সুপেয় পানির সংকটে সুবর্ণচরে হাহাকার, খাল-বিল-পুকুরে নেই পানি

নোয়াখালীর শস্যের ভান্ডার নামে পরিচিত সুবর্ণচর উপজেলায় টিউবওয়েলে, পুকুর ও খাল-বিলে মিলছে না সুপেয় পানি। পানি সংগ্রহ করেত যেতে হয় দূর-দূরান্তে। এদিকে খাল-বিল পুকুরেও নেই পানি। ফলে এ জনপদে দেখা দিয়েছে তীব্র পানির সংকট।
জানা গেছে, গত এক দশক থেকে এ জনপদে বদলে গেছে কৃষির চিত্র। এক সময় রবি মৌসুমে পানি সেচ ছাড়াই কৃষক উৎপাদন করতো মূল্যবান রবিশস্য। আমনের মৌসুম শেষ হতেই রবি মৌসুমে এসব ফসল উৎপাদনে চলতো মহা কর্মযজ্ঞ। এ অঞ্চলে উৎপাদিত এসব রবিশস্য স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ হতো সারাদেশে। কালের বিবর্তনে কৃষিতে যুক্ত হলো উচ্চ পানি শোষণ ক্ষমতা সম্পন্ন উফশি ধানের বীজ। যা উৎপাদনে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। উপকূলীয় এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক পানির আধার সৃষ্টি না করায় কৃষক সেচের ৮০ ভাগ পানি ভূগর্ভ হতে অপরিকল্পিতভাবে উত্তোলন করে ইরি-বরো ধানের পানির চাহিদা মেটাচ্ছে। এতে করে ভূ-গর্ভের সুপেয় পানির স্তর গাণিতিক হারে নেমে যাচ্ছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির চরম হাহাকার চলছে এ জনপদে। শুষ্ক মৌসুমে ধান চাষই এখন সুবর্ণচরের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে বড় ধরনের অভিশাপে পরিণত হচ্ছে।
সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ঘুরে দেখা যায়, কৃষকরা মৌসুমি ফসল চাষ না করে ৭০ ভাগ ভূমিতেই ইরি-বোরো ধানের চাষ করছেন। যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু ধান আর ধানের সবুজ জমি। মৌসুমি ফসলের চাষ তেমন চোখেই পড়ে না। যত্রতত্র ফসলি মাঠের পাশে, পুকুর পাড়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো গভীর নলকূপ স্থাপন করে অপরিকল্পিতভাবে তুলছে ভূগর্ভের সুপেয় পানি। ধান চাষে ভূগর্ভের পানি অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে বাড়িঘরের (৭০০-১২০০ ফুট) গভীর নলকূপে এখন আর পানি ওঠে না। এক কলসি সুপেয় পানির জন্য এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে ছুটছে মানুষ। এ যেন এক কলসি পানির জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ। এতে গৃহস্থালির কাজেও দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। বিশুদ্ধ পানির অভাবে সুবর্ণচরের লাখ লাখ মানুষ দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সুবর্ণচরে ৩৮ হাজার ৫০০ হেক্টর আবাদি ভূমির মধ্যে ২০০০ সালে খালবিল ও পুকুরের পানি ব্যবহার করে মাত্র ২০০ হেক্টর ভূমিতে বোরো চাষ হতো। বাকি ভূমিতে কৃষক রবি ফসলের আবাদ করতো। ২০০০ সাল থেকে ক্রমাগত হারে সুবর্ণচরে চলতি মৌসুমে শুধু ১৮ হাজার হেক্টর ভূমিতে বোরো ধানের চাষ করেছে কৃষক এবং ২ হাজার ৭৫০ হেক্টর ভূমিতে খেসারিসহ অন্যান্য ফসলের আবাদ করা হয়েছে। এই বোরো ধান চাষে ৫০ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার ২৮০ কিউসেক পানি খরচ হচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ পানি ব্যবহার হয় উপরিভাগ থেকে। ৪ লাখ ১৪০ কিউসেক পানি খরচ হচ্ছে প্রতি হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিমাত্রায় ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরশীলতায় ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এ অঞ্চলে। ইরি-বোরো ধান আবাদ কমিয়ে আনলে পানির সংকট ধীরে ধীরে কেটে যাবে। শুস্ক মৌসুমে ধান চাষাবাদে কৃষককে নিরুৎসাহিত করতে হবে। কৃষি কাজের জন্য প্রাকৃতিক পানির আধার সৃষ্টি করে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে তা মহাবিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
উচ্চ ফলনশীল ও উচ্চ পানি শোষণ ক্ষমতা সম্পন্ন জাতের ধানের বীজ, সার, কীটনাশক এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বছরজুড়ে। এদিকে রবিশস্য ধ্বংস করে ধান চাষ বিস্তারের কারণে পুরো জনপদে পানিশূন্য হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমলেই নিচ্ছে না কৃষি বিভাগ। বিএডিসির ছাড়পত্র ছাড়াই সেচের জন্য যত্রতত্র বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। অন্যদিকে পরিকল্পনাবিহীন অনুমোদন ছাড়া স্থানীয় চাষিরা নিজের খেয়াল খুশি মতো বোরো চাষের জন্য ১৫শ থেকে ২ হাজার ফুট গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তোলার কারণে উপজেলাজুড়ে তীব্র সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সাধারণত নলকূপের গভীরতা হয় ৮০০-৯০০ ফুট। ব্যবহার করা হয় ১.৫ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ। কিন্তু সুবর্ণচরের অনেক নলকূপে ৪.৫ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ ব্যবহার করে ১৫শ থেকে ২ হাজার ফুট গভীর থেকে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) সূত্রে জানা যায়, সুবর্ণচরের চাষাবাদের জন্য ২৪৫টি গভীর নলকূপের (সেচপাম্প) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে চাষিরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরও তিন হাজারের বেশি সেচ পাম্প স্থাপন করেছেন, তবে সেগুলো অনুমোদনহীন। একটি গভীর নলকূপ ভূগর্ভ থেকে প্রতি ঘণ্টায় ১ হাজার ৮০০ কিউসেক পানি তোলা হয়।
