হঠাৎ দিশেহারা ২০ বেদে পরিবার

নরসিংদী সদরের বড় বাজার-সংলগ্ন হাড়িধোয়া নদী। একটা কচুরিপানা ভাসছে, জংলার মতো কিছু একটায় ঠেকল। একটু পর ঢেউয়ের তোড়ে আবার ভেসে চলল। বিষয়টা লক্ষ করছে নদীর পাড়ে দাঁড়ানো সাত বছরের এক শিশু। নদীর পাড়েই বেদেপল্লিতে থাকে সে। ভেতর থেকে শিশুটিকে ডাকছেন পাশের খুপরিতে থাকা সানোয়ারা বেগম। কারণ, সবকিছু গোছাতে হবে, হাতে আর সময় নেই।
কিন্তু তারা কোথায় যাবেন, নিজেরাও জানেন না। জীবন যে তাদের অনেকটা কচুরিপানার মতোই। ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যায় এক নদী থেকে অন্য নদীতে, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়।
স্থানীয় এক ব্যক্তির জমির ওপর তারা বসতি গড়ে তোলেন। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে বসতি, হয়ে ওঠে পল্লি। কিন্তু এই পল্লির খুপরি ঘরগুলোয় অট্টালিকার চেয়েও বড় স্বপ্ন নিয়ে যারা এত দিন ঘর বেঁধেছিলেন, তাদের এখন ছেড়ে দিতে হচ্ছে এই জায়গা। কারণ, জমির মালিক তাদের বলেছেন জায়গা খালি করে দিতে।
সরেজমিনে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আনুমানিক ৫০ বছর আগে তারা এখানে নোঙর করে। নৌকায় করে এই এলাকায় থেকে আশপাশের অঞ্চলে তাবিজ, বাসন, পেয়ালা ফেরি করেই চলত তাদের সংসার। আধুনিককাল ও প্রযুক্তির বিস্তারে বেদেদের কাছ থেকে এসব পণ্য এখন আর কেউ কেনে না। তাই তাদের স্বাভাবিক জীবন ও জীবিকায় নেমে আসে ধস। তাদের তাবিজেরও এখন বিক্রি নেই। আর ফেরি করা বাসন, পেয়ালার প্রতিও ঝোঁক নেই তেমন একটা। স্বভাবতই তাদের আয় কমে গেছে। তাই নৌকায় থাকাটা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
এদিকে আর্থিক সংকটে নতুন নৌকা বানান না তারা। আবার ভাঙা নৌকা পড়ে থাকে নদীর পাড়ে। অনেকের নৌকা এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে হাড়িধোয়ার বুকে। সবশেষ আট বছর আগে নৌকা ছেড়ে নদীর পাড়ে অন্যের ব্যক্তিগত মালিকানার এক পতিত জমিতে খুপরি ঘর বেঁধে তারা বসবাস শুরু করেন। তখন তারা পেশা হিসেবে বেছে নেন দিনমজুরিকে। অনেকে আবার মনোযোগ দেন রিকশা চালনায়, কুলির ভার টানা, মাছের বাজারে কাজ করা ইত্যাদি।
এরই মধ্যে অনেক পরিবার এই খুপরি ঘর ছেড়েও চলে যায় অন্যত্র। তাদের মধ্যে অনেকে হয়ে যান হাজিপুর ইউনিয়ন পরিষদের ভোটার। কিন্তু জমির মালিক যখন জমির দখল বুঝে নিতে চান, বিপাকে পড়ে প্রায় ২০টি পরিবারের ১০০-রও বেশি মানুষ। এর মধ্যে এখানকার ভোটার ৫০ জনের বেশি। তাদের ভাষ্য, জমির মালিক এত দিন দয়া করেই তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন।
সালাম মিয়া (৫৭) নামের এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে আমাদের অবস্থা এত খারাপ ছিল না। নৌকায় থাকাটাই আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছিল। আট বছর আগে ডাঙায় এসে থাকা শুরু করি। জমির মালিকও দয়া করে থাকতে দেন। এখন উনার জমির প্রয়োজন হইছে, উনি জমি চাইতেই পারেন, এটা সমস্যা না। সমস্যাটা হলো আমাদের দেখার কেউ নাই।

সানোয়ারা বেগম নামের একজন বলেন, করোনার সমস্যায় থাকাকালীনও আমার কিছু পাইনি। আমাদের থাকার জায়গা নাই। কিছুদিন পরপর দুই মাস, তিন মাসের সময় আনি জমির মালিকের কাছ থেকে। এখানকার মেম্বার-চেয়ারম্যানও আমাদের দিকে তাকায় না। এভাবে আর কত? আমারা আমাদের থাকার জায়গা চাই। সরকার যদি একটু দেখত আমাদের, তাহলে আমার ভালো থাকতাম।
আসাদ মিয়া এখানে থাকেন শুরু থেকেই। ৪০ বছর ছিলেন নৌকায়। বছর দশেক আগে নৌকা ভেঙে গেলে ডাঙায় চলে আসেন। এখন ডাঙার খুপরিটাও হয়তো ছাড়তে হচ্ছে। তিনি বলেন, যার জমি, তিনি এমনটা চাইতেই পারেন। আমরা জমি খালি করে দেব। কিন্তু সরকার আমাদের কিছু দিক। আমাদের তো এই দেশেই জন্ম। আমার আর কত কষ্ট করব?
বেদেদের এই সমস্যা নিয়ে কথা হয় হাজিপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ইউসুফ খান পিন্টুর সঙ্গে। তিনি বলেন, নদীর পাড়ের জায়গাটা সরকারি না, ব্যক্তিগত। ব্যক্তি চাইলে অবশ্যই জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। তাদের থাকার জায়গার বিষয়ে সরকারি জায়গা খুঁজছি, পেয়ে গেলে আমরা জায়গার ব্যবস্থা করে দেব। তাদের এ বিষয়টা আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখব।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন নরসিংদী জেলা শাখার সভাপতি নুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, তাদের বিষয়টি দুঃখজনক। আমরা নরসিংদীতে নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই আমরা কাজ করব। সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে কতটুকু কী করা যায়, তা দেখব।
নরসিংদীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি, সার্বিক) মুশফিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, তাদের জন্য অবশ্যই আমাদের করণীয় আছে। আগে বিষয়টি জানা ছিল না। এখন জানলাম। এ বিষয়ে আমি খোঁজখবর নিয়ে সত্যতা যাচাই করে তাদের জন্য কিছু করব।
এনএ