‘আমি কোনো সাক্ষাৎ প্রার্থীকে দাঁড় করিয়ে রাখি না’

ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) মুফিদুল আলমের বিরুদ্ধে বেপরোয়া আচরণের নানা অভিযোগ উঠেছে। তাকে নিয়ে জনমনে আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এসব ঘটনায় বিব্রত সেবাপ্রার্থীরাও। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি থাকার পরও সাংবাদিক সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তির চেক হস্তান্তরে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ আবদুল্লাহকে সময় না দেওয়া। এতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চেক হস্তান্তর করেন মুহাম্মদ আবদুল্লাহ। পাওনা বেতন আদায়ে সহযোগিতা চাইতে যাওয়ায় গার্মেন্টস শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের নেতাদের সঙ্গে উদ্ধত আচরণ ও ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিয়ে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করার হুমকি, সাবেক এক সংসদ সদস্যকে সাক্ষাৎ না দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে রাখা এবং জয়নুল উদ্যানের এক দোকান কর্মচারিকে গাড়িচাপা দেওয়ার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। যা ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এসব পোস্টে নেটিজেনরা ক্ষুব্ধ মন্তব্য করেছেন।
অভিযোগ উঠেছে, গত ১২ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের হল রুমে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সাংবাদিক সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তির চেক হস্তান্তরের জন্য সময় নির্ধারণ ছিল। সে মতে যথা সময়ে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ আবদুল্লাহসহ স্থানীয় সাংবাদিকরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে উপস্থিত হন। সেখানে নেতৃবৃন্দ এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ডিসির সাক্ষাৎ পাননি। এমন অসৌজন্যমূলক পরিস্থিতিতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চেক হস্তান্তর করে ঢাকায় ফিরে যান মুহাম্মদ আবদুল্লাহ।
এ ঘটনায় ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ময়মনসিংহ এসে আমরা ভিন্ন অভিজ্ঞতা পেলাম। বাংলাদেশে আমলা শ্রেণি পর্যায়ের মধ্যে যারা জেলায় দায়িত্ব পালন করেন তারা নিজেদের রাজা মনে করেন, আর যারা জেলায় বসবাস করে তারা সবাই প্রজা। এই মানসিকতা পরিবর্তন না হলে আমরা যতই পরিবর্তনের গল্প শোনাই না কেন, এটার কোনো উন্নতি হবে না। আমরা সময় নির্ধারণ করে ঢাকা থেকে নির্দিষ্ট কর্মসূচি দিয়ে যেভাবে করতে হয়, সেভাবে করেছি এবং এসেছি। কিন্তু এখানে এসে এক ঘণ্টা বসে থাকার পরও ন্যূনতম সৌজন্যতা প্রদর্শন করা হয়নি। সিভিল সার্ভিসে ঢোকার সময় যে সভ্যতা, ভদ্রতা শেখানো হয় এক্ষেত্রে আমরা ব্যতয় দেখেছি। এটি দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা।
একই সঙ্গে গত ২৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ নগরীর জয়নুল উদ্যান পার্ক এলাকার ভ্রাম্যমাণ দোকান উচ্ছেদের ঘটনায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের কবল থেকে নিজের দোকান রক্ষা করতে সহযোগিতা কামনা করে জেলা প্রশাসকের গাড়ির সামনে দাঁড়ান ভুক্তভোগী এক যুবক। এ সময় ডিসি গাড়ি ধাক্কা দিয়ে ওই যুবককে ছিটকে ফেলে দেওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়েও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়াও গত ২১ জানুয়ারি ভালুকার এডাম গার্মেন্টস শ্রমিকদের একটি দল সম্প্রতি পাওনা বেতন আদায়ের জন্য জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করে। পরে বিক্ষোভকারী শ্রমিকরা জেলা ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। কিন্তু ডিসি দীর্ঘ সময় তাদের সাক্ষাৎ না দিয়ে বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় ডিসি শ্রমিকদের সঙ্গে উদ্ধত আচরণ করে তাদের ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিয়ে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করার হুমকি দেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে শ্রমিকরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন বলে জানান ভুক্তভোগী তোফাজ্জল হোসেন।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। শ্রমিকদের হুমকি ও পার্ক এলাকার হকারদের সঙ্গে বাজে ব্যবহারের ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমরা জেলা প্রশাসনের প্রতিপক্ষ না, ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সঙ্গে কাজ করার কারণে শ্রমিকরা ডাকলে আমাদের যেতে হয়। কিন্তু ডিসি সাহেব আমাদের ভুল বুঝেছেন।
সূত্র জানায়, জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম গত ৫ আগস্টের পর ময়মনসিংহে যোগদান করেছেন। এক সময় তিনি বন্দর নগরী চট্টগ্রামের মেয়র আ.জ.ম নাসির উদ্দিনের সহকারী ছিলেন। ২৪তম বিসিএসের এই কর্মকর্তা বিগত সরকারের বিশ্বস্ত ও দলের প্রতি আনুগত্যশীল থাকার কারণে আ.জ.ম নাসিরের আশীর্বাদে তিনি জেলা প্রশাসক হিসাবে পদোন্নতি লাভ করেন। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বাসিন্দা মুফিদুল আলম মেয়র নাছিরের একান্ত সচিব থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার সাফল্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল। ওই খবরে বলা হয়েছিল- আওয়ামী ঘরানার এ কর্মকর্তার যথাযথ মূল্যায়ন হয়েছে। এছাড়াও ডিসি মুফিদুলের ভাই সোহরাব হোসেন (বাপ্পী) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দাপুটে নেতা ছিলেন। এ কারণেই তিনি পতিত সরকারের পতনের পর নিজের বেশভুশা পরিবর্তন করলেও আচারণে আগের অবস্থান অব্যাহত রেখেছেন বলেও দাবি সূত্রের।
নাখোশ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ও উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য অ্যাডভোকেট শাজাহান কবীর সাজু বলেন, সাক্ষাৎ প্রার্থী একজন সাবেক সংসদ সদস্যকে সাক্ষাৎ না দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে রাখাসহ ডিসির বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বেশ কয়েকটি ঘটনা শুনেছি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি। এসব ঘটনা নিন্দনীয়।
একই ধরনের মন্তব্য করেছেন জেলা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব মো. আলী হোসেন। তিনি বলেন, একজন জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করবেন না, সাক্ষাৎ প্রার্থীদের সঙ্গে ভালো আচরণ করবেন না। এটা কাম্য নয়।
এ সব বিষয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) মুফিদুল আলম বলেন, সাংবাদিক নেতাদের বসিয়ে রেখে জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের একটি জরুরি মিটিংয়ে ছিলাম। মিটিং শেষ করে দেখি তারা চলে গেছেন। তাদের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু তারা রাগ করে চলে গেছেন। এতে আমার দোষ কোথায়। আর শ্রমিকদের বেতন পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আমরা কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করছি। এরপরও তোফাজ্জল লিড দিয়ে শ্রমিকদের নিয়ে এসেছে। এছাড়াও পার্কের দোকান মালিকদের কিছু লোক আমার গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ভিডিও দেখলেই বিষয়টি বুঝবেন। তাছাড়া আমি কোনো সাক্ষাৎ প্রার্থীকে দাঁড় করিয়ে রাখি না, অফিসে থাকলে আমিই বাইরে বের হয়ে সবার সঙ্গে দেখা করি।
আমান উল্লাহ আকন্দ/আরএআর