নীলফামারীর ২৭ সিনেমা হলের মধ্যে টিকে আছে মাত্র একটি

দর্শকের ভিড়ে এক সময় বিনোদনের জমজমাট কেন্দ্র ছিল নীলফামারীর ২৭ সিনেমা হল। এর মধ্যে টিকে আছে মাত্র একটি, হারিয়ে গেছে ২৬টি হল। হারিয়ে যাওয়া সিনেমা হলগুলো ভেঙে গড়ে তোলা হয়েছে মার্কেট ও গোডাউনসহ অন্যান্য স্থাপনা।
‘তামান্না’ নামে নীলফামারীর একটিমাত্র সিনেমা হল টিকে আছে জেলার সৈয়দপুরে। হল সংশ্লিষ্টরা বলছে, ভালো সিনেমা হলে হলটি দর্শক টানে, না হলে দুই থেকে চার জন দর্শক-শ্রোতাকে নিয়ে হলটি চালান তারা।
এবার ঈদের দিন থেকে এই সিনেমা হলে নারী ও পুরুষ দর্শকের জমজমাট ভিড় দেখা গেছে। প্রতিদিন বিক্রি হয়েছে লাখ টাকার টিকিট। যেখানে এক মাস আগেও প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকার টিকিটও বিক্রি হয়নি। ঈদে সিনেমা হল জমজমাট হওয়ায় নতুন করে আশার আলো দেখছেন হল সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং হলে বসে সিনেমা দেখার পরিবেশ ফিরে পাওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছে দর্শকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নীলফামারী জেলায় এক সময় ২৭টি সিনেমা হল ছিল। দর্শকের অভাবে প্রায় পাঁচ বছর আগেই পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে গেছে ২৬টি সিনেমা হল। এসব সিনেমা হলের মালিকদের মতে, ইউটিউব কিংবা অনলাইন থেকে ডাউনলোড করে হাতে হাতে ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে সিনেমা দেখছে দর্শক। তাই তারা সিনেমা হলবিমুখ। এছাড়া ভালো সিনেমা নির্মাণ না হওয়ায় হল বন্ধের অন্যতম কারণ। কিন্তু এবারের ঈদে হলমুখী হয়েছে দর্শক।
সৈয়দপুরের তামান্না সিনেমা হলে গিয়ে দেখা গেছে, দর্শকে পরিপূর্ণ। এদের মধ্যে ২০ শতাংশ নারী দর্শক রয়েছেন। এই সিনেমা হলে চলছে সাকিব খান অভিনীত ‘বরবাদ’ সিনেমাটি। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর এলাকার দর্শক রাজু আহমেদ স্ত্রী ও চার বছর বয়সের কন্যাশিশুকে নিয়ে সিনেমা দেখতে এসেছেন। তিনি বলেন, বড় পর্দায় সিনেমা দেখে যে আনন্দ রয়েছে, মোবাইল ফোনে বা স্মার্ট টিভি সেটের সামনে বসে সেই আনন্দ নেই।
ডোমার থেকে আসা রোমান কবির বলেন, পরিবারের সবাইকে নিয়ে সিনেমা দেখতে এসেছি। এর আগে এই হলে ‘প্রিয়তমা’ সিনেমাটি দেখেছি। হলের পরিবেশ মোটামুটি ভালো। বসার আসনগুলো আরও উন্নত করা পাশাপাশি শৌচাগার পরিষ্কার রাখতে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাচ্ছি।
তামান্না সিনেমা হলের অপারেটর আব্দুর রহমান বলেন, দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে জড়িত রয়েছি। এমনও দিন গেছে, দুই-তিন জন দর্শক দিয়ে সিনেমা হলের শো চালাতে হয়েছে। কিন্তু এবার ঈদে দর্শকের চাপে দিনে-রাতে মিলে পাঁচটি শো চালাতে হচ্ছে। প্রতিটি শোতে দর্শক পরিপূর্ণ।
তামান্না সিনেমা হলের মালিক মাহবুব আলী ঝন্টু জানান, দর্শকের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে জেলার ২৬টি সিনেমা হল। এসময় ঋণ নিয়ে সিনেমা হলের ব্যবসাটি ধরে রেখেছি। এবার আশার আলো দেখছি। প্রতিদিন গড়ে লাখ টাকার ওপরে টিকিট বিক্রি হচ্ছে। জনপ্রিয় অভিনেতা ও ভালো কাহিনির সিনেমা নির্মিত হলে দর্শক অবশ্যই হলমুখী হবেই।
এদিকে নীলফামারী জেলা শহরের মমতাজ মহল, কিশোরগঞ্জের বাবু টকিজ, জলঢাকার জনতা টকিজ, জনতা সিনেমা হল, ডোমারের কণিকা, ডিমলার বান্ধবী ও সীমা হলে এখন বাতিও জ্বলে না। ডোমারের মায়া সিনেমা হলকে করা হয়েছে মার্কেট আর সৈয়দপুরের লিবার্টি, বিজলী সিনেমা হল ভেঙে গড়ে তোলা হয়েছে অন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। জেলা শহরের দিপালী সিনেমা হল ভেঙে করা হয়েছে কমিউনিটি সেন্টার। অবশিষ্ট হলগুলোরও একই অবস্থা।
বন্ধ হয়ে যাওয়া হলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টেকনিশিয়ান, হল সুপারভাইজার থেকে শুরু করে এ ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল হয়ে সংসার চালাতেন প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ। তাদের অনেকেই নিরুপায় হয়ে অনেকেই বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। এসব সিনেমা হল ঘিরে গড়ে ওঠা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা হারিয়েছেন কর্মসংস্থান।
জেলা শহরের দিপালী সিনেমা হলের মালিক জিল্লুর রহমান বলেন, সিনেমার গুণগত মান না থাকায় দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এক সময় প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার ব্যবসা হলেও তা নেমে দাঁড়িয়েছিল এক হাজার থেকে পাঁচশ টাকায়। ক্রমাগত লোকশানের কারণে বন্ধ করতে হয়েছে।
বন্ধ হয়ে যাওয়া ডিমলার সীমা সিনেমা হলের মালিক মাসুদ পারভেজ রুবেল বলেন, বর্তমানে ঘরে বসেই দেশি-বিদেশি সিনেমা উপভোগ করা যায়। বাড়তি টাকা গুণে পরিবার-পরিজন নিয়ে বাংলা সিনেমা দেখতে যান না কেউ। বাংলা সিনেমাকে টিকিয়ে রাখতে হলে ছবির মান বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সিনেমা হলগুলো ডিজিটালাইজেশন ও আধুনিকায়ন করা গেলে প্রাণ ফিরে আসবে।
শরিফুল ইসলাম/আরকে