অবৈধ ইটভাটার ধোঁয়ায় বিপাকে আশ্রয়ণের বাসিন্দারা
গ্রামের কয়েকটি স্থায়ী বসতবাড়িসহ প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসরত শিশু-বৃদ্ধসহ প্রায় সকলেই ভুগছেন শ্বাসকষ্টে। জমিসহ ঘর পেয়ে আশ্রয়হীন এসব মানুষ নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখলেও ধোঁয়ার কারণে সেই স্বপ্ন গুঁড়েবালি হতে চলেছে। একদিকে ধোঁয়ায় অতিষ্ঠ জীবন, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী বাড়ির আঙিনায় বিভিন্ন ফলজ গাছ বপন করলেও তাতে ফল ধরে না। স্থায়ী বাসিন্দাসহ প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের জীবন এভাবেই অতিষ্ঠ করে তুলেছে অনুমোদনবিহীন একটি ইটভাটা।
সম্প্রতি শরীয়তপুর সদর উপজেলার শৌলপাড়া ইউনিয়নের খলিফা কান্দি এলাকার গয়ঘর গ্রামের মেসার্স জাজিরা (ঢাকা) ব্রিক ফিল্ড অ্যান্ড কোম্পানি এলাকার আশপাশে এমন চিত্র দেখা গেছে।
বেশ কয়েক বছর ধরে গয়ঘর গ্রামের ফসলি মাঠের মধ্যবর্তী স্থান ও বসতবাড়ির সন্নিকটে ইটভাটা নির্মাণ করে ইট তৈরি করে আসছে সেলিম হোসাইন জাকির নামের এক ব্যবসায়ী। মানুষের স্বাস্থ্যসহ পরিবেশের ক্ষতি হয় না দাবি করে ইটভাটাটির ম্যানেজার ইট তৈরির লাইসেন্সসহ বেশ কিছু নথিপত্র দেখায় সংবাদকর্মীদের। তাতে দেখা যায়, ২০২০ সালে ইটভাটার এক কিলোমিটারের মধ্যে স্কুল থাকায় ইট তৈরি করতে লাইসেন্সের নবায়ন না করে লাইসেন্স বাতিল করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। ১২০ ফিট জিগজ্যাগ চিমনির মাধ্যমে ধোঁয়া নির্গত হয় বলে ধোঁয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় দাবি করে ভাটা কর্তৃপক্ষ পরিবেশ অধিদপ্তরে লাইসেন্স নবায়ন করার আবেদন করলেও পরিবেশ অধিদপ্তর লাইসেন্স প্রদান করেনি।
এ ছাড়া ইটভাটা কর্তৃপক্ষ শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ইট প্রস্তুতকরণের যে লাইসেন্স নিয়েছে, তার মেয়াদও শেষ হয়েছে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে। আর ভাটা কর্তৃপক্ষ শৌলপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের লাইসেন্সের সনদপত্র দেখালেও পরিষদটির সচিব ও চেয়ারম্যান জানিয়েছেন ইটভাটার মালিকপক্ষ বা তাদের কোনো প্রতিনিধি লাইসেন্স নিতে পরিষদে আসেননি। এভাবেই অনুমোদনবিহীন কাগজপত্রের মাধ্যমে ইট প্রস্তুত ও ইটভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ লঙ্ঘন করে লোকালয়ে ইটভাটা নির্মাণ করায় স্থানীয় ও প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের বসবাসরত বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত ভুগছেন বায়ুবাহিত বিভিন্ন রোগে।
রেজিয়া পারভীন নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইটভাটার কারণে বসতবাড়ির নারকেল, লেবু, বারোমাসি মরিচসহ কোনো ফসলই হচ্ছে না। ধোঁয়ায় শিশু-বৃদ্ধ সবাই শ্বাসকষ্টে ভোগেন।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা খালেদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জমিসহ ঘর দিয়ে আমাদের বলেছেন গাছ লাগিয়ে তরকারি উৎপাদন করতে। কিন্তু এই ইটভাটার কারণে কোনো গাছে ফসল হয় না। বাচ্চাদের ১২ মাস শ্বাসকষ্ট, কাশি, গলাব্যথাসহ বিভিন্ন রোগ লেগেই থাকে। কিছু বললেই কয়, তোমরা হইলা দুই দিনের বাসিন্দা। সরকার এখন তোমাদের দিয়েছে, দুই দিন পর উঠায়া দিলে কী করবা? আমরা কী প্রতিবাদ করার সাহস রাখি!’
সালেহা বেগম নামের এক বৃদ্ধা বলেন, ‘শ্বাসকষ্টে কিছু দিন আগে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম প্রায়। শ্বাসকষ্টে দম ছাড়তে পারিনি, কথা বলতে পারিনি। এই যে গাছপালা লাগিয়েছি, এসব গাছে কোনো ফসল হয় না। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা সারাক্ষণ শ্বাসকষ্ট, কাশি, সর্দিতে ভুগছে। অসুস্থ হয়ে ঢাকায় গিয়েছিলাম। সুস্থ হয়ে ফিরেছি। এখন আবার কাশি শুরু হয়েছে। গরিব মানুষ আমরা, আমাগো এই সমস্যা কে দেখবে?’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মেসার্স জাজিরা (ঢাকা) ব্রিক ফিল্ড অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজার হাবিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ইটভাটায় প্রতিনিয়ত ইট তৈরি হচ্ছে। আমাদের ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট প্রত্যয়নপত্র, কৃষি অফিসের লাইসেন্স আপডেট থাকলেও পরিবেশ ও ফায়ার লাইসেন্স প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
তবে শৌলপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ভাষানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেসার্স জাজিরা (ঢাকা) ব্রিক ফিল্ড অ্যান্ড কোম্পানি এখন পর্যন্ত পরিষদে ট্রেড লাইসেন্সের জন্য আসেনি। নিয়ম হলো প্রতি বছর জুলাই মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। কিন্তু উনারা পরিষদেই আসেননি।
পরিবেশ অধিদপ্তর শরীয়তপুরের সহকারী পরিচালক রাসেল নোমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এর আগে ইটভাটাটির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল। একবার লাইসেন্স বাতিল হলে নতুন করে লাইসেন্স পাওয়ার সুযোগ নেই। ভাটার মালিকপক্ষ বাতিল আদেশের বিরুদ্ধে কোনো মামলাও করেননি। লাইসেন্সবিহীন কোনো ভাটা পরিচালনা করার সুযোগ নেই। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করবো।
শরীয়তপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাইনউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই। লাইসেন্সবিহীন ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এমজেইউ