কোনো গবেষণা ও ভূগর্ভের পানির পরিমাণ সমীক্ষা না করে গভীর নলকূপ অনুমোদন দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ভূগর্ভে কি পরিমাণ পানির মজুদ রয়েছে কিংবা গভীর নলকূপ স্থাপনে পরিবেশ প্রকৃতি ও ভূগর্ভের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে সর্বোচ্চ পানি শোষণকারী উফশী জাতের বীজ কৃষকের হাতে সরবরাহ করেছে কৃষি বিভাগ।
সুবর্ণচর উপজেলার চর আমানউল্যাহ ইউনিয়নের বাসিন্দা বেলাল হোসেন বলেন, কখনও ভাবিনি সুপেয় পানির জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হবে আমাদেরকে। পুকুর ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। কোথাও পানি নাই। বাড়িতে গভীর নলকূপ থাকলেও পানি উঠছে না নলকূপে। অন্য গ্রাম থেকে অনেক কষ্টে সুপেয় পানি সংগ্রহ করছি।
চরমজিদ গ্রামের স্কুলশিক্ষক তাজউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, চরমজিদ গ্রামের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মাত্র একটি গভীর নলকূপে পানি পাওয়া যায়। আর সেই নলকূপ ঘিরে শত শত মানুষের ভিড় এক কলসি পানির জন্য। এই নলকূপটি কয়েক গ্রামের মানুষের ভরসা। কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে নারীরা এখান থেকে পানি নিতে আসেন।
বিবি রহিমা নামের এক গৃহবধূ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের নলকূপে পানি নাই। পুকুরেও পানি নাই। পুরো গ্রামে একটা দুইটা পুকুরে পানি আছে। সবাই সেখানে গোসল করায় সেই পানি গুলো দূষিত হয়ে গেছে। আমাদের শরীর পরিষ্কার হয় না। আবার বাচ্চাকাচ্চার পানিবাহিত রোগ হয়। আমরা অনেক কষ্টে আছি।
উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন বাংলাদেশ সুবর্ণচর শাখার আহ্বায়ক আবদুল বারী বাবলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন ১৫ শত থেকে ২ হাজার ফুট নিচেও পানি মিলছে না। পানিতে লবণের পরিমাণ হঠাৎ বেড়েছে। গভীর বা অগভীর নলকূপ বসানো হয় দেড় থেকে তিন ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ দিয়ে। কিন্তু সেচকাজে ব্যবহারের নলকূপে পাইপ দেওয়া হয় ৪ থেকে ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ। এতে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষের পানি সংকট সমাধানে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে ভূগর্ভের পানির মজুতের পরিমাণ জরিপ করতে হবে। অন্যথায় পানির পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়তে পারে উপকূলীয় এজনপদে। তিনি বলেন, সুবর্ণচরে বড় বড় খাল ও লেক সেচের আওতায় আনলে দু'লাখ হেক্টর জমি চাষ করা যাবে। ২০ কোটি কিউসেক পানি পাওয়া যাবে শুধু মেঘনা লেক কাজে লাগিয়ে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চন্দ্রকলির নির্বাহী পরিচালক শাখাওয়াত উল্লাহ ঢাকা পোস্টক বলেন, কৃষি বিভাগের ভুল নীতির কারণেই সুবর্ণচরে পানির জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। রবিশস্য অধ্যুষিত এলাকায় বোরো ধান চাষ না করার বিষয়ে কৃষি আইন রয়েছে। অথচ স্থানীয় কৃষি বিভাগ এ আইন মানছে না। এছাড়া খালগুলোতে পানি থাকে না। যদি পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে সবার জন্য ভালো হতো।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভূগর্ভের পানি রক্ষায় ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের লক্ষ্যে আমরা কৃষককে রবি মৌসুমে অন্যান্য লাভজনক ফসল চাষের পরামর্শ দিচ্ছি। বিএডিসির গভীর নলকূপ অনুমোদন বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা আছে। ফলে কত পরিমাণ জমিতে কেমন পানি লাগবে, সেই তথ্য নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। চাষ অনুযায়ী গভীর নলকূপ বসানো হলে অবৈধ নলকূপ স্থাপন কমে আসত। এছাড়াও প্রাকৃতিকভাবে পানি সংরক্ষণ করা গেলে কৃষিতে পানি কম লাগবে। মেঘনা নদীর শাখা গুলোকে যদি কার্যকর করে পানি সংরক্ষণ করা যায় তাহলে কৃষক উপকৃত হবে। প্রাকৃতিক সোর্সের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে।
সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সুরাইয়া আক্তার লাকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, অবৈধ গভীর নলকূপের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে। এছাড়া সুপেয় পানির সংকটে আপদকালীন চাহিদা পূরণে জেলা জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহযোগিতায় সুপেয় পানি ও প্লাস্টিকের কনটেইনার বিতরণ করা হচ্ছে।
হাসিব আল আমিন/আরকে