়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কারিগররা তাদের সুনিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলছেন বিভিন্ন রঙের ও নানা ডিজাইনের এসব কাপড়।
২০০৭ সালে কামরুলের পুঁজি ছিল মাত্র ১৭ হাজার টাকা। বর্তমানে তার মোট পুঁজি ১০ লাখ টাকার বেশি। কামরুল জানান, এখন তার ছোট-বড় মিলিয়ে ১৬টি তাঁত মেশিন আছে। যেখানে ১৬ থেকে ২০ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় চরশেরপুর তাঁতকুটিরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মো. কামরুলের (৩৫) সঙ্গে। তিনি ওই এলাকার আমীর হামজার (৬০) ছেলে।
ঢাকা পোস্টকে কামরুল বলেন, আমি ২০০০ সালের দিকে কাজের সন্ধানে ঢাকা রওনা হই। সেখানে কোনো আত্মীয়স্বজন না থাকায় উঠি নারায়ণগঞ্জে ফুফুর বাড়িতে। পরে একটা তাঁতকলে চাকরি নিই। কাজ শেখার একপর্যায়ে চিন্তা করি, এবার নিজের এলাকায় গিয়ে এই কাজ করব। তাই ২০০৭ সালে শেরপুরে ফিরে এসে একটা তাঁত দিয়ে জামদানি শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করি।
তিনি বলেন, এরপর ২০০৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত চরম হতাশায় ভুগি। বারবার ব্যাগ গুছিয়েছি যে পুনরায় ঢাকা চলে যাব। কিন্তু পরে আবার নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছি এই বলে যে হার মানা চলবে না। যা-ই হোক চেষ্টা আর ধৈর্য ধরে সফলতা এনেছি। বর্তমানে আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছি।

একটি শাড়ি তৈরিতে কতজন শ্রমিক, কত পারিশ্রমিক আর কত দিন লাগে, এমন প্রশ্নে কামরুল জানান, দুজন শ্রমিক মিলে চার দিনে একটি জামদানি শাড়ি তৈরি করেন। প্রতিটা জামদানি শাড়ির জন্য এক-একজন শ্রমিক পারিশ্রমিক হিসেবে পান ছয় হাজার টাকা করে। প্রতিটি শাড়ির পাইকারি মূল্য ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা এবং টু পিস ২৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
এই জামদানি শাড়ির ক্রেতা কারা, এ বিষয়ে কামরুল জানান, জামদানি শাড়িগুলো জমিয়ে মাসে একবার ঢাকার পাইকারদের কাছে পাঠিয়ে দেন। এই কাজে তিনি স্থানীয় বাস পরিবহন ব্যবহার করেন। শাড়ি বুঝে পেয়ে সেই একই গাড়িতে পাইকাররা জামদানি তৈরির প্রয়োজনীয় সুতা পাঠিয়ে দেন। এরপর তিনি সেটি শেরপুর থেকে সংগ্রহ করে নেন।
লাভের ব্যাপারে কামরুল জানান, প্রতি তিন মাস পরপর হিসাব করে দেখেন, সব খরচ বাদ দিয়ে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা লাভ থাকে। এতে প্রতি মাসে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকারও বেশি আয় হয়।
স্থানীয় এক তাঁত কারিগর গোলাম মাওলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কলেজ পাস করে বেকার হয়ে এদিক-সেদিক ঘুরতাম। আমাদের গ্রামে কামরুল ভাই তাঁত মেশিন নিয়ে আসার পর তার কাছে কাজ শিখেছি। এখন এখানে কাজ করে যা বেতন পাই, আলহামদুলিল্লাহ।
স্থানীয় আরেক তাঁতশ্রমিক রমজান ইসলাম বলেন, আমার বাবা দরিদ্র কৃষক ছিলেন। পরিবারের সব খরচ তিনি একা বহন করতে হিমশিম খেতেন। কামরুল ভাইয়ের কাছে দীর্ঘ ৫ থেকে ৬ বছর কাজ শিখে এখন নিজেই কাপড় বুনতে পারি। মাস শেষে ১০ হাজার টাকা বেতন পাই, যা দিয়ে মা-বাবাকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে আছি।
নারী তাঁত কারিগর ইয়াসমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রামের নারীদের অনেক নিয়ম মানতে হয়। পরিবারের অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে কোথাও যাওয়া যায় না। এ ছাড়া আমাদের গৃহস্থালি ও সন্তান সামলাতে হয়। কামরুল ভাই এলাকায় তাঁত মেশিন নিয়ে এলে আমরা নারীরা নিজ উদ্যোগে তাঁতের কাজ শিখি। এরপর কামরুল ভাইকে অনুরোধ করলে তিনি আমাদের বাড়ির ভেতরে কয়েকটি তাঁত মেশিন স্থাপন করে দেন। এতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিজ বাড়িতেই পর্দার ভেতরে থেকে কাজ করতে পারি।

এ বিষয়ে শেরপুর সদর উপজেলার চরশেরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ইউপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন সুরুজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, কামরুলের তাঁতের খবর এখন শেরপুরের সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আমার কোনো সহযোগিতা লাগলে আমি সব সময় করতে প্রস্তুত।
তিনি বলেন, এই তাঁত নিয়ে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা করছেন। কদিন আগে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কামরুলসহ তার সব তাঁত কারিগরকে নিয়ে জেলা প্রশাসক একটা সভা করেছেন।
শেরপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফিরোজ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইতোমধ্যে আমি চরশেরপুরের ওই তাঁত কুটির পরিদর্শন করেছি। জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় তাদের কাজকে আরও বেগবান করতে উপজেলা প্রশাসন থেকে সব সময় খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। তাদের যাতায়াত করার রাস্তাটি কাঁচা। তাই সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছিল যেসব স্থানে গর্ত, সেখানে মাটি দিয়ে ভরাট করতে এবং চেয়ারম্যান সেটি করেছেন।
ইউএনও বলেন, ওই তাঁত কুটিরের স্বত্বাধিকারী কামরুলের আবেদন যেন রাস্তাটি পুরো পাকাকরণ করা হয়, তাই সামনে কোনো বরাদ্দ থাকলে আমরা অবশ্যই সেটি করে দেব।
এনএ