নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণ : ২৯ জনের বিরুদ্ধে সিআইডির চার্জশিট

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানাধীন পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণের মামলায় মসজিদ কমিটির সভাপতিসহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ঘটনার প্রায় তিন মাস পর বৃহস্পতিবার (৩১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামানের কাছে এ অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক বাবুল হোসেন। তবে আরও আটজনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করার প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে। তারা সবাই তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারী।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন জানান, ওই আটজন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হওয়ায় সরকারের প্রয়োজনীয় অনুমতি সাপেক্ষে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে। তারা হলেন- মো. সিরাজুল ইসলাম, মাহমুদুর রহমান রাব্বি, মানিক মিয়া, এসএম হাসান শাহরিয়ার, মো. মনিবুর রহমান চৌধুরী, মো. আইয়ুব আলী, মো. ইসমাইল প্রধান এবং মো. হানিফ মিয়া।
এদিকে যাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে তারা হলেন- মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুর মিয়া (৬০), সামসুদ্দিন সরদার (৬০), শামসু সরদার (৫৭), শওকত আলী (৫০), অসিম উদ্দিন (৫০), জাহাঙ্গীর আলম (৪০), শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল (৪৫), নাঈম সরদার (২৭), তানভীর আহমেদ (৪৫), আল আমিন (৩৫), আলমগীর সিকদার (৩৫), আলহাজ মাওলানা আল আমিন (৪৫), সিরাজ হাওলাদার (৫৫), নেওয়াজ মিয়া (৫৫), নাজির হোসেন (৫৬), আবুল কাশেম (৪৫), আব্দুল মালেক (৫৫), মনিরুল (৫৫), স্বপন মিয়া (৩৮), আসলাম আলী (৪২), আলী তাজম (মিল্কী) (৫৫), কাইয়ুম (৩৮), মামুন মিয়া (৩৮), দেলোয়ার হোসেন, বশির আহমেদ (হৃদয়) (২৮), রিমেল (৩২), আরিফুর রহমান (৩০), মোবারক হোসেন (৪০) ও রায়হানুল ইসলাম (৩৬)। তবে তাদের বিস্তারিত পরিচয় এখন পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি।
চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, গত ৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টায় বায়তুস সালাত জামে মসজিদে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ইবাদতরত ৩৭ জন মুসল্লিসহ একজন পথচারী অগ্নিদগ্ধ হয়। তার মধ্যে ৩৪ জন মুসল্লি শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। চারজন এখনও নিজ নিজ বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অগ্নিকান্ডে মসজিদের এসি, থাইগ্লাস ও বিভিন্ন জিনিসপত্র পুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মামলাটি জনগুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ঘটনার ৫ দিন পর ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব নেয় সিআইডি।
তদন্তকালে সিআইডি ক্রাইমসিনসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বস্তুগত আলামত সংগ্রহ ও অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ উদঘাটন করে। সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দায়িত্বে অবহেলার জন্য তিতাস গ্যাস অ্যান্ড ট্রান্সমিশনের ফতুল্লা জোনের দায়িত্বরত আটজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তাদেরকে দুইদিন রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ডিপিডিসির একজন মিটার রিডার, দুইজন ইলেকট্রিশিয়ানসহ মোট তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার ইলেকট্রিশিয়ান মোবারক ও রায়হান অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়ে ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। তদন্তে মসজিদ কমিটির বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার প্রমাণ পাওয়ায় মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুরকে গ্রেফতার করা হয়।
সিআইডির তদন্তে অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ উদ্ঘাটন হয়। ঘটনার আগে প্রায় তিন মাস ধরে মসজিদের পাশে তিতাস গ্যাসের পাইপের লিকেজ থেকে গ্যাস বের হয়ে মসজিদের ভেতরে জমা হতে থাকে। বাধাহীনভাবে গ্যাস উদগিরণ হয়ে মসজিদ গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়। ঘটনার ৭-৮দিন আগে গ্যাসের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে মুসল্লিরা বিষয়টি মসজিদ কমিটিকে জানান। কিন্তু মসজিদ কমিটি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ঘটনার দিন এশার নামাজের সময় বৈধ বিদ্যুৎ লাইন চলে গেলে ম্যানুয়াল চেঞ্জওভারের মাধ্যমে অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন চালু করা হলে বিদ্যুতের স্পার্ক হয়। তখন বিদ্যুতের স্পার্ক ও মসজিদে জমে থাকা গ্যাসের সমন্বয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়।
তাৎক্ষণিক স্থানীয় লোকজন অগ্নিদগ্ধ মুসল্লিদের অটোরিকশা/রিকশাযোগে নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিলে সেখানে বার্ন ইউনিট না থাকায় ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অগ্নিদ্বগ্ধ ৩৪ জন মুসল্লি মৃত্যুবরণ করেন এবং চারজন মুসল্লি চিকিৎসা শেষে বর্তমানে বাড়িতে আছেন। মসজিদ কমিটির সঠিকভাবে মসজিদ পরিচালনায় অবহেলা, অব্যবস্থাপনা, উদাসীনতা, সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করা, কারিগরি দিক বিবেচনা না করে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ ঝুঁকিপূর্ণভাবে লাগানো, গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জীবনের নিরাপত্তার কথা না ভেবে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা না নেয়া ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) মিটার রিডিং কালেক্টর ও ইলেক্ট্রিশিয়ানদের মসজিদে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া এবং ঝুঁকিপূর্ণভাবে মসজিদের অভ্যন্তরে বিদ্যুতের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘটনাস্থল এলাকার তিতাস গ্যাসের দায়িত্বে থেকে দায়িত্বে অবহেলা, গ্যাস লাইনের সঠিকভাবে তদারকি না করা, পাইপের লিকেজ মেরামত না করা, গ্যাস লাইন ঝুঁকিপূর্ণভাবে পিন/স্থানান্তর করার কারণে ভয়াবহ এ অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়ে ৩৪ জন মুসলি অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত ও চারজন অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন বলে সিআইডির তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মো. নাসিরউদ্দিন জানান, তদন্ত গ্রহণের পর থেকে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব ও নিরলসভাবে তদন্তকার্য পরিচালনা করে সিআইডি। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত শেষে ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুর মিয়াসহ মোট ২৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে সিআইডি। অভিযুক্ত আরও আটজন সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী হওয়ায় উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।
এর আগে বিস্ফোরণের কারণ খতিয়ে দেখতে পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসন, তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, সিটি কর্পোরেশন। সেই তদন্তে অনিয়ম ও গাফিলতির নানা তথ্য বেরিয়ে আসে।
আরএআর