গ্রামে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার-হিজড়া প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, যা জানা গেল

একশ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ফটোকপি করে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো। তাতে বড় করে লেখা, ‘সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র ও হকার নিষিদ্ধকরণের নোটিশ। গ্রামে সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করা হলো। যারা এই নিয়ম ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে ৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। আইন ভঙ্গকারীর বাবা-মায়ের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সেই সঙ্গে আরো জানানো হচ্ছে যে, সকল প্রকার হকার ও হিজড়াদের প্রবেশ এখানে নিষিদ্ধ করা হলো। যেহেতু আমাদের গ্রামে ৯৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত ও ২০ জন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী আছে। নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যত বিবেচনা করে গ্রামবাসী এই সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছে।’
ঘটনাটি ঘটেছে ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার ফলসী ইউনিয়নের সড়াতলা গ্রামে। ওই নোটিশে জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদ মাদরাসার সভাপতি, শিক্ষক, ঈমাম ও সমাজসেবকসহ ১৯ জনের স্বাক্ষর রয়েছে। ওই গ্রামে সমাজপতিদের এমন সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ জানিয়েছে সংস্কৃতিকর্মী ও সচেতন মহল। ঘটনাটি সম্পূর্ণভাবে আইনের পরিপন্থি বলে জানিয়েছেন হরিণাকুণ্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বি.এম. তারিক-উজ-জামান।
জানা যায়, ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার শড়াতলা গ্রাম। এক সময় ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হরিণাকুন্ডু ইউনিয়নের অন্তর্গত ছিল। ২০০২ সালে হরিণাকুণ্ডু পৌরসভা গঠিত হলে এটি ৬নং ফলসী ইউনিয়নে একীভূত হয়। এখনও এ গ্রামের মানুষের দিনের অধিকাংশ সময় কাটে শহরে। যার ফলে শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি এবং ইতিহাস- ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে গ্রামটিতে। তবে সেখানকার সমাজপতিদের বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধের এমন সিদ্ধান্তে হতবাক হয়েছেন জেলা-উপজেলার সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষেরা। আবার এটিকে সামাজিক অবক্ষয়রোধে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ।
ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নানা রকমের আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। সমাজপতিদের এমন সিদ্ধান্তে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পাশাপাশি এ নিয়ম জারি করা ব্যক্তিদের সামাজিক রীতিবিরোধী আখ্যা দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
গ্রামের যুবক মেহেদী পারশি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রামের মানুষ আমাদের যুবসমাজের ভালোর জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এটাকে অনেক বেশি রঞ্জিত করে প্রকাশ করেছে। যার কারণে বিষয়টি এখন বিতর্কিত হচ্ছে।
গ্রামের বাসিন্দা মশিয়ার হোসেন বলেন, গ্রামের যুবকেরা প্রতিদিন পিকনিক করতো এবং সেখানে উচ্চস্বরে গান বাজাতো। এতে করে প্রতিবেশীসহ বয়স্ক ও অসুস্থ রোগীরা আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। এছাড়া হিজড়ারা গ্রামে এসে জোরপূর্বক টাকা নিতো। এসব কারণে সমাজের লোকজন মিলে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যত বিবেচনা করেই এমন সিদ্ধান্ত। তবে এই বিষয় এখন বিতর্কিত।
সড়াতলা গ্রামের পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি মো. এনামুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রামে উচ্চস্বরে বাদ্যযন্ত্র বাজানো হতো। এতে অসুস্থ মানুষ, শিক্ষার্থী, নারী ও শিশুসহ অনেকের সমস্যা হতো। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বিভিন্ন সময়ে উচ্চস্বরে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নাচগান করে। এতে মানুষের সমস্যা হয়। তারা এবং হকাররা নানান সময়ে মানুষের কাছ থেকে অধিক টাকাপয়সা হাতিয়ে নেয়। তাই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ফলসী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য তৌহিদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রামে প্রতিনিয়ত বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে পিকনিক করতো। যার কারণে গ্রামে অসুস্থ রোগী, বয়স্কদের সমস্যা হতো। এছাড়া বাদ্যযন্ত্রের কারণে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষতি হয়। এজন্য গ্রামের ছেলেমেয়েদের সুবিধার জন্য গ্রামের দুটি মসজিদে মিটিং করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গ্রামের ভালোর জন্য করলেও বিষয়টি বিতর্কিত হয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে ফলসী ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি বিশেষ কাজে ঢাকায় আছি। এ সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই।
সাংস্কৃতিক কর্মী শামীম আহমেদ টফি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সমাজপতিদের এমন সিদ্ধান্তে আমরা হতবাক। বর্তমান সময়ে এমন সিদ্ধান্ত দুঃখজনক। এই কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানাই।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বি.এম. তারিক-উজ-জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সড়াতলা গ্রামে যেটি ঘটেছে সম্পূর্ণভাবে আইনের পরিপন্থি। আমার ইতিমধ্যে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছি জড়িতদের চিহ্নিত করতে এবং গ্রামে বাড়ির দেয়াল থেকে পোস্টারগুলো সরিয়ে ফেলতে। তারা সেগুলো সরিয়ে ফেলেছে। তবে যে স্ট্যাম্পটি ফটোকপি করে দেয়ালে মারা হয়েছে সেখানে ইউএনওর নাম্বার থাকলেও, মূল স্ট্যাম্পে কোনো নাম্বার দেওয়া নেই। হয়তো আমাদেরকে বিতর্কিত করতেই নাম্বার দিয়ে পোস্টারিং করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আমি এর সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছি। এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন/আরকে