রংপুরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে শিক্ষক-আইনজীবী-অভিভাবকরাও

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ জনগণের ওপর হামলা, গুলিবর্ষণ, মামলা, নির্যাতন ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফা দাবি আদায়ে রংপুরে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়েছে। এতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন শিক্ষক, আইনজীবী অভিভাবকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
শনিবার (৩ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে থেকে বৃষ্টির মধ্যে বিক্ষোভ মিছিলটি বের হয়।
এর আগে সকাল ১০টার আগে থেকেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে নগরীর বিভিন্ন নিরাপত্তা চৌকিতে তল্লাশির মুখোমুখি হয়ে রংপুর জিলা স্কুল, রংপুর সরকারি কলেজ, কারমাইকেল কলেজ, সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ, সরকারি সিটি কলেজ, পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ, লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রংপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, রংপুর মেডিকেল কলেজ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ নগরীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা জড়ো হন প্রেসক্লাবের সামনে। বিক্ষোভে অংশ নিতে দেখা যায় অনিদির্ষ্টকালের জন্য বন্ধ হওয়া দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদেরও। সেখানে রাস্তার একপাশ বন্ধ করে দিয়ে বিক্ষোভ করছেন তারা।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে এই কর্মসূচিতে যোগ দেন অভিভাবকরাও। স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা। এ সময় ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, আমার ভাই মরলো কেন, প্রশাসন জবাব চাই, লেগেছে রে লেগেছে রক্তে আগুন লেগেছে, ভুয়া ভুয়া পুলিশ ভুয়া, খুনি খুনি পুলিশ খুনি’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন তারা। এ সময় সাদা কাগজে লাল কালিতে বিভিন্ন স্লোগান বাংলা ও ইংরেজিতে লিখে প্রদর্শন করছে তারা।
সেখান থেকে তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বেলা ১২টার দিকে রওয়ানা দেয় শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি নগরীর জাহাজ কোম্পানি মোড়, পায়রা চত্বর, নগর ভবন, টাউন হলের সামন, কাচারী বাজার, ডিসির মোড় বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল চত্বর, লালকুঠি, চেক পোস্ট, মেডিকেল মোড়, ধাপ আটতল মসজিদ মোড় হয়ে প্রায় ৫ কিলোমিটার হেটে রংপুর টাউন হলের সম্মুখে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে শপথগ্রহণ শেষে বিক্ষোভ কর্মসূচি শেষ করেন শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে রোববার থেকে পূর্বঘোষিত ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ কর্মসূচিতে সর্বস্তরের মানুষকে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রাচুর্য্য জানালেন, যতদিন আমাদের দাবি সরকার মেনে নেবে না, যতদিন আমাদের যে ভাইয়েরা শহীদ হয়েছেন তাদের পক্ষে সুষ্ঠু মামলা হবে না, ততদিন আমাদের এই আন্দোলন চলছে, চলবে।
ক্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহরিয়ার জানালেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতদিন আমাদের শহীদ ভাইদের হত্যাকারীদের বিচার না করবেন, ততদিন আমরা মাঠে থাকবো। আমরা সুষ্ঠু বিচার চাই। আর সরকার যেন শিক্ষার্থীদের আর হয়রানি না করে। আমরা রাতে ঘুমাইতে পারি না। আমাদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করে। কখন আমাদের গ্রেপ্তার করা হয়। আমরা কী সহিংসতা করেছি? আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনে নেমেছিলাম। আমাদের মারা হলো কেন? আমাদের ভাইয়ের রক্তের হিসাব আমরা চাই।
মাথায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বেঁধে আন্দোলনে অংশ নেওয়া রংপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সুমাইয়া তাবাসসুম বলেন, আমরা অনেক সময় দিয়েছি। কিন্তু আর না। এখন আমাদের দাবি একটাই, আমাদের যে ভাই-বোনদের হত্যা করা হয়েছে, সেটার বিচার চাই। আমি একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী, আমার ভাইয়েরা জেলখানায় পরীক্ষা দিবে সেটা আমরা মানি না। সবাইকে ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমরা পরীক্ষায় বসবো না।
মিছিলে অংশ নিয়ে বেগম রোকেয়া কলেজের শিক্ষার্থী মনিরা মাহিয়া বলেন, ‘যে দেশের শাসকরা নির্বিচারে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালোনোর নির্দেশ দেয়। সেই শাসকদের ক্ষমতায় থাকার আর কোনো অধিকার নেই। আমাদের ওপর গুলি করা হলো কেন। এর জবাব চাই। কেন শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিশু ও সাধারণ মানুষের প্রাণ গেল, এর জবাব কি সরকার প্রধানের কাছে আছে?’

সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের শিক্ষার্থী জান্নাতি ইতি বলেন, আমরা ৫২ এর ভাষা আন্দোলন করেছি, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান করেছি। কিন্তু এতো শহীদ হয়নি। কোটা আন্দোলনে যত শহীদ হয়েছে পৃথিবীর সকল বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। আমরা এর বিচার চাই। যারা এর সাথে যুক্ত তারা দ্রুত পদত্যাগ করুন। আমাদের পড়ার টেবিলে ফেরার ব্যবস্থা করুন।
আন্দোলনে অংশ নিয়ে বিজিএমই ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড ফ্যাশন টেকনোলোজির শিক্ষার্থী নাহিন জুহি বলেন, আমরা কি কেউই নিরাপদ আছি? না আমরা কেউ নিরাপদ নাই, না বাসায় না স্কুলে না কলেজে না বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি একজন ফ্যাশন ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট তারপরও আমি কেন আন্দোলন করছি। আমার ভাইয়ের রক্ত যাচ্ছে। বুলেট চালানো হচ্ছে। যারা নিরস্ত্র, তাদের ওপর গুলি চালানো কেন হবে? যতক্ষণ না শান্তি আসবে দেশে আমরা আন্দোলন করেই যাব। এটাই আমাদের স্লোগান। এখন ৯ দফা নেই, একদফা। আমরা এই সরকারের পতন চাই, স্বৈরাচারের নিপাত চাই।’
আন্দোলনে অংশ নেওয়া হোম ইকোনোমিকস এবং রংপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী দুই বোনের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন তাদের মা-বাবাও। মা আফরিনা বলেন, মেয়েরা আন্দোলনে এসেছে। ওদের দাবি যৌক্তিক। সে কারণে আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে ওদের সাথে এসেছি। আমি মনে করি পুলিশ যেভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করছে। এটা ঠিক না। পরিস্থিতি খুবই খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছে। এখান সরকার সহনশীল হচ্ছে, আগে হলে তো এমনটা হতো না।
বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন একাধিক আইনজীবীও। তাদের একজন জোবায়দুল ইসলাম মিছিলের সম্মুখে ছিলেন। এই আইনজীবী বলেন, এটা পৃথিবীর ইতিহাসে নারকীয় হত্যাকাণ্ড। গণহত্যা। যেভাবে শিশুসহ শিক্ষার্থী জনতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ। যেভাবে শিশুদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এটা দেশের সামান্য বিবেকমানও মেনে নেবে না। আমি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আছি। তাদের জন্য আইনি লড়াই ছাড়াও মাঠে থাকব। আমি মনে করে আর সময় নেই, শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে এই সরকারের পদত্যাগ করা উচিত।
অভিভাবকরা বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে। অনেকে হত্যার শিকার হয়েছে। অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে-বাড়িতে কাতরাচ্ছে। অনেকে আবার আতঙ্কে দিনানিপাত করছে। আমরা অভিভাবক হয়ে বাড়িতে বসে থাকতে পারি না। তাই শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে আমরাও তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি।
এদিকে বিক্ষোভ থেকে যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে নগরজুড়ে বিপুল সংখ্যাক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (বিকেল ৩টা) শিক্ষার্থীদের এই কর্মসূচি ঘিরে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি বলে মেট্রোপলিটন পুলিশের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর