লোকচক্ষুর সামনেই বসতবাড়িতে তৈরি হতো পটকা, দেখার নেই কেউ
বগুড়া শহরের মালতিনগরের পটকা তৈরির ইতিহাস প্রায় ৫০ বছরের বেশি। এই পটকা তৈরি করতে গিয়ে বিগত সময়ে একাধিক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তবু বন্ধ হয়নি এই পেশা। আগে সীমিত পরিসরে থাকলেও দুই দশক ধরে এটি ব্যাপকহারে বিস্তৃত লাভ করেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। তাদের অভিযোগ, বেআইনি হলেও প্রশাসনের নাকের ডগায় এত বছর ধরে পটকা তৈরি হলেও কারও নজরদারি নেই।
গত রোববার (২৮ এপ্রিল) রাতে মালতিনগর দক্ষিণ পাড়া এলাকায় রেজাউল করিমের বাড়িতে হঠাৎ বিস্ফোরণের পর পটকা ব্যবসার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। ওই বিস্ফোরণে রেজাউল করিমের মেয়ে, ভাতিজি ও তার প্রতিবেশী এক মেয়ে আহত হয়।
রেজাউল ইসলাম মালতিনগর এলাকায় খড়ির ব্যবসা করেন। তার মা রেজিয়া ও ছোট ভাই রাশেদুল ইসলাম বসতবাড়িতে পটকা তৈরি করেন।
সেই বিস্ফোরণে আহত হন রেজাউলের মেয়ে সুমাইয়া আক্তার (১৫), ছোট ভাই রাশেদুলের মেয়ে জিম (১৬) ও প্রতিবেশী আলী হোসেন বাবুর মেয়ে তাসনিম বুশরা (১৪)। তাদের বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে তাসনিম বুশরার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় রাতেই তাকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়। বুশরা বর্তমানে ঢাকাস্থ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছে। সেদিন রাতে রেজাউল করিমের স্ত্রী রেবেকার আহত হওয়ার খবর জানা গেলেও তিনি এখন সুস্থ আছেন।
মালতিনগরের ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় সদর থানাধীন বনানী ফাঁড়ির এসআই আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে গতকাল সোমবার একটি মামলা করেছেন। মামলায় রেজাউল করিমকে আসামি করে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
স্থানীয়রা জানান, শহরের মালতিনগরের এমএস ক্লাব মাঠ এলাকার ওয়াজেদ আলীর ছেলে রফিকুল, তার ভাই নবির ও বসির পটকার ব্যবসা করেন। তাদের বাবার বিস্ফোরক আমদানির লাইসেন্স ছিল। এ ছাড়া একই এলাকার খোকন নামে আরেক ব্যক্তির বিস্ফোরক আমদানির লাইসেন্স রয়েছে।
আগে রফিকুলরা তিন ভাই মিলে বাড়িতে পটকা তৈরি করতেন। এলাকাবাসীদের কাছে জানা যায়, পটকা তৈরি করতে গিয়ে ১৯৮৯ সালে রফিকুলের বাবা ওয়াজেদ আলী, মা নেবুর জান ও ৩ বছর বয়সী এক বোন নিহত হন।
পরবর্তীতে তারা অল্প কিছু পরিবারদের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক পটকা তৈরি করে নিতেন। কালে কালে এটি বিস্তৃত লাভ করতে থাকে। এর মধ্যে ২০২০ সালে মালতিনগরের এমএস ক্লাব মাঠ এলাকায় রফিকুলদের চুক্তির পটকা তৈরি করতে গিয়ে বিস্ফোরণে শচীন নামের এক যুবক নিহত হন। শচীন মালতিনগরে ভাড়া থাকতেন। তার আসল বাড়ি সোনাতলা উপজেলায়। তবে ওই সময় বিষয়টি বিভিন্নভাবে ধামাচাপা দেন রফিকুল ও তার ভাইয়েরা।
মালতিনগরের বাসিন্দা ও বগুড়া পৌরসভার কর্মচারী আমির হোসেন বলেন, আমরা ছোট থেকেই এমএস ক্লাব মাঠ এলাকায় পটকা তৈরি দেখে আসছি। মুরুব্বীদের কাছে শুনেছি স্বাধীনতার আগে থেকেই রফিকুলদের পরিবার এখানে পটকা তৈরির কাজ করত। কিন্তু এখন এই কাজ মালতিনগর মোল্লাপাড়া, ভাটকান্দির অনেকে পরিবারের নারীরা করে থাকেন। তারা সামান্য কিছু টাকার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই কাজ করেন।
একই এলাকার বাসিন্দা স্বপন সরকার বলেন, আগে স্বল্প পরিসরে তৈরি হয়েছে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এখন ঘরের ভেতরে যেভাবে নারীরা করছে তার ভয়াবহতা তো আমরা দেখলাম। এখন এ বিষয়ে প্রশাসনের নতুন করে ভাবার দরকার আছে।
এলাকাবাসীদের কাছে জানা গেছে, মূলত ঈদ ও পূজাকে কেন্দ্র করে মালতিনগর এলাকায় পটকা তৈরি করা হয়। এখন রফিকুল বা তার ভাই কেউ নিজে পটকা তৈরি করেন না। সবই চুক্তি দিয়ে বানিয়ে নেন। মালতিনগর এলাকার নিম্নবিত্ত বা খেটে খাওয়া পরিবারের সদস্যরা এই পটকা তৈরির কাজ করেন। বিশেষ করে নারীরা ঘরে বসে এই কাজ করে থাকেন। এক হাজার পিস পটকা তৈরি করে কাজের ধরণ অনুযায়ী ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন কারিগররা।
রেজাউলের বাড়িতে বিস্ফোরণের পর থেকে এলাকার সব কারিগররা গা ঢাকা দিয়েছেন। যারা আছেন, তারা কেউ কাজের বিষয়টি স্বীকার করছেন না। ফলে এই এলাকায় মোট কত পরিবার পটকা তৈরির কাজে জড়িত সেই সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয়দের দাবি, অন্তত ৪০ পরিবারের নারী পটকা তৈরির কাজ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেজাউল করিমের মা রেজিয়া, তার ভাই রাশেদুল ইসলাম, প্রতিবেশী আলী হোসেনের স্ত্রী পটকা তৈরি করেন। এ ছাড়া তাদের বাড়ির পেছনের আরও অন্তত ১০ বাড়িতে পটকা তৈরি হয়। তারা অর্ডার নিয়ে কাজ শেষে বস্তায় ভরে মূল মালিকদের কাছে পৌঁছে দেয়। রেজাউলের মা রেজিয়ার তৈরি পটকাগুলোর মালিকও রফিকুল ইসলাম।
এ ছাড়া এই বিস্ফোরক কাঁচামাল আমদানির কথা বললেও এগুলোর বেশিরভাগ চোরাচালান হয়ে আসে বলে আইনপ্রয়োগকারী এক গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানিয়েছে। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে এসব বিস্ফোরক দ্রব্য চোরাকারবারিরা নিয়ে আসেন।
গ্রেপ্তার হওয়ার আগে রেজাউল করিম নিজেও তার বাড়িতে পটকা তৈরির কথা স্বীকার করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তারা তিন ভাই বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন। রফিকুলের বড় ভাইয়ের স্ত্রী আয়েশা বেওয়া বলেন, লাইসেন্স থাকায় ঈদে ও পূজায় পটকা তৈরি করা হয়। বিস্ফোরণের পর থেকে রফিকুলেরা বাড়িতে নেই।
আইন বলছে, বসতবাড়ি বা আবাসিক এলাকায় পটকা তৈরি, বিক্রির কোনো বৈধতা নেই। কিন্তু পটকার উৎপাদকরা বিস্ফোরক দ্রব্য আমদানির লাইসেন্স থাকার দোহাই দিয়ে এসব বানিয়ে বিক্রি করে। বগুড়া জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, কোনো প্রকার বিস্ফোরক দ্রব্য আমদানির লাইসেন্স জেলা প্রশাসন দেয় না। আমদানি লাইসেন্সের আবেদনের ক্ষেত্রে অনাপত্তি পত্র দেওয়া হয়। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে এমন কোনো আবেদন আসেনি।
জানতে চাইলে রাজশাহী বিস্ফোরক পরিদপ্তরের পরিদর্শক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, পটকা বানানো আমাদের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। তবে বগুড়ায় এরকম কাউকে লাইসেন্স দেওয়া আছে বলে আমার জানা নেই। তারপরও ওই ঘটনায় আমাদের অফিস থেকে এক কর্মকর্তা পরিদর্শনে গিয়েছেন। তিনি ফিরে আসার পর ওখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।
শুধু তাই নয় শহরের কেন্দ্রবিন্দু এলাকায় অবস্থিত চুড়িপট্টি মার্কেটেও ঈদ, পূজা ছাড়াও সারাবছর দেদারসে পটকা ও আতশবাজি বিক্রি করা হয়। অথচ এই মার্কেটের একশ মিটারের মধ্যে রয়েছে বগুড়া সদর থানা। আবার মালতিনগর পটকা তৈরির এলাকাটির ১০০ মিটারের মধ্যে বনানী পুলিশ ফাঁড়ি অবস্থিত।
এর আগে বিস্ফোরণের রাতে ঘটনাস্থলে পরিদর্শনে এসে বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার (পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত ডিআইজি) সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেন, এই বাড়িতে পটকা তৈরি করা হতো বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। পটকার আলামতও পেয়েছি। বসতবাড়িতে পটকা তৈরির অনুমোদন থাকতে পারে না। এই পটকা তৈরির সঙ্গে আর কারা কারা জড়িত সেই বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে। এ জন্য পুলিশের একাধিক টিম মাঠে নেমেছে।
আসাফ-উদ-দৌলা নিওন/এএএ