ভয়াবহ বন্যার ২ মাস : ফেনীতে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় খাদ্য উৎপাদনে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ফেনীর জনপদ। গত জুলাই-আগস্টে মাসের ব্যবধানে তিন দফার বন্যায় পানির তীব্র স্রোতের সঙ্গে ভেসে গেছে হাজারো হেক্টর ফসলি জমি, মাছের ঘের ও খামার। এতে ছয় উপজেলা নিয়ে নানাখাতে সমৃদ্ধ ৯২৮ দশমিক ৩৪ বর্গ কিলোমিটারের এ জেলায় আগামীর খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, এবারের বন্যায় জেলায় সর্বোচ্চ ক্ষতি নিরূপিত হয়েছে শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে। এ খাতগুলোতে মোট ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে ১ হাজার ২০ কোটি ৭২ লাখ ১৪ হাজার ৩৯ টাকা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৭৯০ কৃষক পরিবারের ক্ষতি হয়েছে ৫২৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। চলতি মৌসুমে ফেনীতে ৩৮ হাজার ৮৭ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছিল। তারমধ্যে বন্যায় ৩৪ হাজার ৭৭ হেক্টর জমির আবাদ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাকি আবাদি জমিও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন
সূত্র জানায়, গত জুলাই মাসেও বন্যায় ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ায় আউশ, গ্রীষ্মকালীন সবজি, আমন বীজতলা ও গ্রীষ্মকালীন মরিচের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তখন কৃষিতে সবমিলিয়ে ১ কোটি ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ৬০০ টাকার ক্ষতি হয়েছিল। এতে ১ হাজার ৭১৯ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন।
শঙ্কার কথা তুলে ধরে পরশুরামের বীরচন্দ্র নগর এলাকার কৃষক আবুল কালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন্যার পানিতে মৌসুমি সবজি, ধানের জমি ভেসে গেছে। জমিতে যে পলি জমেছে তা সরিয়ে আবার আবাদ করারও সময় নেই। বন্যার পর কয়েকদিন মানুষজন শুকনো খাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়েছে। কিন্তু এভাবে তো আর সবসময় সহায়তা পাবো না। আগামী ৫-৬ মাস পরেই মূলত আমাদের এ সংকট দৃশ্যমান হবে।
আলমগীর হোসেন নামে টেটেশ্বর এলাকার এক খামারি বলেন, প্রবাস থেকে ফিরে ঋণের টাকায় খামার পরিচালনা করে কোনোমতে সংসার সামলে নিচ্ছিলাম। এতোদিন পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাইরে বিক্রি করতে পেরেছি। কিন্তু মাসের ব্যবধানে তিন দফার বন্যায় সব শেষ হয়ে গেছে। এখন চড়ামূল্যে বাজার থেকে কিনতেও পারছি না। এ অবস্থায় খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে দিনযাপন করছি।
বন্যার প্রভাবে খাদ্য ঘাটতির শঙ্কা রয়েছে কি না- জানতে চাইলে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. একরাম উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফেলতির কারণেই কৃষকরা বারবার ক্ষতির মুখে পড়ছেন। ভাঙা বাঁধগুলো সঠিকভাবে সংস্কার করলে বারবার এভাবে প্লাবিত হতো না। এখন তারা যদি মাঠে থাকা স্কিমগুলো চালু করে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে তাহলে আগামী মৌসুমে বোরো উৎপাদনে কোনো সমস্যা হবে না। তখন খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে না।
তিনি বলেন, এখন আমাদের লক্ষ্য, আগামী বোরো মৌসুমে ভালো উৎপাদন করা। এ জন্য আসন্ন রবি ফসলের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। কৃষকদের ঘুরে দাঁড়াতে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিনামূল্যে সার, ১২টি ফসলের বীজ ও অন্যান্য ব্যয়ের জন্য ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৪০০ টাকা মন্ত্রণালয় হতে মঞ্জুরির আদেশ পাওয়া গেছে। ধাপে ধাপে কৃষকদের সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া খরিপ-২ মৌসুমে পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় ২৩ হাজার কৃষক পরিবারের জন্য শীতকালীন সবজি বীজ ও নগদ টাকা বাবদ ৩ কোটি ৫০ লাখ ২৯ হাজার টাকা মঞ্জুরি আদেশ পাওয়া গেছে।
এদিকে বন্যায় একইভাবে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে খাদ্যের আরও দুই অন্যতম প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতেও। জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের বরাত দিয়ে জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এবারের বন্যায় ২ হাজার ১৬৪ ভেড়া, ১১ হাজার ৪৮৭ ছাগল, ৩০ হাজার ৬৫০টি গরু, ১৯৪টি মহিষ, ৫৭ লাখ ২১ হাজার ৩০১টি মুরগি ও ১ লাখ ৬৭ হাজার ২৭৭টি হাঁস বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। পানিতে তলিয়ে গেছে জেলার ৪ হাজার ৬৬৫ হেক্টর মাছের ঘের। সবমিলিয়ে বন্যায় প্রাণি ও মৎসে আনুমানিক ক্ষতি হয়েছে ৫৭৫ কোটি টাকা।
ফেনী পৌর মৎস্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন্যার আগে ফেনীর উত্তরাঞ্চলের উপজেলাগুলো থেকে দৈনিক প্রায় ১০ টন পর্যন্ত মাছ আসতো। কিন্তু বন্যায় এখন তা শূন্যের কোঠায়। স্থানীয় মাছের বাজারে বন্যার বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। যোগান কম থাকায় দামও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোজাম্মেল হকের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ভয়াবহ বন্যায় প্রাণিসম্পদে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। অনেক খামারি নতুনভাবে আর কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। এতে খাদ্য উৎপাদনে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। কোনো ধরনের সহায়তা পেলে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হবে। এছাড়া ইতোমধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে যে-সব সহায়তা এসেছে তা সমন্বয় করে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।
তারেক চৌধুরী/এমএসএ