‘ভাঙা পা নিয়ে এক্সরে করাতে এসে শুনি মেশিন নষ্ট’
ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে গত ৬ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে এক্সরে সেবা। প্রিন্টার মেশিন বিকল হয়ে পড়ে থাকায় এই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। তাই হাসপাতালে ২০০ টাকার এক্সরে করতে এসে বাইরে থেকে দিতে হয় ৬০০ টাকা। জ্বালানি সমস্যায় অ্যাম্বুল্যান্স সেবাও বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। গুরুত্বপূর্ণ এই সেবাগুলো বন্ধ থাকায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রোগীদের।
এছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্স সংকটে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। হাসপাতালটিতে রয়েছে ওষুধ সংকটও। এদিকে ২৫০ শয্যার নতুন হাসপাতালটি উদ্বোধন হলেও সেবা কার্যক্রম এখনো চালু হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১০০ শয্যার ঝালকাঠির সদর হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ থেকে এক হাজার মানুষ চিকিৎসা নিতে আসেন। এর মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ২৫ জন রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রয়োজনীয় মেডিকেল অফিসার ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় যথাযথ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হন সাধারণ মানুষ। এই হাসপাতালটিতে দীর্ঘদিন ধরে শিশু বিশেষজ্ঞ না থাকায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন রোগীরা। এছাড়া চক্ষু বিশেষজ্ঞের পদটিও দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকায় এখানে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ মানুষ হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ মোট চিকিৎসকের পদ রয়েছে ৩৬টি। বর্তমানে এর মধ্যে কর্মরত আছেন ১৭ জন। তাদের মধ্যে অন্য হাসপাতালের পাঁচজন চিকিৎসক এখানে সংযুক্ত হয়ে কাজ করছেন। সিনিয়র স্টাফ নার্সের মধ্যে প্রয়োজনীয় পুরুষ নার্স কম থাকায় জরুরি সেবায় বিঘ্ন ঘটে। রয়েছে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সংকট।
এই হাসপাতালের প্যাথলজিতে আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি নেই। বেশিরভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে করাতে হয়। এতে সরকারি ধার্যকৃত টাকার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা গুণতে হয় রোগীদের। ৬ মাস ধরে হাসপাতালটির এক্সরে মেশিন বিকল হয়ে পড়ে আছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও সেটি সচল করার কোনো পদক্ষেপ নেননি তারা। বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়কের চাপিয়ে দেওয়া নিয়মের কারণে অ্যাম্বুল্যান্সে জ্বালানি ক্রয় বন্ধ রয়েছে। এর ফলে ৬ মাস ধরে রোগীরা নিজ ব্যবস্থায় অ্যাম্বুল্যান্সের খরচ বহন করছে।
এদিকে ব্যানার, ফেস্টুন, বিশাল তোরণ আর আলোচনা সভাসহ জমকালো আয়োজনে ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল চত্বরে ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ২৫০ শয্যার নবম তলা বিশিষ্ট একটি ভবনের ২৩ সালের ১৭ অক্টোবর উদ্বোধন করা হলেও জনবল কাঠামো অনুমোদন না হওয়ায় চালু হচ্ছে না কার্যক্রম। দ্রুত সমস্যার সমাধান করে রোগীদের এক্সরেসহ সব সেবা প্রদানের দাবি জানিয়েছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।
ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা চাঁদকাঠি এলাকার শেফালি আক্তার বলেন, আমার ছেলের ঘাড়ে সমস্যা। হাসপাতালে আসছিলাম ডাক্তারের পরামর্শ নিতে। কিন্তু হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ কোনো ডাক্তার পেলাম না। এখানের যারা ডাক্তার আছেন তারা বলেন বরিশালে নিয়ে যেতে।
ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে রাজাপুর এলাকা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজন আলমগীর হোসেন বলেন, হাসপাতালের মেশিনটি অনেক ভালো। বাইরে এরকম মেশিন নেই। এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে মেশিন নষ্ট। আমাদের খুব সমস্যা হচ্ছে।
নবগ্রামের এলাকা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী রাবেয়া বেগম বলেন, আমার পা ভেঙে গেছে তাই চিকিৎসার জন্য কষ্ট করে এখানে এসেছি। এখন শুনি মেশিন নষ্ট। বাহিরে গিয়ে করাতে হলে যেমন কষ্ট তেমনি বাড়তি টাকা দিতে হবে। এই হাসপাতালে এক্সরে করার জন্য দিতে হতো ২০০ টাকা। কিন্তু এখন বাইর থেকে করার জন্য আমাকে দিতে হবে ৬০০ টাকা।
মগড় এলাকা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা আলতাফ হোসেন বলেন, আমার ছেলের হাঁটুতে ব্যথা। তাই চিকিৎসক এক্সরে করাতে বলেন। হাসপাতালের এক্সরে মেশিনটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এর জন্য বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে বেশি টাকা দিয়ে করাতে হয়েছে। এই হাসপাতালে সব ধরনের প্যাথলজিও টেস্টের সুবিধাও নেই।
ঝালকাঠির সামাজিক সংগঠন ইয়ুথ অ্যাকশন সোসাইটির (ইয়াস) সাংগঠনিক সম্পাদক সাব্বির হোসেন রানা বলেন, আমি আম্মুর পায়ের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যাই। ডাক্তার দেখানোর পরে কিছু টেস্ট দেওয়া হয়। ভেবেছিলাম আম্মুর ট্রিটমেন্টের জন্য সব টেস্ট এখানেই পাব। টেস্ট করাতে গিয়ে জানলাম ব্লাড বিষয়ক টেস্ট ছাড়া এক্সরে বন্ধ আছে। শেষে বাধ্য হয়ে বাইরের ক্লিনিক থেকে এক্সরে করতে হয়েছে। এই হাসপাতালে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ডাক্তারদের নিয়োগ ও উন্নত চিকিৎসার সব যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের দাবি জানাই। নতুন হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করা অতীব জরুরি। কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ আমাদের জেলার হাসপাতালটিতে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করে আমাদের জেলায় চিকিৎসা সেবার খাতটি উন্নত করুন।
সামাজিক সংগঠন ধ্রুবতারা ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের বরিশাল বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক শাকিল হাওলাদার রনি বলেন, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালে আমার বাবাকে হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে ভালোই ভোগান্তির মধ্যে পড়েছিলাম। হাসপাতালের ডাক্তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট ও এক্সরে করতে দেয়। কিন্তু এক্সরের ওখানে গিয়ে দেখি তা নাকি অনেকদিন ধরে বন্ধ পড়ে আছে। পরে বাইর থেকে সব কিছু করাতে হয়েছে। হাসপাতালে বড় কোনো ডাক্তার নেই। মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলে সব বরিশালে রেফার করে। এই ভোগান্তি থেকে আমরা সাধারণ মানুষ রক্ষা পেতে চাই।
এ বিষয়ে রেডিও প্রোগ্রামের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দিলীপ সাহা বলেন, গত বছর থেকে আমাদের এক্সরে মেশিন বন্ধ রয়েছে প্রিন্টার সমস্যার জন্য। এখানে এক্সরে করাতে পারছি না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একাধিকবার চিঠি দিয়েছি। এখন পর্যন্ত সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। আশা করছি দ্রুত সমাধান হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন রোগীরা এসে আমাদের সঙ্গে তর্ক করছেন, কেন মেশিন বন্ধ। আমরা সেবা পাচ্ছি না কেন এমন নানা রকম প্রশ্নের উত্তরে আমার খুব খারাপ লাগে। তখন রোগীদের সঙ্গে মিথ্যা কথা বলতে হয় যে আগামীকাল ঠিক হয়ে যাবে। মানুষকে সেবা দিতে না পেরে আমারও খুব খারাপ লাগছে। প্রায় তিন হাজার এক্সরে ফ্রিম নষ্ট হওয়ার পথে। এক্সরে সেবা বন্ধ থাকলেও আমাকে প্রতিদিন এসে মেশিনটি চালু করতে হয় প্রতিদিন চালু না করলে যেকোনো সময় এক্স-রে মেশিনটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এ বিষয়ে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শামীম আহমেদ বলেন, চিকিৎসক ও নার্স সংকট অনেক আগে থেকেই। ২৫০ শয্যার নতুন ভবনটি উদ্বোধন হওয়াতে রোগীর চাপ বেড়েছে। কিন্তু নতুন হাসপাতালের কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। এক্স-রে মেশিনের প্রিন্টার সারানোর জন্য ইঞ্জিনিয়ার ইমাম হাসানের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছি তাকে চিঠি দিয়েছি। এটার টেন্ডারও হয়েছে তারপরও তিনি কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না কাজ আটকে রাখছে। এটা তো আমার ব্যক্তিগত টাকা দিয়ে সারানো সম্ভব না। তারপরও আশা রাখি খুব দ্রুত এসব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ার ইমাম হাসান বলেন, কাজটি করার জন্য কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে তার নাম্বার দিয়ে দিয়েছি। এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যত দ্রুত সম্ভব কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে কথা বলে কাজ করে নিতে পারেন। কাজ হয়ে গেলে আমরা বিল করে দিয়ে দেব।
উল্লেখ্য, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের অবহেলার কারণে ভারত থেকে প্রাপ্ত ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা মূল্যের বিলাসবহুল অ্যাম্বুলেন্সটি সংস্কার না করায় সেটিও অচল হয়ে পড়ে আছে। ঢাকাসহ দূরের স্থানে উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীরা যেতে পারছে না। রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অথচ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এ বিষয়ে উদাসীন।
আরকে