রিকশাচালকের সেই সন্তানের চিকিৎসা করাবেন স্বপ্ন’র সাব্বির নাসির

অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া না থাকায় ৯ ঘণ্টায় রিকশা চালিয়ে ঠাঁকুরগাও থেকে অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন এক অসহায় বাবা। সন্তানকে বাঁচাতে ১১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে পৌঁছানো বাবার পাশে দাঁড়িয়েছেন অনেকেই। ফলে বিষণ্নতা কেটে গেছে তার।
৯ ঘণ্টা রিকশা চালিয়ে সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে বাবা শিরোনামে শনিবার (১৭ এপ্রিল) ঢাকা পোস্টে সংবাদ প্রচারের পর শিশুটির চিকিৎসায় এগিয়ে আসেন অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।
রোববার (১৮ এপ্রিল) দেশের বৃহত্তম সুপারশপ স্বপ্ন-এর নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির ব্যক্তি উদ্যোগে শিশুটির চিকিৎসার খরচ বহন করবেন বলে জানিয়েছেন।
দুপুরে রংপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদ হাসান মৃধা অসুস্থ শিশুটিকে দেখতে যান। এ সময় তিনি বলেন জেলা প্রশাসক মো. আসিব আহসান শিশুটির চিকিৎসাব্যয় বহন করবেন বলে জানিয়েছেন। এ সময় শিশুটির মায়ের হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেন ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদ হাসান মৃধা।
আরও সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন শিশু জান্নাতের রিকশাচালক বাবা তারেক ইসলাম।
ঢাকা পোস্টের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটায় লাইভ সংবাদ প্রচার এবং সন্ধ্যায় রিকশা চালিয়ে মেডিকেলে আসা তারেক ইসলামকে নিয়ে ভিডিওসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
এরপর তারেক ইসলামকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফোন করে তার শিশুর খোঁজখবর নেন। অনেকেই তারেক ইসলামের বিকাশ নম্বরে সহায়তা পাঠিয়েছেন।
তারেক ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাত মাসের শিশু জান্নাত রক্ত পায়খানা করায় ১৩ এপ্রিল রাতে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে ভর্তি করি। সেখানে একদিন চিকিৎসা দেওয়ার পর চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য জান্নাতকে রংপুরে রেফার্ড করেন। কিন্তু লকডাউন পরিস্থিতি এবং অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া না থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়ি। চারদিন ধরে কোনো ব্যবস্থা করতে না পেরে অবশেষে ঠাঁকুরগাও থেকে রিকশা চালিয়ে সন্তানকে নিয়ে রংপুরে আসি। এ নিয়ে ঢাকা পোস্ট সর্বপ্রথম সংবাদ প্রচার করে। এরপর থেকে বিভিন্নভাবে সহায়তার জন্য হৃদয়বানরা এগিয়ে এসেছেন।
তিনি আরও বলেন, শুক্রবার রাতে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতাল থেকে রাতে শিশুকে নিয়ে বাসায় যাই। শিশুর অবস্থা দেখে আমি চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু লকডাউনের কারণে আমার হাতের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, কালকে কি খাব সে টাকাও নেই। এ অবস্থায় আমি কীভাবে সন্তানকে নিয়ে এত দূর যাব ভেবে পাচ্ছিলাম না। যখন অ্যাম্বুলেন্সের টাকা জোগাড় করতে পারলাম না। তখন সন্তানকে বাঁচানোর জন্য রিকশা চালিয়ে রংপুরে আসার সিদ্ধান্ত নিই এবং অনেক কষ্ট করে ১১০ কিলোমিটারের মতো পথ পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে আসি। রংপুরে আসার সংবাদটি ফেসবুকে দেখার পর সুপার শপ স্বপ্ন-এর নির্বাহী পরিচালক চিকিৎসার সব খরচ বহনের দায়িত্ব নিয়েছেন। এখন আমার কোনো চিন্তা নেই। আল্লাহর রহমতে সন্তানকে সুস্থ অবস্থায় বাড়ি নিয়ে ফিরতে চাই।
শিশু জান্নাতের মা সুলতানা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন অনেক ভালো লাগছে। সন্তানের অবস্থা আগের চেয়ে একটু ভালো। সকালে ডাক্তার দেখে বেশকিছু পরীক্ষা করতে দিয়েছেন। অপারেশনসহ ওষুধপত্রের সব ব্যবস্থা করে দেবে স্বপ্ন। রোববার সকালে উই ফর দেম নামে একটি সংগঠন পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছে। এছাড়া বিভিন্নজনের কাছ থেকে আমরা আর্থিক সহায়তা পেয়েছি। সবার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
দুপুরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশুটির বাবা তারেক ইসলামের হাতে আর্থিক সহায়তা তুলে দিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উই ফর দেম-এর প্রতিষ্ঠাতা জীবন ঘোষ বলেন, সবাই যদি যার যার অবস্থান থেকে এমন অসহায় মানুষের পাশে এগিয়ে আসতে পারেন, তাহলে কাউকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে না। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেছি সহযোগিতা করার। মূলত এমন মানবিক কাজে এগিয়ে আসতে পারাটাও সৌভাগ্যের ব্যাপার।
শিশুটির অস্ত্রোপচারসহ চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার প্রসঙ্গে সুপারশপ স্বপ্ন-এর রংপুর ব্রাঞ্চের অপারেশন ম্যানেজার ফয়সাল সামস ঢাকা পোস্টকে বলেন, গণমাধ্যমে বিষয়টি দেখে আমাদের নজরে আসে। এরপর শিশুটির চিকিৎসাব্যয় বহনের দায়িত্ব নেন স্বপ্ন-এর নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির। আমাদের চারজন প্রতিনিধি সার্বক্ষণিক শিশুটির পরিবারের সঙ্গে থেকে সার্বিক সহযোগিতাসহ চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ, ওষুধপত্র সংগ্রহ ও অস্ত্রোপচারের ব্যাপারে কাজ করছেন। সাব্বির হাসান নাসির ব্যক্তি উদ্যোগে শিশুটির চিকিৎসাব্যয় বহন করবেন।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার দক্ষিণ সালন্দর গ্রামের রামবাবুর গোডাউন এলাকার আনোয়ার হোসেনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তারেক ইসলাম সবার বড়। তিনি ১২ বছর বয়সে রিকশা চালিয়ে বাবার সংসারের বোঝা সামলানোর যুদ্ধ শুরু করেন। বিয়ের পর স্ত্রী সুলতানা বেগমকে নিয়ে আলাদা থাকা শুরু করেন। সংসার জীবনে তার নয় বছর ও তিন বছরের আরও দুই মেয়ে আছে।
তারেক রিকশা চালানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ওয়াজ মাহফিলে সাউন্ড সিস্টেম অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু করোনার মহামারি শুরুর পর থেকে অনুষ্ঠান না থাকায় তার বাড়তি আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে লকডাউন পরিস্থিতিতে ঠিকমতো রিকশা চালাতে না পেরে অসহনীয় কষ্ট নেমে এসেছে তার পরিবারে।
হাসপাতালের শিশু সার্জারি ওয়ার্ডের কর্তব্যরত চিকিৎসক সহকারী রেজিস্ট্রার ওপেন্দ্র নাথ রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিশুর পেটে নাড়ি উল্টে পেঁচিয়ে রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষার ফল হাতে আসার পর শিশুটির অস্ত্রোপচার করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। তবে শনিবার ঠাঁকুরগাও থেকে শিশুটিকে যে অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। শিশুটির অবস্থা আগের চেয়ে ভালো।
এএম